চুড়ান্ত ডাক্তারী পরীক্ষায় লামায় বিজিবি কর্তৃক দুই ত্রিপুরা কিশোরী ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি
লামা প্রতিনিধি:
বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের রামগতি ত্রিপুরা পাড়ায় বিজিবি কর্তৃক দুই ত্রিপুরা কিশোরীর চুড়ান্ত ডাক্তারী পরীক্ষায় ধর্ষণের অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ১৭ সেপ্টেম্বর এই ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে এসে পৌঁছেছে। এরপর রিপোর্টটি সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পুলিশের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে নাম প্রকাশ করে কেউ কোনো কথা বলতে রাজী না হলেও একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র পার্বত্যনিউজকে নিশ্চিত করেছে যে, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের ডাক্তারী পরীক্ষায় দুই কিশোরীর ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে, ধর্ষণের মামলা হবার পর পুলিশের সুপারিশের ভিত্তিতে বান্দরবান সিভিল সার্জন অংশৈপ্রু দুই কিশোরীর ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করেন। মেডিকেল বোর্ড নিরপেক্ষ ও অবিতর্কিত করার জন্য সিভিল সার্জন বোর্ডের সদস্য হিসেবে পাহাড়ী ও বাঙালী সম্প্রদায়ের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠন করেছেন। তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের সভাপতি ছিলেন, ডা. শারমিন নাহার বাশার, সদস্য হচ্ছেন, ডা. চিং ম্রা সাং ও ত্রিভা তঞ্চঙ্গা।
এরপর তাদের ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয় এবং প্রাথমিক ডাক্তারী পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে দুই কিশোরীর বয়স পরীক্ষা ও অধিকতর ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য কিছু আলামত চট্টগ্রামে পাঠানো হয় এবং একই সাথে কিশোরী দ্বয়কেও চট্টগ্রামে রেফার্ড করা হয়। এরপর দুই কিশোরী চট্টগ্রামে গিয়ে ডাক্তারী পরীক্ষা দিয়ে নিজ বাড়ী লামায় ফিরে আসে। গতকাল সেই ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট বান্দরবানে পৌঁছেছে।
- এ বিষয়ে আরো পড়ুন
♦ বান্দরবানে দুই ত্রিপুরা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে তিন বিজিবি সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা
♦ বান্দরবানের দুই ত্রিপুরা কিশোরীর প্রাথমিক ডাক্তারী পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত মেলেনি: ১ আসামী আটক
♦ লামায় কথিত দুই ত্রিপুরা কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে
অপরদিকে ধর্ষণের শিকার এক ভিকটিম ত্রিপুরা কিশোরী বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আলী আক্কাস এর নিকট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে আদালতকে উক্ত ত্রিপুরা কিশোরী জানায়, জনেরুং আমাদের দুইজনকে বলে তোমাদেরকে বিজিবির লোকেরা যেতে বলেছে। আমরা যেতে পারব না বলি।
জনেরুং আমাদের দুইজনকে যাওয়ার জন্য বলে। আমরা রাত ১০.৩০ ঘটিকার সময় বিজিবির সাথে দেখা করতে যাই। সুমন ও মারুফের সাথে আমাদের দেখা হয়। মারুফ আমার হাত ধরে বলে যে, তোমাদেরকে যেতে দেব না। আমাদের টাকা যাচনা করে। আমরা রাজি না হলে মারুফ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমাকে ধর্ষণ করে এবং সুমন অন্যজনকে ধর্ষণ করে। আমরা ভয়ে চিৎকার করিনি।
আমাদের গ্রামের লোকজন আসলে রবিউল চিৎকার করে গ্রামের লোকজনকে আসার কথা সুমন ও মারুফকে জানায়। আমরা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি। সারারাত আমরা জঙ্গলে ছিলাম। সকালে বাড়ি যায়। গত ২৭ আগষ্ট ২০১৮ এই জবানবন্দী প্রদান করেন।
কিন্তু কিশোরীদের এই দাবী অস্বীকার করেছে এ মামলার এজাহার নামীয় ৪নং আসামী গৃহবধূ আটক জনেরুং ত্রিপুরা (২৮)। তিনি আদালতকে জানিয়েছেন, সে ধর্ষণ মামলায় এজাহার নামীয় তিন বিজিবি সদস্যকে চিনে না এবং বিজিবির লোকদের সাথে তার কোন পরিচয় নেই।
বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আলী আক্কাস এর আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দী প্রদানকালে জনেরুং ত্রিপুরা আদালতকে আরো জানায়, গত ২২ আগস্ট ২০১৮ সন্ধ্যা ৭ টায় রূপতি ত্রিপুরা ও হারমতি ত্রিপুরা আমার বাসায় এসে আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক আমার মোবাইল নিয়ে যায়। তারা কার সাথে মোবাইলে কথা বলে আমি জানি না।
বিজিবি এর লোকদের সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। ওরা মোবাইলটি আমাকে ফেরত দেয়নি। আমার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমার শশুর ও শাশুড়িকে জানাই।
ত্রিপুরা দুই কিশোরী ধর্ষণ মামলায় পুলিশ এজাহার নামীয় আসামী জনেরুং ত্রিপুরাকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে। মামলার এজাহারে ধর্ষিতা কিশোরী দাবী করেছে জনেরুং ত্রিপুরার সহায়তায় বিজিবির ২ সদস্য তাদের দুইজনকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে।
বিজিবি বান্দরবান সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল ইকবাল হোসেন পার্বত্যনিউজকে বলেন, অভিযোগটি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। মামলা হয়েছে, পুলিশ তদন্ত করে তাদের মতো করে ব্যবস্থা নেবে। তবে আমরাও বিষয়টি অভ্যন্তরীণভাবে গুরুত্বের সাথে তদন্ত করেছি। এ পর্যন্ত আমরা বিষয়টি তদন্তে অনেক অসংলগ্ন ও পরস্পর বিরোধী তথ্য পেয়েছি। আমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে বিজিবির নাইক্ষ্যংছড়ি জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল আসাদুজ্জামান পার্বত্যনিউজকে জানান, রবিউল ইসলাম, ফারুক ও সুমন নামে কোন বিজিবি সদস্য ত্রিশডেবা বিজিবি ক্যাম্পে কর্মরত নেই। বিজিবির ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে কেউ ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্তৃপক্ষ নিয়ম মোতাবেক কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। ত্রিশ ডেবা বিজিবি ক্যাম্পের ব্যপারে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দীর্ঘ দিন থেকে অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে বলেও তিনি জানান।
তিনি আরো বলেন, ত্রিশডেবা ক্যাম্প সরানোর জন্য অনেক ষড়যন্ত্র চলে আসছে। ক্যাম্প না থাকলে পাহাড়ী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায় কোন বাধা থাকবে না। সে কারণে সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠী ত্রিশডেবা বিজিবি ক্যাম্পের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালিয়ে আসছে। ঘটনার বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। যদি তদন্তে সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সাজানো ঘটনা হলে এটি নিন্দনীয় ঘটনা।
এদিকে মামলা সংশ্লিষ্ট একজন আইনজীবী জানিয়েছেন, মামলার এজাহারের সাথে ভিকটিমগণের ২২ ধারা জবানবন্দী এবং জনেরুং ত্রিপুরার ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর মধ্যে সাংঘর্ষিক ও গড়মিল রয়েছে। ২২ ধারার জবানবন্দী মতে, ত্রিপুরা কিশোরীগণ নিজ ইচ্ছায় রাতের ১০.৩০ ঘটিকায় বাড়ি থেকে বের হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার বিষয়টি তারা পরিবারের লোকজনকে জানায় নি। রাতের বেলায় দুইজন কিশোরী বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যদের না জানিয়ে বের হওয়ার বিষয়টি প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
আসামীপক্ষের কেউ জোরপূর্বক ভিকটিমদেরকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে নেয়নি। আবার কেহ তাদেরকে বাড়ি থেকে বের হতে বললেও ভিকটিমগণ কেন পরিবারের সদস্যদের জানায়নি সেখানেও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। রাতের বেলায় দুই কিশোরী পরিবারের লোকদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে কতটুকু তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলা যায় সে বিষয়ে প্রশ্নের উদয় হয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসী লুৎফুর রহমান, মনির উদ্দিন ও আবুল কালাম পার্বত্যনিউজকে জানান, একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন থেকে বনফুর বিজিবি ক্যাম্প প্রত্যাহার করার জন্য ষড়যন্ত্র করে আসছে। পাহাড়ী উক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বনফুর ক্যাম্প প্রত্যাহার হলে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারবে। তাদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেই এই ঘটনার জন্ম দিয়েছে। হতে পারে তারাই বিজিবির পোশাক পরে তার নাম ধরে বিজিবিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে।
ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার জানান, বনফুর ত্রিশডেবা বিজিবি ক্যাম্প হইতে এক থেকে দেড় কিলোমিটার দুরে জন সম্মুখ দিয়ে গিয়ে পোশাক পরিহিত লোকজন ধর্ষণ করার বিষয়টি আমার বোধগম্য হচ্ছে না। বনফুর বাজারে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যদের ওদিকে যাওয়ার কথা নয়। এখানে যে কোন ধরণের ষড়যন্ত্র রয়েছে।
উল্লেখ্য, উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের রামগতি ত্রিপুরা পাড়ার দুই ত্রিপুরা কিশোরী ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ এনে লামা থানায় ৩ বিজিবি সদস্য ও সহায়তার জন্য এক ত্রিপুরা নারীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১)/৩০ ধাারায় মামলা দায়ের করেছে।
মামলায় ত্রিপুরা নারী জনেরুং ত্রিপুরাকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।