২০১৮তে বাংলাদেশ হারালো এক বিশ্বমানের সংগীত কিংবদন্তিকে
বিনোদন ডেস্ক:
মাত্র দুদিন আগেও কনসার্টে দাড়িয়ে গিটারের জাদুতে যিনি মাতাচ্ছিলেন উত্তরবঙ্গের রংপুরবাসীকে, তখন কি কেউ জানতো দুদিন পরেই বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গিতের এই কিংবদন্তির দেহ নিথর হয়ে যাবে? চীরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে যাবেন মাটির ঘরে।
জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে যিনি সব সময় কাছে রাখতেন গিটার। গেয়েছেন “এই রূপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে, বহূ দূরে…” গান । ১৯৬২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ বছরে তার হাতের ছোয়া লাগানো ৬২ টি গিটারের অবস্থান হতে চলেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে।
কালের পরিক্রমায় এভাবেই বিদায় নিতে হয় একেকজন কিংবদন্তিকে।
দিনটি ছিল বৃস্পতিবার(১৮ অক্টোবর ২০১৮)। সকাল ১০টার কিছু পরেই রাজধানীর পান্থপথ স্কয়ার হাসপাতালের ডাক্তার এই তারকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার খবর নিশ্চিত করেন । তাঁর আকস্মাৎ মৃত্যুতে হতবাক হয়ে গেছেন তার ভক্ত-অনুরাগী ও সহকর্মীরা।
যিনি গান নিয়ে সব সময় মেতে থাকতেন, মানুষকে মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর এভাবে হটাৎ চলে যাওয়ার ব্যাপারে সবারই হয়ত একটু জানবার ইচ্ছা হয়।
স্কয়ার হাসপাতালের সার্ভিস বিভাগের পরিচালক ড. মির্জা নাজিমুদ্দিন জানালেন, আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ৮টার দিকে তাঁর নিজ বাসাতেই। উনি হার্টের রোগী। তাঁর হার্টের রিদমটা কমে গিয়েছিল। সেই রিদম হঠাৎ বন্ধ হয়ে হয়ে গেলে সকালেই তিনি মারা যান।
ডাক্তার বলেন, মৃত অবস্থাতেই তাকে ড্রাইভার হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তাকে নিয়ে পৌঁছানো হয় ৯টা ১৫ মিনিটে। ডাক্তাররা তাকে ৯টা ৫৫ মিনিটে মৃত ঘোষণা করেন।
আইয়ুব বাচ্চুর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সাউন্ড ইঞ্চিনিয়ার মইনুদ্দিন রাশেদ জানিয়েছেন, তাঁর সহকারী সকালে মগবাজারের বাসায় গিয়ে তাকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
মৃত্যুর সময় তিনি দুটি সন্তান রেখে যান। মেয় ফায়রুজ সাফা অস্ট্রেলিয়া ও ছেলে আনাফ তাজওয়ার আইয়ুব থাকেন কানাডাতে। তাঁর ছেলে মিউজিক নিয়েই পড়াশুনা করছেন। তবে মৃত্যুকালে বাচ্চুর পাশে স্ত্রী-সন্তান কেউ ছিলেন না। স্ত্রী চন্দনাও সন্তানদের কাছে বিদেশে বেশিরভাগ সময় কাটান। ফলে আইয়ুব বাচ্চু একাকী জীবন কাটাতেন। গানে গানে মাতিয়ে রাখা এই মানুষটিকে বাইরে থেকে না বুঝা গেলেও এখন শোনা যাচ্ছে তিনি কতটা অসুস্থ ছিলেন। একাকিত্ব জীবন আর নিজের সমস্ত পরিশ্রম গিটারের ভালোবাসায় ঢেলে দিয়ে নিজের জন্য খুব কমই রাখতে পেরেছেন তিনি।
শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহ সকলের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেওয়া হয়। সকালে থেকেই তার অসংখ্য ভক্ত এবং সর্বস্তরের গানপ্রিয় মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভীর করেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এরপর সেখান থেকে তার মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় ইদগাহ ময়দানে। সেখানে বাদ জুমা হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের অংশগ্রহনে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাজা শেষে তার মরদেহ মগবাজারে তাঁর নিজস্ব স্টুডিও এবি কিচেনে নেওয়া হয়। শুক্রবার বিকেলে ৩টার দিকে মগবাজার কাজী অফিস গলির মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, মগবাজার লেনে প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে বসবাস করছেন বলে বলে জানা যায়। মগবাজার থেকে তৃতীয় নামাজে জানাজার জন্য আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেওয়া হয় তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আইয়ের ভবনে। চ্যানেল আইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁর মরদেহ আবারও স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে নিয়ে রাখা হয়।
এদিকে শুক্রবার দিবা গত রাত প্রায় ১টার দিকে তাঁর ছেলে এবং মেয়ে দেশে পৌঁছান। বিমানবন্দর থেকে তাদের সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে। এ সময় আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার সঙ্গে ছিলেন। ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় চট্টগ্রামে। সেখানে শনিবার বেলা প্রায় ১১টার দিকে তার মরদেহ গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দিন।
সেখান থেকে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নানার বাড়ি দক্ষিণ পূর্ব মাদারবাড়িতে। আইয়ুব বাচ্চুর নানার বাড়ির সামনে তাঁর ছেলে আহনাফ তাজোয়ার সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বলেন, আমার বাবা অজানাবশত কোনো দোষ করে থাকলেও মাফ করে দিবেন। আপনাদের কাছে শেষ কথা, আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। আমার বাবা বলতেন তিনি আপনাদের সর্বোচ্চটা দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি সংগিতের মাধ্যমে মানুষকে খুব ভালো বাসতেন। তিনি আপনাদের অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছেন। তিনি অনেক করেছেন।
মাদারবাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে। বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সেখানে তাঁর কফিনে সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা নিবেন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষ জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদের মাঠে ৪র্থ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তাঁর জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে।
৪র্থ জানাজা শেষ মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম নগরীর চৈতন্য গলি কবরস্থানে। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে সেখানেই মায়ের কবরের পাশেই সমাহিত হন কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু।
পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে, আইয়ুব বাচ্চুর গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার খরণা ইউনিয়নে হলেও তিনি ছোটকাল থেকে বড় হয়েছেন চট্টগ্রাম শহরে। নগরীর ফিরিঙ্গী বাজার ও এনায়েত বাজারে তাদের বাড়ি থাকলেও তিনি থাকতেন মাদারবাড়ীর নানার বাড়িতে।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট বাচ্চু জন্মেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চট্টগ্রামে। তিনি শুধু গিটার বাজাতেন বা গান করতেন তা নয়। তিনি গান লিখতেন এবং সুরও করতেন। জীবন-মৃত্যুর নানা দর্শন তাঁর গানের কথায় প্রকাশ পেয়েছে।
মূল শিল্পী হয়ে আত্মপ্রকাশ করার আগে তিনি দশ বছর সোলস ব্যান্ডের সাথে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সংগীত জগতে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ফিলিংসের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে। তাঁর কণ্ঠ দেওয়া প্রথম গান “হারানো বিকেলের গল্প”। গানটির লেখক শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ভক্তদের নিকট তিনি সংক্ষেপে এবি(AB) নামেও পরিচিতি। খুব কাছের মানুষ তাকে ‘রবিন’ নামেও চিনত। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত রক্তগোলাপ আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। তাঁর সফলতার শুরু তাঁর দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ময়না(১৯৮৮) এর মাধ্যমে।
১৯৯১ সালে বাচ্চু এলআরবি বিখ্যাত ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডের সাথে তার ব্যান্ড এলবাম এলআরবি গঠন হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম।
শখের বসে আইয়ুব বাচ্চু অভিনয়ও করতেন। ২০১০ সালে ঈদের জন্য নির্মিত ট্রাফিক সিগন্যাল ও হলুদ বাতি শিরোনামের নাটকে অভিনয় করেন তিনি।
ছোট লেখায় আইয়ুব বাচ্চুকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। আধুনিকতার জগতে বিদেশি ভাষা কিংবা বিদেশি সংস্কৃতিকে না ছুয়েও বাংলা ভাষাকে লালন করে কীভাবে মানুষকে মাতিয়ে তোলা যায়, তার অন্যতম নিদর্শন এই কিংবদন্তি। তাঁর গিটারের জাদুতে তিনি বাংলা গানকে যেভাবে সাজিয়েছেন তা বিশ্বের যে কোনো গানের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।