সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সামাজিক সম্প্রীতিও নষ্ট করছে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা

অস্থির পাহাড় দিশেহারা মানুষ-৩

bilaichori_inner

আবু সালেহ আকন, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ফিরে:

গত ২৯ মে’র ঘটনা। ১৭ বছরের চাকমা জরুরি কাজে বাঙালি যুবকের দোকানে ঢুকেছিল। এতে ক্ষেপে যায় সন্তু লারমার পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) সদস্যরা। টেনে হিঁচড়ে ওই কিশোরীকে বের করে আনা হয় দোকান থেকে। এরপর প্রকাশ্যেই কিশোরীটিকে নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। মাঠের মধ্যে হ্যান্ডবলের মতো এ-হাত ও-হাত বদল হয়। এরপর কিশোরীটির হাত ও চোখ বেঁধে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখানে তার জামাকাপড় খুলে ছবি তোলা হয়।

অনেকেই বলেছেন, কিশোরীটি সেখানে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। যদিও মামলার এজাহারে তা উল্লেখ করা হয়নি। এভাবে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাে র সাথে সামাজিক সম্প্রীতিও নষ্ট করছে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো।

একই মাটির মানুষ হয়েও তাদের কাছে বাঙালিরা যেন একেবারেই নিচু জাত। প্রেম, ভালোবাসা আর বিয়ে দূরে থাক বাঙালিদের সাথে মেলামেশা করলেও পাহাড়িদের শাস্তি দেয় এই সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। কোনো পাহাড়ি তরুণী বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করলে তার সর্বনিম্ন শাস্তি গণধর্ষণ। ওই তরুণীকে নিলামে তোলার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

এভাবেই বছরের পর বছর বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। যদিও সাধারণ পাহাড়িরা এর বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের কাছে তারা একেবারেই অসহায়।

ওপরের ঘটনাটি ঘটেছে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে। কলেজে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে বাঙালি যুবক শিহাবের দোকানে গিয়েছিল ওই চাকমা কিশোরী। কেন সে বাঙালির দোকানে ঢুকল এই অপরাধে তাকে স্থানীয় পিসিপির অর্থ সম্পাদক সুনীতিময় চাকমার নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী দোকান থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে।

দোকানি শিহাব জানান, তরুণীকে তার দোকানের ভেতরেই মারধর করা হয়। এরপর পাশের হাসপাতাল মাঠে কিশোরীটিকে মারধর করে সন্ত্রাসীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, কিশোরীটির অবস্থা এমন হয়েছিলে যেন সে একটি হ্যান্ডবল। পিসিপির সন্ত্রাসীরা গোল হয়ে একজন ধাক্কা দিয়ে অন্যজনের কাছে দেয়, আবার সে ধাক্কা দিয়ে আরেকজনের কাছে দেয়। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পরে কিশোরীটিকে নিয়ে তারা কেরণছড়ির জঙ্গলে যায়।

ওই কিশোরীর অভিযোগ, তার জামাকাপড় খুলে ছবি তুলেছে সন্ত্রাসীরা। তার ওপর যৌন নির্যাতনও চালিয়েছে। ছেড়ে দেয়ার পর অসুস্থ অবস্থায় সে তার মাকে নিয়ে স্থানীয় গাছকাটাছড়ি সেনা ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় চায়। পরে সেখান থেকে ওই কিশোরীকে বিলাইছড়ি থানায় পৌঁছে দেয়া হয়।

এ ঘটনায় বিলাইছড়ি থানায় পিসিপির সুনীতিময় চাকমা, পুলক চাকমা, মানিক চাকমা, নেনসন চাকমা, কৃষ্ণসুর চাকমা, সুজয় চাকমা ও বীর উত্তম চাকমার নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ১৫-২০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে ওই কিশোরী। এ ঘটনায় সুনীতিময় চাকমাকে (৩০) গত ১৪ জুন আটক করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। এ দিকে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটালেও পিসিপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সুনীতির গ্রেফতারের প্রতিবাদে দুই দিন হরতাল পালন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু গ্রুপ)। ১৫ ও ১৬ জুন পাহাড়ে হরতাল পালন করা হয়।

গত ২১ জুন বিলাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মঞ্জুরুল আলম মোল্লা বলেন, তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় সুনীতিময় চাকমাকে রিমান্ডে নেয়া হবে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ জানায়। পুলিশ বলেছে, পিসিপি নেতাকর্মীদের বক্তব্য হলো, ওই কিশোরীর সাথে শিহাবের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই তাকে ওই দোকান থেকে বের করা হয়েছে।

তবে মা মোবাইল সেন্টারের মালিক শিহাব জানান, তার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। ওই চাকমা কিশোরীর সাথে তার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।

এ দিকে সুনীতিকে গ্রেফতারের পর ১৪ জুন থেকে দোকানটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হন শিহাব। দোকানঘরের মালিক সুশীল চাকমার নির্দেশেই তিনি দোকানটি বন্ধ রেখেছেন।

সুশীল চাকমার সাথে কথা বললে তিনি জানান, ওই মেয়েটির সাথে শিহাব অসামাজিক কার্যকলাপ করছিল, এ জন্যই দোকানটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এর আগে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে ভালোবেসে এক বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে খাগড়াছড়ির গুইমারার উমাচিং মারমা (১৮) নামে এক মারমা তরুণী ও তার পরিবারকে নির্যাতন ভোগসহ বিপুল অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। তাকে একটি কে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতনও করা হয়।

গত বছরের এপ্রিলে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় ত্রেলাল ত্রিপুরার মেয়ে দীপা ত্রিপুরা (১৮) ভালোবেসে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখেছিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার আহমদ কবীরের ছেলে মো: আবদুল হান্নানের (২৪) সাথে। প্রেমিক হান্নানের হাত ধরে পালানোর সময় বাস থেকে নামিয়ে দীপা ত্রিপুরা ও হান্নানকে অপহরণ করে পিসিপির কর্মীরা। অপহরণের পর একটি জুম ঘরে আটক করে দীপা ত্রিপুরাকে গণধর্ষণ করে পিসিপির স্থানীয় কয়েকজন নেতাকর্মী। একাধিকবার গণধর্ষণের পর গভীর রাত পর্যন্ত দীপা ত্রিপুরাকে নিয়ে উল্লাস করে এসব সন্ত্রাসী। পুরো গণধর্ষণের দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করা হয়। এ ঘটনায় আটক ইউপিডিএফ সমর্থিত পিসিপির নেতা সজীব ত্রিপুরা(২২) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানায়।

এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ছেলেকে ভালোবেসে মাটিরাঙার সোনাবি চাকমা, রাঙামাটির কুতুকছড়িতে রিনা ত্রিপুরা, রামগড়ের মণিকা ত্রিপুরাসহ এ রকম অসংখ্য পাহাড়ি মেয়েকে অপহরণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন নারকীয় অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়েছে।

রাঙামাটির বিলাইছড়ির কেরণছড়ি মৌজা কার্বারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অংচাখই কার্বারী জানান, বাঙালি দোকানে যাওয়ায় বিলাই ছড়িতে চাকমা তরুণীকে মারধর করা হয়েছে বলে জানি। তবে ধর্ষণ করেছে কিনা বলতে পারব না। কোনো পাহাড়ি মেয়ে বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করলে উপজাতিদের সামাজিক নিয়মে কোনো শাস্তির বিধান নেই। তবে আমরা এ ক্ষেত্রে কার্বারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাধারণত ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে থাকি। এরপর তাদের একত্রে বসবাসে সমস্যা নেই।

স্থানীয়রা বলেন, এভাবে পুরো পাহাড়েই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। কোনো উপজাতি তরুণী বাঙালি ছেলের সাথে কথা বললেও তার ওপর নির্যাতন নেমে আসে।

বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক প্রহর কান্তি চাকমা বলেন, সম্প্রতি উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা নারায়ণের দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তার দোকানে তরুণীরা যায় বলে। জানা গেছে, নারায়ণের দোকানে প্রসাধনী বিক্রি হতো। আর এর বেশির ভাগ ক্রেতা ছিল তরুণী।

যাদের মধ্যে উপজাতি তরুণীরাও ছিল। উপজাতি তরুণীরা কেনো ওই দোকানে যায় এ জন্য দোকানটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

এ দিকে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের এই কর্মকাে র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা। গত ২২ জুন বুধবার রাঙামাটি রিজার্ভ বাজার বাস স্টেশন মোড়ে ‘ধর্ষকদের’ দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ঐক্য পরিষদ।

এ সময় বক্তারা অভিযোগ করেন, সন্তু লারমার মদদে জেএসএস ও পিসিপি পাহাড়ে চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ও জাতি বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। পাহাড়ে এই অশান্তি সৃষ্টির বিষয়ে কথা বলার জন্য সন্তু লারমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। তার অফিসেও যোগাযোগ করে সংযোগ পাওয়া যায়নি।

জেএসএস মুখপাত্র ও সহপ্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার মোবাইলেও ফোন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।

– সূত্র: নয়াদিগন্ত

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন