একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী

মেহেদী হাসান পলাশ, Mehadi Hassan Palash
 
বান্দরবানে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওয়ার্ল্ড ভিশনের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে এনজিও ব্যুরো। নির্দেশ পাওয়ার পরপরই ওয়ার্ল্ড ভিশনের কার্যক্রম গুটিয়ে ও কার্যালয়ের আসবাবপত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। বান্দরবান ওয়ার্ল্ড ভিশন কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়স্থ এনজিও ব্যুরোর কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পরিপত্রে বলা হয়, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বান্দরবান জেলায় ওয়ার্ল্ড ভিশন আর কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। সে পত্র মোতাবেক বান্দরবান শহরের বাস স্টেশন এলাকায় অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ভিশন কার্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে। ঠিক কি কারণে বান্দরবানে তার কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে কোনো পক্ষই মুখ খুলছে না।
ওয়ার্ল্ড ভিশন নামক এই এনজিওটির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রিশ্চিয়ানাইজেশন, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় উসকানী প্রদান, পক্ষপাতদুষ্টু কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ করে আসছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালী অধিবাসীরা। বিভিন্ন সরকারি ও গোয়েন্দা তদন্তে এর প্রমাণও মিলেছে। এ ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও ও মিশনারী সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়েছে সেসব রিপোর্টে। সে কারণে পার্বত্য বাঙালীরা দীর্ঘদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের এ ধরনের এনজিওর কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার দাবি করে আসছিলো। ওয়ার্ল্ড ভিশনের বান্দরবানে ডাইরেক্ট একশন (ডাক) বা সরাসরি কর্মকাণ্ড বন্ধের নির্দেশ তারই অংশ বলে নাম না প্রকাশ করার শর্তে একটি সূত্র উল্লেখ করেছে। শুধু ওয়ার্ল্ড ভিশন নয় পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রবিরোধী কিংবা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত সব এনজিও ও মিশনারী সংস্থাকেই সরকার একে একে নিয়ন্ত্রেণে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে দাবি করেছে সূত্রটি।
 
ওয়ার্ল্ড ভিশনের বান্দরবান এডিপি ম্যানেজার টিমথি উজ্জ্বল কান্তি সরকার জানান, আশির দশকের আগে থেকে ওয়ার্ল্ড ভিশন বান্দরবান জেলায় জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সম্প্রতি তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সরকার ওয়ার্ল্ড ভিশনের কার্যক্রম নবায়ন না করে বরং  কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংস্থাটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর ফলে ওই মেয়াদের (৩০ সেপ্টেম্বর) মধ্যেই আমরা বান্দরবানে ওয়ার্ল্ড ভিশনের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার কাজ শুরু করেছি। তিনি আরো জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতায় সরকার ওয়ার্ল্ড ভিশনের নবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার বলেছে, ওয়ার্ল্ড ভিশন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, তাই বাংলাদেশে সরাসরি সংস্থাটি কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তবে ওয়ার্ল্ড ভিশন স্থানীয় এনজিওর সাথে পার্টনারশীপে জনহিতকর কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। জানা গেছে, ওয়ার্ল্ড ভিশনে ৮ জন কর্মকর্তা ও ৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সীমিত আকারে বান্দরবান সদর উপজেলার সদর, কুহালং ও সুয়ালক এই তিনটি ইউনিয়ন ও বান্দরবান পৌরএলাকায় কৃষি বিষয়ক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু কল্যাণ ও দুর্যোগকালীন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচলনা করে আসছিল। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার ১ হাজার ২৮০ জন ওয়ার্ল্ড ভিশনের স্পন্সর ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের অর্থিক ও শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছিল।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে বাস স্টেশন এলাকায় অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ভিশন কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে সংস্থাটির আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসময় দেখা যায়, ওই মাঠে প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্ল্ড ভিশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মোতাবেক নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অপ্রয়োজনীয় কাগজ পুড়িয়ে ফেলা হয়। তাই এসব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
এদিকে ওয়ার্ল্ড ভিশনের সরাসরি কর্মকাণ্ড বান্দরবানে বন্ধ করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বান্দরবানের বাঙালি জনগোষ্ঠী। একই সাথে তারা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত অন্যসব এনজিও, দাতা সংস্থা ও মিশনারী প্রতিষ্ঠানের সরাসরি কার্যক্রম শুধু বান্দরবান নয়, তিন পার্বত্য জেলাতেই বন্ধের দাবি জানিয়েছে। এ খবরে আলোচ্য বিষয় হলো, ওয়ার্ল্ড ভিশনের মতো একটি আন্তর্জাতিক এনজিও’র কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বলা সরকারি আদেশ, বড় মাপের একটি সিদ্ধান্ত। বর্তমান সরকার বলিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। জাতীয় স্বার্থে এটি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।
 
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ বলে অভিহিত না করার জন্য একটি প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপণের ভাষার বলিষ্ঠতা ছিল লক্ষণীয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার নানা ষড়যন্ত্রের কথা সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যা দেয়ার অন্তর্নিহিত কারণ সেখানে চিহ্নিত করে দেশবাসী বিশেষ করে গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্টদের ‘আদিবাসী’ শব্দ পরিহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বর্তমান সরকারের এ দুটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিরা সরাসরি সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। কিন্তু এর সুফল ঘরে তুলতে পারেনি সরকার। এর কারণ সরকারের কিছু উপদেষ্টা, মন্ত্রী, এমপি, আমলা, মহাজোটের শরীক কিছু নেতার বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড। সরকারের দায়িত্বশীল এসব ব্যক্তিবর্গ এমন কিছু বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকারের ভাবমর্যাদা উন্নত হওয়ার পরিবর্তে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক দশমাংশ ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত। জনসংখ্যা সীমিত হলেও জনবৈচিত্র্য বাংলাদেশের অন্য যে কোনো অংশের থেকে আলাদা। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ভূ-রাজনীতিতে বিশ্বে এ অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। সমৃদ্ধ সম্পদে সে আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। পার্বত্য চট্টগ্রাম সন্নিহিত কক্সবাজার ও এর পদচুমে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান বিশ্বের দৃষ্টিতে লোভনীয়। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে বিশ্বশক্তির রয়েছে অনেক ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও লোলুপ দৃষ্টি। তাই বাংলাদেশের সবচেয়ে সেনসেটিভ ভূখণ্ড এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেকারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের কাছে, বাংলাদেশের জনগণের কাছে, সরকারের কাছে আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। সঙ্গত কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যে কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা হতে হবে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত ও সুদুরপ্রসারী।
 
ooo 
 
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, এডহক নীতি ও অনেকক্ষেত্রে খামখেয়ালীপনার ভিত্তিতে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টির সময় যেমন পুনর্বাসনের কথা চিন্তা করেননি, ঠিক তেমনি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন তৈরির সময় ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রণীত একটি মৃত আইন- হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়ালকে জীবিত করেছেন। এমনকি এ আইন সৃষ্টিতে রাষ্ট্রিয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, কর্তৃত্ব ও সংবিধানকে সুবিবেচনা করা হয়নি। সে কারণেই শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে দায়ের করা রিটে উচ্চ আদালত জেলা পরিষদ আইনের বেশ কিছু ধারাকে “রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রবিরোধী বলে বাতিল করে দিয়েছেন। এরশাদের পর বিএনপি ক্ষমতায় এসে শান্তিচুক্তি করার জন্য কর্নেল অলি আহমদ ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে জেএসএস’র সাথে আলোচনা চালিয়ে গেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন সেই শান্তিচুক্তি করেছে বিএনপি তাকে ‘দেশ বিক্রির কালো চুক্তি’ বলে আখ্যা দিয়ে তারা ক্ষমতায় গেলে তা বাতিল করার ঘোষণা দিয়ে প্রবল আন্দোলন করেছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগ নিজেও যখন শান্তিচুক্তি করেছে তখন সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের চেয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তিকেই হয়ত বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে আদালতের স্টে অর্ডারের স্যালাইন দিয়ে শান্তিচুক্তিকে এখন আইসিইউতে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এদিকে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এসে কিন্তু ‘দেশ বিক্রির কালো চুক্তি’ বাতিল করেনি, বরং তারাই এচুক্তি সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন করেছে।
 
‘আদিবাসী’ বিষয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে নিম্নস্তরে এক ধরনের সমর্থন ছিল সবসময়। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও এই ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে ‘আদিবাসী’ কনসেপ্টের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগই। এ বিষয়ে ভারতীয় সমর্থন পাওয়ার ফলেই সরকারের পক্ষে এমন শক্ত অবস্থান নেয়া সম্ভব হয়েছে। আমাদের পার্বত্য নীতি স্পষ্ট হলে এমন অনেক আন্তর্জাতিক বন্ধু পাওয়া সম্ভব।(যদিও সিএইচটি নিয়ে ভারতের সব নীতিই আমাদের স্বার্থানুকূল হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই)।  কিন্তু শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের নামে বিভিন্ন স্থান থেকে ঢালাওভাবে বহু নিরাপত্তা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন কার্যত পাহাড়ী চাঁদাবাজ, অপহরণকারী ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালি। সেকারণে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদটি পাহাড়ীদের দখলে থাকলেও সচিব পদটিতে বাঙালি আমলার পদায়ন হয়েছে সব সময়। ফলে সরকারী কার্যক্রম ও নীতিতে এক ধরণের ভারসাম্য ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মন্ত্রীর পাশাপাশি সচিব পদেও পাহাড়ী পদায়ন করায় পার্বত্য মন্ত্রণালয় কার্যত, একটি ভারসাম্যহীন একপেশে সাম্প্রদায়িক মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানে।
 
এভাবেই সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী নীতি পরিবর্তন হয়। শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, সরকারি কর্মকর্তা পরিবর্তনের সাথে সাথেও সেখানে নীতির পরিবর্তন ঘটে। এক কর্মকর্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে ২-৩ বছরের দায়িত্ব পালনকালে যে নীতি অনুসরণ করেন পরবর্তী কর্মকর্তা এসে তা সম্পূর্ণ উল্টে দেন। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্রগতি ও সহাবস্থান চরমভাবে ব্যাহত হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন নিয়ে সাম্প্রতিক অস্থিরতা। আদালত শান্তিচুক্তির মৌলিক ধারাগুলোর বেশিরভাগই অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেয়ার পর ভূমি কমিশনও অসাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাতিল হয়ে যাবে, এমনটাই মতামত ছিল দেশের প্রাজ্ঞ আইনজীবীদের। বর্তমান সরকারের কতিপয় ব্যক্তির অতি আগ্রহে যখন ভূমি কমিশন একতরফাভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন স্বভাবতই বাঙালিরা ভূমি কমিশন বাতিলের দাবিতে তীব্র আন্দালন গড়ে তোলে। সেসময় কোনো কোনো কর্মকর্তা মনে করলেন, সরকারেরও মুখ রক্ষা করা দরকার। ব্যাস, বাঙালিদের একটি অংশের হাতে ভূমি কমিশন সংস্কার প্রস্তাবের একটি ড্রাফট তুলে দিয়ে সরকারী কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠকে বসিয়ে দিলেন। ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রিয় অখণ্ডতা, সংবিধান, সরকারি কর্তৃত্ব, আদালতের এখতিয়ার বিরোধী একটি প্রতিষ্ঠান বাতিল না হয়ে টিকে থাকার পথ তৈরি হলো। এ নিয়ে ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক নৈরাজ্য, বিভেদ ও দ্বন্দ্ব। এমনও দেখা গেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বপালনকালে কোনো এক সরকারী কর্মকর্তা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভালবেসে এর উপর দুটি বই লিখে ফেলেন ছদ্মনামে। তথ্যবহুল ও গবেষণামূলক এই বইটি প্রচারে তখন সরকারীভাবে ব্যাপক প্রমোট করা হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এ বইটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ বইটিই অত্যন্ত মেধাবী এ কর্মকর্তার চাকুরী অবসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণায় প্রায় সকল সরকারী অফিসেই বইটি অনুসৃত হয়। এরপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ভালবেসে কিছু করার ক্ষেত্রে সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যেও এক ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে থাকে। একটি স্থায়ী পার্বত্য নীতি না থাকার কুফল এটি।
 
সিএইচটি নিয়ে যে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র ভারতের সেভেন সিস্টার্সও তার অন্তর্ভূক্ত। সেটা বুঝতে পেরেই ভারত সরকার সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে পাশ্চাত্যের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সরাসরি কার্যক্রম বা ডাইরেক্ট একশন (ডাক) বন্ধ করে দিয়েছে।  সেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে কার্যক্রম পরিচালনা করে ভারত সরকার বা ভারতীয় এনজিও। কিন্তু বাংলাদেশে এসব আন্তর্জাতিক এনজিও, দাতা সংস্থা ও মিশনারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের কার্যক্রম ও অর্থ পরিচালনার কোনো হিসেব বাংলাদেশ সরকারকে দেয় না। এমনকি তাদের মিটিংগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের ঢুকতে দেয় না। কেউ ঢুকলেও পরিচয় পেলে অপমান করে বের করে দেয়। সে ক্ষেত্রে বান্দরবানে ওয়ার্ল্ড ভিশনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ইতিবাচক। অন্যান্য এনজিও ও দাতা সংস্থার ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা কাম্য। অথচ একই সময়ে সরকারের কোনো কোনা মন্ত্রী ইউএনডিপির মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুল বিতর্কিত দাতা সংস্থার কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধির জন্য ডিও লেটার পাঠাচ্ছে তাদের আবাসিক কার্যালয়ে এবং তা সাথে সাথে গৃহীতও হয়েছে। একটি স্থায়ী পার্বত্য নীতির অভাবেই এমনটি ঘটছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী-বাঙালি বিভেদের কথাই কেবল দেশবাসী জেনে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আট লক্ষাধিক উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড়জোর হাজার দশেক লোক এই বিভেদের সাথে জড়িত। এরা ইউপিডিএফ, জেএসএস’র সন্ত্রাসী ও মতলববাজ এনজিও কর্মী। বাকি সকল উপজাতি সদস্য কিন্তু শান্তিপ্রিয়, পাহাড়ী বাঙালি সহাবস্থানে বিশ্বাসী ও দেশপ্রেমিক। কিন্তু মুষ্টিমেয় সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মুখে তারা বাধ্য হয় সন্ত্রাসীদের সেখানো বুলি প্রচার করতে, তাদের গাইডেড পথে চলতে। অথচ এই সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্র বিশেষে তারা বাঙালীদের থেকেও বেশি ঘৃণা করে। কারণ বাঙালিদের থেকে তারা আরো বেশি সন্ত্রাসের/ চাঁদাবাজির শিকার। সিএইচটিতে কর্মরত এনজিও কর্মীরা নানা কায়দার বিভেদ ছড়িয়ে দিয়ে একটি বাঙালী বিদ্বেষী প্রজন্ম সৃষ্টি করতে অপচেষ্ট। অথচ এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় দেশপ্রেমিক উপজাতিদের নিরাপত্তা দিয়ে, ভালবেসে কাছে টানা হয়নি কখনো।বরং উপজাতি বলে সন্ত্রাসীদের পাল্লায় তুলে কেবল দূরেই ঠেলে দেয়া হয়েছে। সেখানে বিভেদের দশভূজা জাগ্রত কিন্তু শান্তির বীণাপাণি নিদ্রা যায়। কোনো কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারী পৃষ্টপোষকতায় সম্প্রীতি মিছিল চোখে পড়লেও সরকারী লোকেরা যেভাবে সে মিছিল চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে তাতে সম্প্রীতির থেকে সংশয় চোখে পড়ে বেশী।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিভ্রান্তি দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে বেশি। এদের বেশিরভাগই মনে করেন বাঙালি ও সেনাবাহিনী সেখানে যত সমস্যার মূল। সন্দেহ নেই, তাদের বিভ্রান্তি ভিত্তিহীন। কিন্তু সে বিভ্রান্তি অপনোদনের চেষ্টা রাষ্ট্রিয় পর্যায় থেকে কি যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে? ঘটনার প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে সেখানে মিডিয়া টিম পাঠানো হয়, বুদ্ধিজীবীদের কাউকে অনুরোধ করে লেখানো হয়। কিন্তু এ দেশের কতজন মানুষ জানে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন প্রেক্ষাপটে বাঙালিদের পাঠানো হয়েছে? কতজন জানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অবস্থানের গুরুত্ব? কতজন জানে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসলে কি করে? তাদের সেবা, ত্যাগ, কমিটমেন্টের কথা কতো জনের মাঝে তুলে ধরা হয়েছে? কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান নিয়ে বলিউডে অনেক সিনেমা হয়েছে, হলিউডের কথা বললে তো একটি বই লেখা হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগের অনেক ঘটনা গল্প ও ছবিকে হার মানায়। কিন্তু তার কথা দেশের কতজন মানুষ জানে। একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি না থাকার কারণেই তা সম্ভব হয়নি।
 
কাজেই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থির পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনো এডহক সিদ্ধান্তে সমাধান না খুঁজে একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি প্রণয়নের দিকে বেশি জোর দিতে হবে। সেখানে বসবাসকারী সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ,  সিভিল ও সামরিক প্রশাসন, বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে এ পার্বত্যনীতি প্রণয়ন করতে হবে- যা সব সরকার ও সব ব্যক্তির জন্য অনুসরণযোগ্য ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এখনই সময়। কারণ লেটার ইজ বেটার দ্যান নেভার।  
Email:[email protected], সৌজন্যে- দৈনিক ইনকিলাব। (ইষৎ পরিবর্তিত)

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে লেখকের আরো কিছু প্রবন্ধ

পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে

একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী

বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক

আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩

 
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

9 Replies to “একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন