শান্তিচুক্তির এক যুগ: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

 শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর

মেহেদী হাসান পলাশ
আজ ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির এক যুগ পুর্তি হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভরন পদ্মায় জাতীয় সংসদের তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও পার্বত্য জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার মধ্যে এই ঐতিহাসিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়। শুরু থেকেই এই চুক্তি বাংলাদেশের বহুল আলোচিত-সমালোচিত চুক্তিগুলোর একটি হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র সমর্পনের দিন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পার্বত্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর একটি অংশ খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে কালো পতাকা প্রদর্শন করে চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এই চুক্তির ফলে দেশের এক-দশমাংশ ভূ-খণ্ডের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে বলে তৎকালীন বিরোধী দল একে কালোচুক্তি আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে হরতাল, অবরোধ, বিশাল লংমার্চসহ ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। এসব আন্দোলন কর্মসূচীতে বহু লোক হতাহত হয়। আর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালীদের দাবী এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে, ফলে তারা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে পড়েছেন। দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীগণ পার্বত্য চুক্তিকে শুরু থেকেই সংবিধান বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে দুটি মামলা করা দায়ের করা হয়েছে- বর্তমানে যার শুনানী চলছে। এদিকে পার্বত্য চুক্তির বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলার শুনানী চললেও সরকার এই দিনটি ব্যাপক আকারে উৎযাপনের নির্দেশ দিয়েছে। দেশের গণমাধ্যম ও সচেতন মহলেও এই চুক্তি বাস্তবায়ন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে শুরু হয়েছে নানামুখী মূল্যায়ন।

শান্তি চুক্তির বৈধতা, সাংবিধানিক বিতর্ক, জেএসএস বা সন্তু লারমা পার্বত্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে কিনা এসব বিতর্ক এড়িয়েও বলা যায়, এ চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সন্ত্রাসী ও দুর্ধর্ষ গেরিলাদের একটি বড় অংশকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের যুঝমান পরিস্থিতি চুক্তির আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে যে কোনো মাপকাঠিতে তা অস্বীকার্য। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক ও পর্যটন খাতের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, যেকোনো বৃহৎ কাজের শুরুতে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকে। সে অর্থে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতিসহ পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে একটি ‘গুড বিগিনিং’ বা ‘শুভারম্ভ’ বলা যায়।

অন্যদিকে চুক্তি বিরোধীদের বক্তব্য, চুক্তি সাক্ষরকারী জেএসএস নেতা সন্তু লারমা যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের বড়জোর হাজার পাঁচেক সন্ত্রাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামমের সাধারণ পাহাড়ী-বাঙালীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তেমনি হাসানাত আবদুল্লাহও বাংলাদেশ রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ মাত্র। কাজেই চুক্তি ও এর স্বাক্ষর প্রক্রিয়া পুরোটাই অবৈধ। চুক্তির বিভিন্ন ধারাগুরো যেমন বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। তেমনি চুক্তির ফলে উপজাতীয় বাসিন্দা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের হাতে এমন সব ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে যাতে একদিকে সেখানে বসবাসরত বাঙালীরা নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন বোধ করছে, তারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কাছে রাষ্ট্র, জাতীয় সংসদ ও সংবিধানের সার্বভৌমত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব হেয় করা হয়েছে। আবার পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহার করা হলে সম্পদ, সম্ভাবনা, সন্ত্রাস, আঞ্চলিক ও বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম যে গুরুত্ব ও হুমকির মধ্যে অবস্থিত তা বিপন্ন হবে।

১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও তৎকালীন বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খুব বেশী এগিয়ে নিতে পারেনি। কিন্তু ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে তারা ক্ষমতায় গেলে পার্বত্য শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন করবে। নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিতে সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী সরকার ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগ্রেড ও ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। মাত্র ৪ টি সেনা ক্যাম্প ছাড়া সরকারের এ ঘোষণা প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে। ভূমি সমস্যার সমাধানে সরকার একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ভূমি কমিশন গঠন করেছে। পূনর্গঠিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় শরণার্থী বিষয়ক টাস্ক ফোর্স।

পার্বত্য চুক্তিকে দেশ বিক্রির চুক্তি আখ্যা দিয়ে ক্ষমতায় গেলে চুক্তি বাতিল করা হবে বলে আন্দোলন করলেও বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে, যে কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মদ। বিএনপি সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এলজিইডি, ধর্ম ও সমাজ কল্যাণের মতো ১২টি অধিদপ্তরের কার্যক্রম আঞ্চলিক পরিষদের কাছে হস্তান্তর করে। চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের বর্তমান জিওসি মেজর জেনারেল শামীম কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৫ বছরে সর্বমোট ৮৮টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং ২০০৪ সালে সর্বাধিক সংখ্যক ৬৮টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে।

শান্তি চুক্তির এক যুগের পথ পরিক্রমায় সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সকল সীমাবদ্ধতা ও বিতর্ক সত্ত্বে শান্তি চুক্তি বাস্তবতাকে পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই মেনে নিয়েছেন। পার্বত্য বাঙালী জনতা ও তাদের সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন একদশক পর্যন্ত পার্বত্য চুক্তি বাতিলের জন্য আন্দোলন করলেও চুক্তির এক দশক পূর্তি উপলক্ষে গত ২০০৭ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে চুক্তির পূণর্মূল্যায়ন, সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ধারা বাতিল, এবং চুক্তিতে বাঙালীদের ন্যায্য অদিকারের স্বীকৃতি দাবী করেছে। বর্তমানেও তারা এই দাবীর উপরেই আন্দোলন করছে। অন্যদিকে বর্তমান সরকার পক্ষও চুক্তির মধ্যে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং কিছু বাস্তবায়ন অযোগ্য ধারার অস্তিত্ব মেনে নিয়ে পার্বত্য চুক্তি পূণর্মূল্যায়নের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। সম্প্রতিকালে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান সাজেদা চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষযক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুদদার সংবাদ মাধ্যমের কাছে এ মত ব্যক্ত করেছেন যে, সরকার পার্বত্য চুক্তি পূণর্মূল্যায়নের কথা চিন্তা করছে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির এক যুগ অতিবাহিতের ফল বিশ্লেষণ করে একথা বলা যায় যে, শান্তি চুক্তি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তির ফলে একদিকে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সন্ত্রাসীর অস্ত্র সমর্পন নিশ্চিত করা যায়নি। উল্টো ইউপিডিএফ নামে নতুন সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হযেছে। চুক্তির ফলে সেনাবাহিনীর সাথে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের যুদ্ধ হার হ্রাস পেলেও সাধারণ মানুষ হত্যা হ্রাস করা যায়নি। বরং সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বরবাসকারী প্রত্যাবাসিত বাঙালীরা শরণার্থির মতো নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী সেনা প্রত্যাহার করায় দুর্গম পাহাড়ে বসবাসকারী নিরীহ উপজাতীয়দের নিরাপত্তা সবচেয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জঙ্গীবাদীরা ট্রেনিং ক্যাম্প হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম ভূখণ্ডকে ব্যবহার করছে। প্রকৃতপক্ষে, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী জেএসএস ও ইউপিডিএফ’র সর্বোচ্চ ১০ হাজার সন্ত্রাসী সদস্য এবং কিছু কুমতলববাজ এনজিও কর্মী। এর বাইরে পাহাড়ের সকল শ্রেণীর বাঙালী ও উপজাতীয় বাসিন্দাগণ শান্তিপ্রিয় ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। শান্তি চুক্তি, স্বাধীন জুম্ম ল্যাণ্ড, সেনা প্রত্যাহার, বাঙালী খেদাও , পাহাড়ী খেদাও কোনো কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। বরং বর্তমানে বাঙালী-পাহাড়ী সহাবস্থান, সৌহার্দ, সৌজন্যতা, আতিথেয়তা এমনকি বিয়েশাদির মতো আত্মীয়তা বিনিময় হচ্ছে দেদারসে। উল্টো শান্তি চুক্তির ফলে সেই সহজ, সুন্দর, স্থায়ী শান্তির সম্পর্ক ও সহাবস্থানকে কিছু বর্তমান ও সাবেক সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মী হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে শান্তি চুক্তির ছায়ায় খ্রিস্টিয় সাম্রাজ্যবাদ ইউএনডিপির মতো বিশ্ব সংস্থা ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে তাদের পূর্ব তিমুরের ন্যায় খ্রিস্টিয় সাম্রাজ্য বিস্তারের নীল নকশা বাস্তবায়ন করছে নির্বিঘ্নে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন