রাঙামাটি- কমলছড়ি- দিঘীনালা: পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের টার্গেট প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী

??????????????????????????????????????????

মুজিবুর রহমান ভুইয়া :

পাশের পাহাড়ী জেলা রাঙ্গামাটি সদর, নানিয়ারচর হয়ে কমলছড়ি থেকে দীঘিনালা। পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের বর্তমান টার্গেট প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি হামলার ক্ষত না শুকাতেই আরেকটি হামলাই বলে দেয় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের এসব হামলা অত্যন্ত সু-পরিকল্পিত ও টার্গেট সুনির্দিষ্ট। তারা অনেকটাই সংঘবদ্ধ হয়ে এসব হামলা চালাচ্ছে। আর প্রতিটি হামলার সাথেই স্থানীয় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

দিনের পর দিন তারা যে অসহিষ্ণু আচরণ-সন্ত্রাস করছে তাতে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে পাহাড়ের সচেতন মহল। তাদের মতে, অসহিষ্ণু পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের প্রতি সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতো সহিষ্ণু কেন?

স্বাধীনতার মাসের শুরুর দিন পহেলা মার্চ সরকারি কাজে জমি দেখতে গিয়ে পাহাড়ী সন্ত্রাসী গোষ্ঠির হামলার মুখে পড়েন রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: তানভীর আযম সিদ্দিকী। এসময় তিনি পাহাড়ি এলাকা দৌড়ে জঙ্গলে পালিয়ে এবং কর্ণফুলি নদীতে সাঁতরিয়ে কোন রকমে জীবন নিয়ে রাঙ্গামাটি ফিরে আসেন। এসময় তিনি শারিরীকভাবে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্তও হন। একজন সরকারী পদস্থ কর্মকতার উপর এ হামলার ঘটনা কাউকেই আটক করা হয়নি।

৩ মার্চ এক সপ্তাহের মাথায় দ্বিতীয় বারের মতো হত্যার হুমকি দেয়া হয় সৎ-স্বজ্জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নুরুজ্জামানকে। একটি নাম্বার থেকে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের মোবাইল ম্যাসেজের মাধ্যমে দেয়া হুমকিতে বাঁচতে চাইলে দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবী করে বলা হয়েছে না হলে তার পরিবারকে অভিজিৎ রায়ের ভাগ্যবরণ করতে হবে। দুই মাস পুর্বে মোবাইল ফোন কোম্পনী রবি আজিয়াটা‘র ০১৮৬৯১০৩৫৭২ নাম্বার থেকে পাঠানো পৃথক তিনটি এসএমএস-এ ইউএনও নুরুজ্জামানকে ফ্যামিলি নিয়ে সড়ক ও নদী পথে নানিয়ারচর না আসার কথা বলা হলেও এবার একই অপারেটরের ০১৮৭২১৬৭৬৮১ নাম্বার থেকে ২রা মার্চ পাঠানো এসএমএম-এ বলা হয়েছে, ‘‘আপনি দুরের মরণ কাছে নিয়ে এসেছেন, আপনি যতোই আর্মি ও পুলিশ গার্ড দিয়ে যান কোন লাভ হবেনা। পেট্রোল বোম দিয়ে মারবো না হয় বুলেট, পারলে বদলী হয়ে যাও। না হয় আমরা বিদায় করে দিবো, না হয় তোমার ফ্যামিলি অবস্তা অভিজিৎ রায়ের মতো হবে। না হয় দুই কোটি টাকা রেডি রাখো। গুড বাই’’ ।

নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ নুরুজ্জামান এ প্রতিনিধিকে বলেন, আমি নানিয়পারচরে টিআর, কাবিখা, এডিবিসহ সরকারী সম্পত্তির সুষম বন্টন করে সরকারী সব সুযোগ-সুবিধা সাধারণ জনগণের কল্যাণে কাজ করছি বলেই সন্ত্রাসীদের ঘাত্রদাহ হচ্ছে। তিনি বলেন, যতোই হুমকি-ধমকি আসুক আমি আমার অবস্থান থেকে পিছপা হবো না।

গত বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী নানিয়ারচরে বাঙালীদের সাড়ে ৫ লাখ ফলন্ত আনারস গাছ ও ২২ হাজার সেগুন গাছের বাগান কর্তনের ঘটনার তদন্তে গেলে ডিসি, এসপি, সেনাবাহিনীর সামনেই ইউএনও নুরুজ্জামানকে লাঞ্ছিত করে স্থানীয় উপজাতীয় মহিলা মেম্বার। কিন্তু এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এদিকে ৫ মার্চ রাঙামাটির ফরম্যান টিলা এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল দলের উপর গুলিবর্ষণ করে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা।

রাঙ্গামাটির পরে গেল শুক্রবার (১৩ মার্চ) খাগড়াছড়ির কমলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে রাতে শতবর্ষ উদযাপন কমিটি সেখান অবৈধভাবে জুয়ার আসর বসায়। বিষয়টি জানতে পেরে এদিন রাত ৯টার সময় সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো: সারোয়ার আলম‘র নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি মো: মিজানুর রহমানসহ পুলিশ জুয়াড়ীদের ধরতে গেলে পাহাড়ী গ্রামবাসীসহ জুয়াড়ীরা পুলিশের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। পাহাড়ীদের হামলায় হামলায় সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো: সারোয়ার আলম (৩৯) ও খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি মো: মিজানুর রহমানসহ (৪০) আট পুলিশ সদস্য আহত হয়। হামলায় সহকারী পুলিশ সুপার মো: সারোয়ার আলম‘র মাথায় গুরুত্বর জখম হয় এবং অন্যদের হাতে-পায়ে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লাগে। এসময় গ্রামবাসীরা খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি’র গাড়ীও ভাংচুর করে।

DSC02922

ঠিক তার তিন দিনের মাথায় গেল রোববার(১৫ মার্চ) দীঘিনালার ‘বাবুছড়া থেকে ৫১ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদরদপ্তর স্থানান্তর, পাহাড়ীদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও উচ্ছেদ হওয়া ২১ পাহাড়ি পরিবারকে নিজ নিজ জমিতে পুনর্বাসনের দাবিতে’ বিজিবি সদর দপ্তরকে অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচীর নামে উগ্র সাম্প্রদায়িক পাহাড়ী সংগঠন চুক্তিবিরোধী ইউনাইডেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ সমর্থিত দীঘিনালা ভুমি রক্ষা কমিটির নেতৃত্বাধীন পাহাড়ীরা সু-পরিকল্পিতভাবে হামলা করে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর। ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হামলায় খাগড়াছড়ির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো: মিজানুর রহমানসহ ১০ সেনা সদস্য আহত হয়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির নেতৃত্বে বিজিবি ৫১ নং ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর উচ্ছেদের দাবীতে স্থানীয় পাহাড়ীরা দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, লাঠিসোটা নিয়ে সামনে যেতে চাইলে সেনাবাহিনী দক্ষিণ উদোলবাগান (কার্বারী টিলা) এলাকায় এদের বাঁধা প্রদান করে। এসময় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের সাথে সেনাবাহিনী-বিজিবি ও পুলিশের বাকবিতন্ডার ঘটনা ঘটে।

এসময় সন্ত্রাসীরা কোন ধরনের উস্কানী ছাড়াই সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এসময় পাহাড়ী যুবক-যুবতীরা সেনাবাহিনীকে উদ্দ্যেশ্য করে গুলতি মারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রায় ৫০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজে সেনাসদস্যদের আহত রক্তাত্ত ছবি প্রকাশিত হয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও সেনাবাহিনী সরাসরি সন্ত্রাসীদের উপর গুলি না করে ফাঁকাগুলি করেছে- এটা তাদের চরম সহিষ্ণুতা ও উচ্চ পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে।

বাংলাদেশে যখন প্রতিনিয়তই পুলিশকে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচীতে সরাসরি গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করছে, প্রকাশ্যেই পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘পুলিশের হাতে অস্ত্র হা ডু ডু খেলার জন্য নয়। আক্রান্ত হলে পুলিশ গুলি করবেই।’ উচ্চপদের পুলিশ কর্মকর্তারা অধস্তনদের গুলি করার সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছেন সেখানে আক্রান্ত হওয়ার পরও সেনাবাহিনীর সরাসরি গুলি না করা চরম সহিষ্ণুতার পরিচয় বহন করে।

রাঙামাটিতে দুই প্রশাসনিক কর্মকতার উপর সংগঠিত হামলার সাথে যেমন পাহাড়ী জনপ্রতিনিধিরা জড়িত ছিল ঠিক কমলছড়ি ও দীঘিনালার হামলার ঘটনার সাথেও জনপ্রতিনিধিরা জড়িত ছিল বলে মনে করছেন স্থানীয় বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দ। দুই হামলার ঘটনার স্থান সময় ভিন্ন হলেও উদ্দ্যেশ্য এক ও অভিন্ন বলে মনে করেন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জি: আলকাছ আল মামুন। তিনি বাঙ্গালীদের পাশাপাশি প্রশাসনের শীর্ষকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর হামলার ঘটনাকে রাষ্ট্রের অখন্ডতারর জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন এবং অবিলম্বে হামলার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনারও দাবী জানান।

মহান স্বাধীনতার মাস মার্চের শুরু থেকেই পার্বত্য রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর চিহ্নিত পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠির হামলা আর হত্যার হুমকির ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, পার্বত্যনিউজের কাছে এমনটাই দাবী করেছেন পাহাড়ের সচেতনমহল। এসব তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন চলছে তারই অংশ বিশেষ। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর সন্ত্রাসী হামলা আর হত্যা করার মতো হুমকির ফলে কঠিণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির প্রশাসনসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এর আগেও ২০১৩ সালে সরকারের প্রদানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খাগড়াছড়ি সফরের দিন গত ১১ নভেম্বর খাগড়াছীড়তে সড়ক অবরোধ কর্মসুচীর ডাক দেয় উগ্র সাম্প্রদায়িক পাহাড়ী সংগঠন চুক্তিবিরোধী ইউনাইডেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। এসময় তারা শেখ হাসিনা সরকারকে জনসমর্থনহীন, পাহাড়ি জনগণের সাথে প্রতারণাকারী ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ চাঁপিয়ে দেয়ার দায়ে অভিযুক্ত করে বেঈমান আখ্যায়িত করে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতিও প্রেরণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের দিন ১১ নভেম্বর জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্রিজের পাটাতন খুলে ফেলে এবং সমাবেশে যোগদান করতে আসা গাড়ী বহরেও হামলা চালায়।

উগ্র সাম্প্রদায়িক পাহাড়ী সংগঠন চুক্তিবিরোধী ইউনাইডেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ ও জেএসএস’র নেতৃত্বে পাহাড়ে আজ পর্যন্ত সংঘটিত কোনো চাঁদাবাজি, গুম, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি বলেই পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা আরো বেশী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখনই তাদেরকে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনা না হলে ভবিষ্যতে তাদের এ অসহিষ্ণু মনোভাব আরো বেপরোয়া ও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পাহাড়ের সচেতন মহল।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন