হিংসায় জ্বলছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ফল ও ফসল

সম্ভাবনার পাহাড়- ৫

আগুনে পোড়া বাগান

জাহিদুল ইসলাম, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে:

রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় তিন একর জমি লিজ নিয়ে আনারস চাষ করেছেন বাঙালি কৃষক মধু মিয়া। বাড়ন্ত আনারস দেখে মধু মিয়ার আনন্দ ধরে না। ফসল বিক্রি করে দেনা পরিশোধের পরও বড় অঙ্কের লাভের স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। তার এ আনন্দ পুড়ে ছারখার হয়েছে প্রতিহিংসার আগুনে। ১০ ডিসেম্বর রাতে দুর্বৃত্তরা তার বাগানের সব আনারস কেটে ফেলে। ৮২ হাজার আনারস নষ্ট হওয়ায় গরিব এই চাষির আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৫ লাখ টাকা। কয়েক লাখ টাকা দেনার দায় নিয়ে পথে বসেছেন গরিব মধু মিয়া।

এ ঘটনার কয়েকদিন পর একই এলাকার মইনুল হোসেনের বাগানের ৪৫ হাজার আনারস চারা রাতে কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ভুক্তভোগী মইনুল হোসেন ও মধু মিয়ার সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নেই বলে তারা দাবি করছেন। তারা জাতীয় বা স্থানীয় কোনো রাজনীতিতেও জড়িত নন। ভূমির মালিকানা নিয়ে জাতিগত বিরোধের কারণে এভাবে ফল ও ফসল অনিষ্ট করা হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। পাহাড়ের উপজাতীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এমন কাজ করছে বলে ধারণা স্থানীয়দের। তবে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় এসব ঘটনায় কেউ শাস্তির আওতায় আসছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আমলের ৪৫ বছরেও পার্বত্য এলাকায় ভূমির সার্ভে হয়নি। বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধনী এনেছে। এ সংশোধনী নিয়েই পাহাড় উত্তাল হয়ে উঠেছে। ঘুরে গেছে রাজনীতির মোড়। উপজাতি জনগোষ্ঠীগুলো নতুন কমিশন আইনকে স্বাগত জানিয়েছে। বাঙালি জনগোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। এতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।

GARDEN-PIC-copy-300x215

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ভূমির মালিকানা নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। ১৯৮০ সালের পর পাহাড়ে ব্যাপক হারে বাঙালি পুনর্বাসনের পর এ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। সন্তু লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির পর অস্থিরতা কমে আসার কথা থাকলেও জেএসএস ভেঙে একটি অংশ সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে যায়।

১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) মূলধারার রাজধানীতির পাশাপাশি সামরিক শাখা পরিচালনা করে থাকে। এসব আঞ্চলিক সংগঠনের মদদে পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি নিয়ে বিরোধ চলমান রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। এ বিরোধের কারণেই ফল ও ফসল নষ্ট করা হচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ২ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ছয় লাখ গাছ কেটে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। এগুলোর সবই বাঙালিদের। এর কোনোটির পেছনে রয়েছে বাঙালি-উপজাতি ছেলেমেয়ের প্রেম বা বিয়ে, কোনোটিতে চাঁদা না দেয়া। ১৪ নভেম্বর খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ময়ূরখিলে ৮৪টি মশলা গাছ ও ৪টি আম গাছ কেটে ফেলে উপজাতি সন্ত্রাসীরা।

এদিন রামগড়ে যৌথ খামারে আড়াই হাজার পেঁপে গাছ, ৬০০ কলা, ৩০টি লিচু ও ২০টি লেবু গাছ, ২৮ আগস্ট বান্দরবানের আলীকদমে গাজী রাবার বাগানের ৬৯৩টি রাবার গাছ, ২৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির সিন্দুকছড়িতে কর্নেল বাগানে ২০০ ফলের গাছ, ২৫ জানুয়ারি বান্দরবানের আলীকদমে ১ হাজার ৯৬৭ রাবার গাছ ও ৭টি আম গাছ কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। আগের বছর ১৩ আগস্ট খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ির রেপাতলীতে ২০ হাজার রাবার গাছ ও ৫০টি কলা গাছ এবং ১১ জানুয়ারি রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার জামতলীতে ৩৫ হাজার আনারস গাছ কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা।

২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর একই উপজেলার বগাছড়িতে ৩ লাখ ফলন্ত আনারস গাছ ও ২১ হাজার সেগুন গাছ কেটে ফেলা হয়। নির্ধারিত চাঁদা না দেয়ায় গত বছর বান্দরবানের লামা উপজেলায় একটি রাবার বাগানের গোডাউন পুড়িয়ে দেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এরপরও চাঁদা না দিলে পুরো বাগান পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।

রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার সাঈদ তরিকুল হাসান বলেন, প্রায়ই রাতের বেলায় ফসল পুড়িয়ে দেয়া ও গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ পাওয়া যায়। অন্ধকারে কারা এমনটা করছে, তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। এসব অপকর্মে সন্দেহভাজন জড়িতদের অনেক সময় আটক করা হয়। তবে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তারা ছাড়া পেয়ে যায়।

পাহাড়ে ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আইনের ৬(গ) ধারায় ‘ভূমি’র পরিবর্তে ‘যে কোনো ভূমি’ শব্দগুলো জুড়ে দেয়ায় তিন পার্বত্য অঞ্চলের যে কোনো জমি পাহাড়িরা নিজের দাবি করতে পারবে। ফলে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিরা ভূমিহীন হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন। বাঙালি নেতারা বলছেন, এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিভেদটা আরও উসকে দেয়া হয়েছে।

তারা বলছেন, ২০১০ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে অবৈধ ঘোষণা করে। অথচ সরকার সেই আঞ্চলিক পরিষদের কথামতোই আইন সংশোধন করেছে।

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসারপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহীম বীরপ্রতীক বলেন, পার্বত্য এলাকায় রাজনৈতিক প্রয়োজনে এর আগে সরকারের দেয়া ভূমি বন্দোবস্ত সংশোধনীতে অবৈধ বলে স্বীকার করা হয়েছে। ভূমির মালিক পাহাড়ি জনগণ, বাংলাদেশ সরকার। দেশের আইন মোতাবেক অন্য নাগরিকরা জমির মালিকানা পাওয়ার অধিকার রাখেন বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন