সর্বস্ব হারিয়ে টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসা এক রোহিঙ্গা নারীর আর্তনাদ
টেকনাফ প্রতিনিধি:
টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সর্বস্ব হারানো অনুপ্রবেশকারী এক রোহিঙ্গা নারীর আর্তনাদ আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। নারীটি হলেন মিয়ানমার আরকান রাজ্যের উত্তর জামবইন্যা জামাল হোসেনের স্ত্রী ৩ সন্তানের জননী নুর বেগম (২৪)। শীত ও অনাহারে অসহায় মায়ের কোলেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা সাড়ে ৫ মাস বয়সী শিশু জানে আলমের মা।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে (স্থানীয় ভাষায় টাল) রবিবার সকালে সরেজমিন পরিদর্শনকালে কথা হয় তার সাথে। বর্ণণা দেন মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারের লোমহর্ষক ঘটনা। তিনি বলেন স্বামী জামাল হোসেন (৩০), ৩ শিশুপুত্র মোঃ হাশিম (৫), জাফর আলম (৩) এবং সাড়ে ৫ মাস বয়সী শিশু জানে আলমকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল। গত মাসে বিজিপি ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার পর আরাকান রাজ্যের মুসলমানদের উপর নেমে আসে অবর্ণণীয় নির্যাতন। মুসলমানদের গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। চোখের সামনে ২ শিশুপুত্র মোঃ হাশিম (৫), জাফর আলমকেও (৩) পুড়িয়ে মারা হয়েছে। স্বামী জামাল হোসেনকে মিয়ানমার বাহিনী ২০ দিন আগে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। এমনকি চোখের সামনে মাঠে আগুন জ্বেলে পুরুষদের ধরে আগুণে ফেলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে নিকট আত্মীয় (মামা, খালু, ভাই, চাচা) নুরুল আলম, জাফর, মোঃ সেলিম, শামসুল আলম, আবুল কালাম, ইউসুফ, সোনা মিয়া, ছৈয়দ আহমদ, মোঃ হাসিম, গনু মিয়া, আবুল বশর, মুজিবুর রহমান, আবুল কাসেম, ইসমাইল, ওসমানসহ ৩০ জনকে। মহিলাদেরকে ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।
মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে প্রাণ বাঁচাতে একমাত্র শিশুপুত্র সাড়ে ৫ মাস বয়সী জানে আলম ও অবিবাহিত এক বোনকে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে বনে-জঙ্গলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২০ জনের দলটি টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উঞ্চিপ্রাং ঘাট দিয়ে গভীর রাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে সময় লেগেছে ১৫ দিন। বাংলাদেশে ঢুকে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে (স্থানীয় ভাষায় টাল) আশ্রয় নিয়েছে ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায়। গভীর রাতে শীত ও অনাহারে মায়ের কোলেই বিনা চিকিৎসায় মারা যায় জানে আলম। রোহিঙ্গা নারী অসহায় মা নুর বেগম আরও জানান অর্ধাহারে-অনাহারে বনে-জঙ্গলে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। অনাহারে শিশুটি কঙ্কালসার হয়ে যায়। উপরন্ত ছিল তীব্র শীত। সাথে কোন গরম কাপড়ও ছিলনা। চিকিৎসা করারও সুযোগ হয়নি। কোলেই বিনা চিকিৎসায় শিশুটি মারা যায়। একাধারে ৩ দিন অনাহারে থাকার পর এখানে এসে ভাত খাওয়ার পর বুকে সামান্য দুধ আসলে শিশুটি মৃত্যুর আগে যৎসামান্য দুধ পান করেছিল।
নুর বেগম বর্তমানে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (অনিবন্ধিত) ‘এ’ ব্লকের একটি বাসায় আশ্রয়ে রয়েছেন। বাসার মালিক জুলেখা বেগম বলেন ক্যাম্পের বাইরে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্রীক ফিল্ডের পাশে কঙ্কালসার শিশুসহ এক মহিলাকে দেখে দয়াপরবশঃ হয়ে মানবিক কারণে এনে আশ্রয় দিয়েছি।
অসহায় এ মহিলা আরও জানান, তার মতো আরও অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বহু কষ্টে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তম্মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশী। অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে ধর্ষিতা নারীর সংখ্যাও কম নয়। পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে ও পুড়িয়ে মেরে ফেলায় মুসলমানদের গ্রামে পুরুষ শুন্য হয়ে পড়েছে।