রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে শেখ হাসিনার ৬ প্রস্তাব


ডেস্ক প্রতিবেদন:

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে নির্যাতন বন্ধ করে তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া এবং তাদের জাতীয়তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অপপ্রচার বন্ধ করাসহ ছয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা এই ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযানের অবসান দেখতে চাই। আমাদের মুসলমান ভাইদের এই দুর্দশার অবসান চাই। এই সঙ্কটের সূচনা হয়েছে মিয়ানমারে এবং সেখানেই এর সমাধান হতে হবে।”

শেখ হাসিনার ছয় দফা প্রস্তাব হল-

এক. রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে।

দুই. নিরপরাধ বেসামরিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মিয়ানমারের ভেতরে নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।

তিন. বলপ্রয়োগের ফলে বাস্তুচ্যুত সব রোহিঙ্গা যেন নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

চার. রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

পাঁচ. রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করার যে রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডা মিয়ানমার চালাচ্ছে, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

ছয়. রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে না ফেরা পর্যন্ত তাদের জরুরি মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোকে।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৪ অগাস্ট রাতে আড়াই ডজন পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলার পর দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রামে গ্রামে নতুন করে দমন অভিযানে নামে।

সেনাবাহিনী কীভাবে গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে, ঘরের ভেতরে আটকে রেখে কীভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, লুটপাট চালিয়ে কীভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথায়।

ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে বিভিন্ন মুসলিম দেশের নেতাদের উপস্থিতিতে বক্তৃতার শুরুতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মিয়ানমারে আজ মুসলমান ভাই-বোনেরা জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখোমুখি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের চালানো সামরিক অভিযান বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে।”

এ ঘটনায় এবরাই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা ব্স্তুচ্যুত হয়ে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, গত ২৫ অগাস্ট থেকে চার লাখের বেশি মানুষ মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এই শরণার্থীদের ৬০ শতাংশই শিশু।

“এটা এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়। আমি নিজে তাদের কাছে গেছি, তাদের মুখ থেকে , বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ভয়াবহ দুর্ভোগের বিবরণ শুনেছি। আমি বলব, আপনারা সবাই আসুন, এই শরণার্থীদের মুখ থেকে শুনে যান, মিয়ানমারে কীরকম নির্মমতা চলছে।”

কয়েক যুগ ধরে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের এই দফায় আরও প্রায় চার লাখ শরণার্থী প্রবেশ করেছে। রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই সংখ্যা ১০ লাখে ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।

নির্যাতনের শিকার আরও চার লাখ রোহিঙ্গাকে গত তিন দশক ধরে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা আট লাখ ছাড়িয়েছে। ভূমি স্বল্পতা আর সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ তাদের আশ্রয়, খাবার আর জরুরি সহায়তা দিয়ে আসছে বলে বৈঠকে জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী’ বলে দাবি করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। অথচ ঐতিহাসিক নথিপত্র বলছে, রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে শত শত বছর ধরে।

মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং তিন দিন আগেও তাদের সশস্ত্রবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, রোহিঙ্গা বলে কোনো জাতিসত্ত্বা মিয়ানমারে ‘কখনোই ছিল না’। যারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি করছে, তারা ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’।

এ বিষয়ে মিয়ানমারের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বক্তব্যে কান না দিতে আহ্বান জানান তিনি।

রাখাইনে এবারের সহিংসতা শুরুর পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মত জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি বলেন, নব্বইয়ের দশকে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে তার দেশ প্রস্তুত।

কিন্তু এই শরণার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকার করে না নেওয়ায় এবং তাদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি ভাষণে এড়িয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সমালোচিত হচ্ছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “মিয়ানমার পরিকল্পিত ও সংগঠিত উপায়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বের করে দিচ্ছে। প্রথমত তারা নিবন্ধিত জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়েছে। তারপর ১৯৮২ সালের আইনে তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশেই আইডিপি ক্যাম্পে পাঠিয়েছে তারা।”

রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গেলেও মিয়ানমার তাতে সাড়া দিচ্ছে না বলে মুসলিম দেশের নেতাদের জানান শেখ হাসিনা।

“আপনারা হয়ত মিডিয়ায় দেখেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে তাদের নিজের দেশে ফিরতে না পারে সেজন্য সীমান্তজুড়ে ভূমি মাইন পেতে রাখছে মিয়ানমার।”

রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় ওআইসির সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এ বিষয়ে ওআইসির যে কোনো উদ্যোগে অংশ নিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে।

সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন