রোহিঙ্গারা পাচ্ছে চাহিদার অতিরিক্ত ত্রাণ: বিক্রি করে দিচ্ছে স্থানীয়দের কাছে

ঘুমধুম প্রতিনিধি:

নগদ টাকা সহ নানা ত্রাণ সামগ্রীতে ভরে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট- ছোট ঝুপড়ি ঘরগুলো। কক্সবাজারের উখিয়া -টেকনাফের নতুন রোহিঙ্গা বস্তিতে বাশঁ, গাছ, ত্রিপলী, কাপড়, চাল, ডাল, আলু, চিনি, দুধ, ভোজ্য তৈল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী পাচ্ছে চাহিদার কয়েকগুন বেশী।

২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সহিংস ঘটনার পর -পরই লাখ -লাখ রোহিঙ্গার শ্রোত পড়ে। মগ সেনাদের নির্মম নির্যাতনের ঘটনা শুরুতে কয়েকটি গ্রামে ঘটলেও অপরাপর রোহিঙ্গারা নিজভুমি ছেড়ে এপারে চলে আসে প্রান বাচাঁতে। আশ্রয় নেন দুই উপজেলা ছাড়িয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তেও। আশ্রিত যারা এরই মধ্যে ঘর তুলে উখিয়া ও টেকনাফের অস্থায়ী ক্যাম্পে সংসার সাজিয়ে বসেছেন, এখন তাদের আর ভাতের অভাব নেই।

কেননা এরই মধ্যে বিশ্ব খাদ্যসংস্থা প্রায় অর্ধেক রোহিঙ্গাকে তাদের চাল বিতরণ কর্মসূচির আওতায় নিয়ে এসেছে। এছাড়া প্রতিদিনই সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্যাম্পগুলোতে ত্রাণ দিচ্ছে শতশত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এসব ত্রাণে এরই মধ্যে ক্যাম্পগুলোতে জমতে শুরু করেছে ত্রাণের মজুদ। ক্যাম্পগুলোর ঘরে- ঘরে হাজির হচ্ছে নগদ টাকাওয়ালারাও। নতুন যারা বাংলাদেশে পা রাখছে, তারাও আসার সঙ্গে- সঙ্গে পেয়ে যাচ্ছেন ত্রাণের টোকেন। বাংলাদেশে প্রবেশমাত্র সেনাবাহিনীর সদস্যরা নাম নিবন্ধন করে তাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন এই টোকেন।

তবুও ত্রাণ বিতরণে শতভাগ শৃঙ্খলা ও সমন্বয় আসেনি এখনো।বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রশাসনের লোকচক্ষুঁর আড়াঁলেও কতিপয় বিশেষ (অচেনা) লোকজন নগদ টাকা বিতরণ করছে। এদিকে আরো বেশি ত্রাণ সংগ্রহের লোভ পেয়ে বসেছে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত’ মিয়ানমারের এসব রোহিঙ্গাকে । তারা এখন এক ক্যাম্প থেকে আর এক ক্যাম্পে ছুটে বেড়াচ্ছে আরো বেশি বেশি ত্রাণ লাভের আশায়। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে একই ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্প থেকে একাধিকবার ত্রাণ সংগ্রহ করছেন। এত ত্রাণ নিতে রোহিঙ্গারা একঘরে ভেংগে একাধিক ঘর পরিচয় (পরিবার) দিচ্ছেন।

কখনো- কখনো এক মাস আগে আসা রোহিঙ্গারা নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন আসাদের তালিকায় পরিবারের অন্য সদস্যর নাম আবারও লেখাচ্ছেন। এতে করে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা সেনা, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা পড়েছেন মহা বিপাকে। এজন্য ভীষণ বিরক্ত তারা। ক্যাম্পগগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ক্যাম্পে সংসার গেড়াঁ প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের কাছেই এখন তিন থেকে ৮ বস্তা করে ত্রাণের চাল, ডালসহ অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী জমা হয়েছে।

তবুও তারা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার দেওয়া ত্রাণের লাইনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। প্রতিদিনই বস্তাভর্তি ত্রাণ মাথায় করে ঘরে ফিরছে। আবার এক ক্যাম্প থেকে ত্রাণ নিয়ে ছুটছে অন্য ক্যাম্পে। আবার কক্সবাজার -টেকনাফ সড়কের ধারে -কিনারে বসে ভিক্ষা ভিত্তিও চালিয়ে যাচ্ছে সমানতালে।

এমনকি বালুখালি বা কুতুপালং থেকে ত্রাণ আনতে ছুটতে দেখা যাচ্ছে উনচিপ্রাং, নয়াপাড়া, লেদা বা শামলাপুরে। আবার ওখান থেকে ছুটে আসছে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, হাকিম পাড়া বস্তিতে। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রুর জিরো পয়েন্ট থেকে বালুখালী, থাইংখালী ও কুতুপালংয়েও ত্রাণ নিচ্ছে। আবার ওইসব ক্যাম্প থেকেও অন্যখানে ছুটতে দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ত্রাণ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে এরা। এমন রটনার সত্যতা মিলেছে।

রবিবার (১৫ অক্টোবর ) দুপুরে তুমব্রু থেকে মো. শরীফ (৫০) বালুখালীতে যাচ্ছেন ত্রাণের জন্য। মো. শরীফসহ অনেকেই ত্রাণের বস্তা নিয়ে ফিরছেন বিকেলে। শনিবার টেকনাফের শাহপরীর দ্ধীপ থেকে ফেরার পথে সাবরাংয়ের হাড়িয়াখালির ভাঙ্গা রাস্তার ওপরে সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে একদল রোহিঙ্গাকে জটলা পাকাতে দেখা যায়। এদের প্রায় সবাই মহিলা ও শিশু।

এদেরই কয়েকজন মহিলাকে সেনাবাহিনী লাইন ছেড়ে ক্যাম্পে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও তারা অনুনয় বিনয় করেই যাচ্ছিল। এখানে দায়িত্বরত সেনা সদস্যরা জানান, এই মহিলারা সকালেই নাম নিবন্ধন করে ত্রাণের স্লিপ নিয়ে গেছেন। এখন আবার নতুন আসা রোহিঙ্গাদের লাইনে দাঁড়িয়ে নতুন করে ত্রাণের স্লিপ চাচ্ছেন। এদের কয়েকজন আবার মাস খানেক আগে বাংলাদেশে এসেছেন। এরা বালুখালি ক্যাম্পে থাকনে। সেখান থেকে এই ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন নতুন আসা রোহিঙ্গা হিসেবে নাম লেখাতে। যাতে একাধিকবার ত্রাণ তুলতে পারেন।

গত কয়েকদিন ধরে উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তায় ঘনঘন চেক পোস্ট বসানো হয়েছে। এইসব চেক পোস্টে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা যানবাহন চেক করছেন। তারপরও রোহিঙ্গাদের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। টেকনাফ, উখিয়ার ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষায় মিল থাকায় এবং সেনা সদস্যরা সে ভাষা বুঝতে না পারায় এমন ঘটনা ঘটছে।একাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এই প্রতিবেদক কে বলেন, ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের আসল চরিত্র বের হয়ে আসছে।

একাধিকবার ত্রাণ নিতে গিয়ে ধরা খাওয়ারা বলতে শুরু করেছে, তারা বাংলাদেশের ত্রাণ নিচ্ছে না। তারা ইউএনএইচসিআর বা বিশ্ব সম্প্রদায়ের ত্রাণ নিচ্ছে।আবার বলছে বার রাষ্ট্রের ত্রাণ নিচ্ছে, বাংলাদেশের নয়?

এদিকে এ সমস্যাকে ত্রাণকাজে সমন্বয়হীনতার দুর্বলতা হিসেবে দেখছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা ৪৭টি দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জোট ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন আইএসসিজি। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা শিরিন আকতার বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করতে পারলে সুষ্ঠু সমন্বয় সম্ভব হবে। তার আগে প্রয়োজন মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই যে হারে রোহিঙ্গা আসছে, তা বন্ধ হওয়া।

তবে পুলিশ বলছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যেই একশ্রেণীর দালাল গড়ে উঠেছে। এরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ত্রাণ ও নগদ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে অনেক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ডেকে আনছে। তাই সবার আগে রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

একই সঙ্গে তাবলীগ জামায়াতসহ ব্যক্তি পর্যায়ে ত্রাণ হিসেবে নগদ অর্থ বিতরণও বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ছোটাছুটি ও নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধ সম্ভব হবেনা।উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) এম.গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা সরকারের নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ছাড়াও বিভিন্ন এনজিও, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাপক ত্রাণ ও নগদ টাকা পাচ্ছে।

ফলে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও বিক্রি করছে। কিন্তু অর্বণনীয় দুর্ভোগে পড়ছি উখিয়া -টেকনাফের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার জনগণ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন