পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে

মেহেদী হাসান পলাশ, Mehadi Hassan Palash

 মেহেদী হাসান পলাশ

২০১৪ সালের প্রথম চতুর্ভাগে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হলো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের ফলাফলের জাতীয় প্রবণতার সাথে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের এক দশমাংশ ভূখণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের ফলাফল ভিন্নতর। সেটা শুধু স্রেফ ভিন্নতা নয়, এর সাথে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, জাতীয়তা, সংবিধানসহ নানা বিষয় জড়িত হয়ে পড়েছে।সে কারণে এ ভিন্নতাটি বিশেষভাবে আলোচনার দাবী রাখে।

৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট বয়কট করেছিল।নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল শাসকদল আওয়ামী লীগ, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস(সন্তু), জেএসএস(সংস্কারপন্থী) ও ইউপিডিএফ। সে নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আসনের মধ্যে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে আওয়ামী লীগ এবং রাঙামাটিতে জেএসএস(সন্তু) প্রার্থি জয়লাভ করেছে।অভিযোগ রয়েছে রাঙামাটিতে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামীলীগ প্রার্থিকে পরাজিত করাতে জেএসএস প্রার্থির পক্ষে গোপনে কাজ করেছে ও ভোট দিয়েছে। জেলা বিএনপি’র শীর্ষনেতা এ ব্যাপারে জোরালো ভুমিকা রেখেছেন বলে আওয়ামী লীগের তরফেও অভিযোগ করা হয়েছে। একইভাবে খাগড়াছড়ি আসনেও বিএনপির বিপুল পরিমাণ সাধারণ ভোটার ইউপিডিএফ প্রার্থি প্রসীত বিকাশ খীসাকে ভোট দিয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে। যদিও প্রসীত বিকাশ খীসা পরাজিত হয়েছেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী শাসক দলের প্রার্থি কুজেন্দ্রলালের বিজয় নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে জেলাবাসীর মনে। তারা মনে করে নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা না থাকলে এখানেও ভোটের ফলাফল ভিন্নতর হতে পারতো।  

অন্যদিকে ৪র্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩টি, বিএনপি ৭, জামায়াত ১, ইউপিডিএফ ৪, জেএসএস(সন্তু) ৮ ও জেএসএস(সংস্কার) ২টি পদে বিজয়ী হয়েছে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলা আসনের মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ১১টি আসনে এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো ১৪টি আসনে জয়লাভ করেছে। অর্থাৎ ৬০ ভাগেরও বেশী উপজেলা আসন এখন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর দখলে।বাংলাদেশের সংবিধানে এককেন্দ্রীক রাষ্ট্রের বৈশিষ্টতা ও গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের বৈধতা দানের সুযোগ না থাকায় স্বতন্ত্রপ্রার্থি হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো এ সংখ্যক আসনলাভ করেছে।এখানে উল্লেখ্য যে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে একটি আসনে বাঙালী অধিকার আন্দালনের সংগঠন সমর্থিত প্রার্থি নির্বাচনে অংশ নিলেও তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

এতে আশঙ্কার কারণ হচ্ছে, এই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে বাংলাদেশের এককেন্দ্রীক রাষ্ট্র কাঠামোর বৈশিষ্ট্য ভেঙে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে আন্দোলন করছে। কিন্তু অপ্রকাশ্যে বা গোপনে এই সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্মল্যান্ড নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছে। এ লক্ষ্যে তাদের রয়েছে গোপন সামরিক বাহিনী ও পতাকা ইত্যাদি।পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দুর ও নিকটবর্তী বিদেশী ষড়যন্দ্রকারী শক্তিসমূহের সাথে এই আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর রযেছে গভীর আঁতাত। তারা অর্থ সমর্থনসহ নানাভাবে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে সমর্থন যুগিয়ে আসছে।কাজেই এ ধরণের রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি যখন সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্রমাগত শক্তিশালী হতে থাকে তখন দেশপ্রেমিক জনতা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। জাতীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এহেন রাষ্ট্র বিরোধী শক্তিগুলোকে দ্রুততার সাথে নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করার কোনো বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যে জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সুনির্দিষ্ট, সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত ও সুগভীর নীতিমালা প্রণয়ন জরুরী। তবে সেই পরিকল্পনা বিশ্লেষণের আগে তিন পার্বত্য জেলার উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ জরুরী।কিন্তু তার আগে এ কথা মনে রাখা জরুরী যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের আর ৫০টি সমতল জেলার মতো নয়। ভৌগলিক অবস্থান, ভূরাজনীতি, ভূপ্রকৃতি, জীব ও জনবৈচিত্র প্রভৃতি বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অনন্য বৈশিষ্ট সম্পন্ন অঞ্চল। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে যে কোনো বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, নীতিগ্রহণ ও বিবেচনার ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গী প্রয়োজন। 

উপজেলা নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলায় জাতীয় দলগুলোর আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত না হওয়ার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, নিরাপত্তাহীনতা, জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক দূর্বলতা, সাংগঠনিকভাবে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পার্বত্য চট্ট্রগ্রাম বিষয়ে বাংলাদেশের অখণ্ডতার নিরিখে বিশেষ দর্শন বা অবস্থান না থাকা, রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা, দ্বন্দ্ব, বাঙালী-পাহাড়ী নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা, শক্তিশালী বাঙালী নেতৃত্ব তৈরী না হওয়া, বাঙালী সংগঠনগুলোর বিভাজন, নেতৃত্বের দূর্বলতা ও জনসম্পৃক্ত হতে না পারার ব্যর্থতা, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত প্রভৃতি।

উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় দলগুলো বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মনোনয়নের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব এই দুটি দল তিন পার্বত্য জেলার বেশ কিছু আসনে মনোনয়নই দিতে পারেনি।রাঙমাটির ১০টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ৬টিতে, বিএনপি ৭টিতে, খাগড়াছড়ির ৮টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ সবগুলো উপজেলায় এবং বিএনপি ৬টিতে বান্দরবানের ৭টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ সবগুলোতে এবং বিএনপি ৪টিতে ও জামায়াত একটিতে মনোনয়ন জমা দিয়েছিল। অর্থাৎ ২৫টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪টিতে ও বিএনপি ৮টি আসনে মনোনয়ন দিতে পারেনি বা মনোনয়ন দেয়ার মতো সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠেনি প্রভাবশালী জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের শাসনামলে তিন পার্বত্য জেলা থেকে ৬ জন করে জনপ্রতিনিধি প্রতিমন্ত্রী বা সমমর্যাদার স্ট্যাটাস ও সুবিধা ভোগ করে থাকেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সবগুলো উপজেলায় মনোনয়ন দেয়ার মতো সাংগঠনিক অবস্থা তৈরী করতে পারেনি।মূলত পাহাড়ী অধ্যুষিত উপজেলাগুলোতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো নমিনেশন দিতে ব্যর্থ হয়েছে।অথচ এই দুই দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বের পদগুলো পাহাড়ীদের দখলে ।অভিযোগ রয়েছে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ দিনে বা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ/বিএনপি করলেও গোপনে জেএসএস বা ইউপিডিএফ’র সাপোর্টার। সবক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।আবার জেএসএস ও ইউপিডিএফও বিভিন্ন কৌশল ও লবিঙের মাধ্যমে তাদের সাবেক সহযোদ্ধাদের এ দুই দলের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত করিয়ে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে থাকে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের বিরোধীতা করে জেএসএস ও শান্তিবাহিনীর জন্ম হলেও জিয়াউর রহমানের নীতির কারণে তারা গা বাঁচাতে আওয়ামী লীগের সাথে মিত্রতা গড়ে তুলেছিল।এদিকে শান্তিচুক্তি করার কারণে জেএসএস ও তার প্রভাবে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বড় অংশটি আওয়ামী লীগের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে আর বিএনপি বাঙালী ঘেষাঁ রাজনৈতিক দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বাঙালী হত্যাকান্ডের নায়ক শান্তিবাহিনীর মেজর রাজেশকে নমিনেশন ও ক্ষমতায় এসে প্রতিমন্ত্রী হিসাবে অধিষ্ঠিত করে। মেজর রাজেশ ওরফে মনি স্বপন দেওয়ান প্রতিমন্ত্রী হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিএনপিকে সংগঠিত করার চেয়ে জেএসএস’র স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিত ছিল। পরবর্তীকালে সংস্কারপন্থী হয়ে বিএনপি ত্যাগ করলেও তার জায়গায় রাঙামাটি জেলা বিএনপি’র নেতৃত্বে যিনি এসেছেন তিনি আরো বেশী জেএসএস ঘেঁষা বলে অভিযোগ রয়েছে।এই ব্যক্তির কারণে রাঙামাটিতে বিএনপি’র সাথে বাঙালী সংগঠনগুলোর ব্যাপক দুরত্ব তৈরী হয়েছে। বাঙালী অধিকার আদায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর কোনো অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতারা অংশ নিলে বা পৃষ্ঠপোষকতা দিলে তার তিরস্কার সইতে হয়। তিনি সুকৌশলে বিএনপি’র জেলা, উপজেলা কমিটি ও অংগ সংগঠনগুলোর কমিটিতে জেএসএস’র সাবেক ও গোপন সদস্যদের পুনর্বাসন করেছেন। ফলে বিগত সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে নমিনেশন, প্রচার প্রচারণা ও ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে জেএসএসের জন্য সুবিধাজনক রাস্তা তৈরী করতে তার কোনো বেগ পেতে হয়নি।সেকারণে বিগত সংসদ নির্বাচনে জেএসএস’র সাবেক সামরিক কমান্ডার মেজর মলয়কে(উষাতন) সমর্থন দিতে তার একটুও কষ্ট পেতে হয়নি।

বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিন পার্বত্য জেলা থেকে ৫জন পাহাড়ী নেতা থাকলেও বাঙালী নেই একজনও। এই পাহাড়ী নেতাদের বেশিরভাগই বিগত দুটি নির্বাচনে জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র সমর্থনে প্রকাশ্যে ও গোপনে কাজ করেছে। খাগড়াছড়ি বিএনপির একটি অংশ বিভিন্ন উপজেলায় প্রকাশ্যে ইউপিডিএফকে সমর্থন দিয়েছে।অন্যদিকে বান্দরবান জেলায় বিএনপি-জেএসএস আঁতাত ছিল প্রকাশ্য। দুইটি উপজেলার চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রকাশ্যে তারা জেএসএসকে সাপোর্ট করেছে। এমনকি নাইক্ষংছড়ি উপজেলায় জেএসএস-জামায়াত সমঝোতায় জামায়াত প্রার্থি জয়লাভ করেছে। তবে এর বাইরেও বিভিন্নস্থানে বিএনপি আওয়ামী লীগ একে অন্যকে ঠেকাতে জেএসএস ও ইউপিডিএফকে সাপোর্ট করেছে।

এদিকে রাজনৈতিক মাঠে জেএসএস-ইউপিডিএফ প্রবল প্রতিপক্ষ হলেও যেসকল উপজেলায় বাঙালী প্রার্থি বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে সমন্বিতভাবে পাহাড়ী প্রার্থিকে সাপোর্ট করেছে। খাগড়াছড়ির দিঘীনালা ও রাঙামাটি সদর এভাবেই পারস্পারিক বিনিময়ের মাধ্যমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাঙালী প্রার্থিকে জয়লাভ করতে দেয়নি তারা। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে পাহাড়ীদের সকল আন্দোলন ও দাবীকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা করে গেছে। সেকারণে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাহাড়ীদের উচ্চপদে দেখা গেলেও পার্বত্য বাঙালীদের বেলায় তা দেখা যায় না। অন্যদিকে পাহাড়ী আঞ্চলিক সংগঠনগুলো সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে জাতীয় পর্যায়ের বাম রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমগুলো তাদের দাবীগুলোকে সবসময় সক্রিয় সমর্থন যুগিয়ে আসছে। এমনকি রাষ্ট্রিয় অখণ্ডতা ও সংহতির জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী দাবীগুলোতেও এই বামপন্থীরা পাহাড়ীদের সমর্থন করে থাকে। ফলে পাহাড়ী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্রঘাতী দাবীগুলোও সমগ্র দেশবাসীর মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই অসচেতনভাবে সমর্থিত হয়ে থাকে। অথচ জাতি হিসাবে আমরা বাংলাদেশের ৯৯% সমতলবাসীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনন্য বৈশিষ্টের কথা তুলে ধরতে পারিনি।এর ভৌগলিক অবস্থান ও ভুরাজনৈতিক গুরুত্ব, একে নিয়ে চলমান দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সচেতন করতে পারিনি। মূলত একটি স্থায়ী জাতীয় পার্বত্যনীতি না থাকার কারণেই এই বিচ্যুতি সৃষ্টি হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের একক বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালী- মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ভাগ।কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান সরকারী বৈষম্যমূলক নীতি, বিদেশী দাতা গোষ্ঠী ও এনজিও’র পক্ষপাতিত্বের কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হচ্ছে পার্বত্য বাঙালী সম্প্রদায়।এই বৈষম্য ও পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি বাঙালী অধিকার আন্দোলনের সংগঠন রয়েছে। এদের মধ্যে সমঅধিকার আন্দোলন, পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য গণপরিষদ ইত্যাদি। কিন্তু নেতৃবৃন্দের নীতিহীনতা, সুবিধাবাদ, অনৈক্য, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, দ্বন্দ্ব প্রভৃতি কারণে পার্বত্য বাঙালীদের সংগঠনগুলো শক্তিশালী, জনপ্রতিনিধিত্বশীল হয়ে ওঠেনি। দু’একজন নেতা এই আন্দোলনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসলেও ক্ষমতার লোভে অতি দ্রুতই জাতীয় রাজনৈতিক দলে ঢুকে সেখানকার পরিস্থিতি বিবেচনায় বাঙালীদের সাথে দুরত্ব তৈরী করতে বাধ্য হয়েছে।এর মধ্যে আবার সবচেয়ে সক্রিয় দুটি সংগঠনের একটি জামায়াতের অপরটি বিএনপি’র পকেট সংগঠনে পরিণত হওয়ায় পার্বত্য বাঙালীদের মাঝে সার্বজনীনতা পায়নি।এছাড়াও বাঙালী সংগঠনগুলো একটি বিশেষ গোষ্ঠীর উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ার কারণে সংগঠন ও নেতৃত্বের কাঙ্ক্ষিত বিকাশ লাভ করেনি।

বিগত দুটি নির্বাচনে পাহাড়ী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর আশাতীত সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ শক্তি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন। একথা সত্য যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আয়োজন সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। একারণে প্রতিদিন সেখানে হত্যা, ধর্ষণ, অপরহণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে।চাঁদাবাজি সেখানে এতাটাই বাস্তব যে, সরকারী ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে হয়তো সেখানে পার পাওয়া যায় কিন্তু চাঁদাবাজদের চাঁদা না দিয়ে পার পাওয়ার কোনো ‍উপায় নেই। থানার পাশে, ক্যান্টনমেন্টের পাশে বসবাসকারীরাও চাঁদাবাজির কবল থেকে রেহাই পাননা। এমনকি সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরাও চাঁদাবাজির আওতামুক্ত নয়। এসব অপরাধীদের দু’একজনকে মাঝে মধ্যে নামমাত্র গ্রেফতার করা হলেও বিচার করে তাদের কারোরই শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি।বিচারহীন অপরাধ সেখানে ফ্রি স্টাইলে চলে।এই অপরাধের শিকার শুধু বাঙালীরা নয়, নিরীহ পাহাড়ীরাও সমভাবে হচ্ছে।ফলে সন্ত্রাসীদের প্রতি পাহাড়ীরা ক্ষুদ্ধ হলেও জীবনের নিরাপত্তার হুমকির মুখে তারা এ সকল সন্ত্রাসীদের ভোট দিতে বাধ্য হয়।

এই নিরাপত্তাহীনতার একটি কারণ দূর্গমতা হলেও শুধু দূর্গমতার উপর দায় চাপিয়ে পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। নিরাপত্তা বিষয়ক নীতি, পদ্ধতির ভ্রান্তি ও জটিলতা এর জন্য অন্যতম দায়ী। কেননা রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তাবিধান করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। দুর্গম বলে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দীর্ঘদিন ফেলে রাখতে পারেনা।

পার্বত্য বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তাবিষয়ক নীতি, পদ্ধতিকে নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তাদের মতে, অপরাধীরা যুগ যুগ ধরে বিচার বহিঃভূত থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। সেখানে নিরাপত্তার জন্য বিপুল পরিমাণ সেনাবাহিনী থাকলেও তারা ‘In aid to civil power’ হওয়ার কারণে পুলিশ বিজিবি’র সহায়তা ছাড়া রাষ্ট্রই তাদের ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার প্রদান করা ও এককভাবে অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা প্রদান জরুরী। একইসাথে র‌্যাব দিয়ে যেভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বহারা সন্ত্রাসী দমন করা হয়েছে সেভবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের দমন করা জরুরী। অপরাধ নির্মূল করতে অপরাধী নির্মূল করতে হবে- নীতি গ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে। তবে এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য ও সচেতনতা গড়ে তুলতে না পারলে এ ধরণের অভিযান সমালোচনার মুখে থুবড়ে পড়তে পারে। সেকারণে একটি স্থায়ী জাতীয় পার্বত্যনীতি প্রণয়ন অতি জরুরী এবং এ নীতির আওতায় জাতীয় জনমত গঠন থেকে শুরু করে সরকারী বেসরকারী, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সকল পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর গুপ্তচরদের ছেঁটে ফেলে দেশপ্রেমিক পাহাড়ী-বাঙালী নেতৃত্ব বিকাশে সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। পাহাড়ী- বাঙালী দেশপ্রেমিক সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।পাহাড়ী নেতৃত্বের সমপর্যায়ে বাঙালী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে। জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন থেকে শুরু করে সরকারী-বেসরকারী চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী-বিচি্‌ছন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন কর্মীরা যেন অনুপ্রবেশ না করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে কোনো শৈথিল্য ও সময়ক্ষেপন করা চলবে না্। কারণ সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে এই সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো জাতীয় দৃষ্টির বাইরে থেকে, জাতীয় দৃষ্টির অগোচরে, উদাসীনতায় যেভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে তাতে জাতীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও সংহতি বিপন্ন হওয়ার মুখে উপনীত হয়েছে।

Email: [email protected]

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে লেখকের আরো কিছু প্রবন্ধ

একটি স্থায়ী পার্বত্যনীতি সময়ের দাবী

বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক

আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ১

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ২

পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ নয়, বাঙালীরা কি মানুষ নন- ৩

আরও প্রবন্ধ

বাংলাদেশে আদিবাসী নিয়ে বাড়াবাড়ি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি

চাকমা রাজপরিবারের গোপন ইতিহাস

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, জেএসএস, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

13 Replies to “পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন