রামুতে এখনো পানিবন্দি লাখো মানুষ, ত্রাণের জন্য হাহাকার

ramu pic bonna 31.07.15
নিজস্ব প্রতিনিধি:
কক্সবাজারের রামুতে বাঁকখালী নদীর পানি ৭দিন ধরে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কোমেন এর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ফলে প্লাবিত এলাকাগুলো এখনো পানিতে একাকার হয়ে আছে। বন্যা কবলিত লোকজন বাসস্থান, খাদ্য, পানি সহ নানা সংকটে সময় পার করছেন। ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্তরা সরকারি এবং বেসরকারি কোন ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছে। একমাস আগের বন্যার ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন না মুছতেই নতুন করে আবারো বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় এর প্রভাবে দমকা হাওয়া ও টানা বৃষ্টিপাত রামুবাসীর দূর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার এর আওতায় রামুতে বাঁকখালী নদীর পানি পরিমাপের দায়িত্বরত গেছ রিড়ার রুহুল আমিন রোহেল জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বাঁকখালী নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

শুক্রবার বিকাল ৫ টা পর্যন্ত নদীর ওয়াটার লেভেল ছিলো ৫ দশমিক ৯৮ মিটার। এরমধ্যে বিপদ সীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো শূণ্য দশমিক ১৯ মিটার। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এর পরিমান আরো বাড়ার আশংকা রয়েছে।

শুক্রবার (৩১ জুলাই) বিকালে ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের হাইটুপী বুথপাড়া এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, এক মাস আগে বাঁকখালী নদীর ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের বিশাল অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করছে।

এ অংশ দিয়ে প্রবেশ করা পানিই মূলত রামুর একাংশকে বানভাসী করে রেখেছে। ভাঙ্গনটির কারনে উপজেলার ফতেখাঁরকুল, চাকমারকুল, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা গত ৬ দিন ধরে পানিতে প্লাবিত হয়ে আছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পাল্স বাংলাদেশ এর প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম কলিম জানিয়েছেন, রামুতে চলমায় বন্যায় লাখো মানুষ সবকিছু হারিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে। খাদ্য, পানি এবং বাসস্থান এর চরম সংকট চলছে। মানুষের বসত ঘর, ধান, চাল, বীজ, ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। সবাই আক্রান্ত হওয়ায় কেউ অন্যের কাছে সাহায্য চাইবে, এমন পরিস্থিতিও নেই। অনেকে বসত বাড়ি হারিয়ে উচ্ছেদ হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের ত্রাণ তৎপরতা ভালোই চলছে। তবে তা চাহিদার তুলনাই খুবই অপ্রতুল। এখন প্রয়োজন বেশী বেশী ত্রাণ। এ জন্য তিনি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ি এবং বিত্তবানদের বন্যার্তদের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।
বন্যা পরিস্থিতি জানার জন্য রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে সংযোগ পাওয়া যায়নি। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আলী হোসেন জানিয়েছেন, রামুর ১১ ইউনিয়নের মধ্যে ১০টি ইউনিয়ন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ফতেখাঁরকুল, চাকমারকুল, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিন মিঠাছড়ি, রাজারকুল, কাউয়ারখোপ, কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, এখনো সরকারিভাবে কোন ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়নি।

রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদরাসার পরিচালক মাওলানা মোহছেন শরীফ জানিয়েছেন, রাজারকুল ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকায় এক মাস আগে বন্যায় পুরনো রাজারকুল-চেইন্দা সড়কে সৃষ্ট ভাঙ্গন দিয়ে পানি প্রবেশ করে রাজারকুল সহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।

চাকমারকুল ইউপি চেয়ারম্যান মুফিদুল আলম জানিয়েছেন, বন্যা কবলিত এ ইউনিয়নের এখনো ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। এরমধ্যে জারাইলতলী, পূর্ব মোহাম্মদপুরা, শ্রীমুরা, নয়াপাড়া, শাহমদরপাড়া, নয়া চরপাড়া বন্যার পানিতে এখনো প্লাবিত রয়েছে। তিনি জানান, এ পর্যন্ত তিনি ২ টন চাল বরাদ্ধ পেয়েছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় কোমেন এর প্রভাবে সৃষ্টি ঝড়ো-হাওয়ায় এ ইউনিয়নের অর্ধ শতাধিক বসত বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দক্ষিণ মিঠাছড়ি চাইল্যাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, বন্যায় ইউনিয়নের চরপাড়া, ঘাটপাড়া, উমখালী, পশ্চিম ধরপাড়া, আজিমুদ্দিন সিকাদারপাড়া, জনুমাতবরপাড়া, চাইল্যাতলী, সিকদারপাড়া, কাটিরমাথা, কাঠিরমাথা এলাকার ৩ হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দি হয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।

জোয়ারিয়ানালা ইউপি চেয়ারম্যান এমএম নুরুচ ছাফা জানিয়েছেন, ইউনিয়নের পশ্চিম নোনাছড়ি, উত্তর মিঠাছড়ি, আশকরখিল সহ বিভিন্ন এলাকায় এখনো মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। দূর্গত এলাকায় এলাকায় সরকারি এবং বেসরকারি ত্রান তৎপরতা অপ্রতুল বলে দাবি করেন তিনি। তিনি আরো জানান, গত দুইদিনে ঘূর্ণিঝড় কোমেন এর প্রভাবে ইউনিয়নে অনেক বসত বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছপালা উপড়ে পড়ায় প্রধান এবং গ্রামীন সড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

কাউয়ারখোপ ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক জানিয়েছেন, ৭দিন ধরে বন্যার কারনে ইউনিয়নের মনিরঝিল, ফুলনীরচর, গাছুয়াপাড়া, ডিকপাড়া সহ কয়েকটি গ্রামের ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। দূর্গত এসব মানুষের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ সরবরাহ করার জন্য তিনি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এবং বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

রামু কেন্দ্রিয় সীমা বিহারের সহকারি পরিচালক, বিশিষ্ট লেখক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু রামুর বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল (শুক্রবার) ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রামুতে বন্যার পানিতে ভাসছে মানুষের জীবন। নিচু তলার মানুষেরা খাবারের অভাবের পাশাপাশি আশ্রয়হীনতায়ও ভুগছেন। অনেকে জীবন বাঁচাতে ঘর ছেড়ে ঘরের বাইরে রাত যাপন করছেন। আর এই সুযোগে অনেকে চুরি-ডাকাতি করতে মানুষের বাড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ছেন, হানা দিচ্ছেন। চোর-ডাকাতদের বাধা দিতে গিয়ে অনেকের প্রাণহানিও ঘটছে। তাই এখন অনেকে বাড়ি ছাড়তে চান না। ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে থেকে যেতে চান। আবার অনেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বস্তায় ভরে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যেখানে ঠাই হয় সেখানে তো নিজের জন্যও ঘুমানোর জায়গা হয় না। বসে বা দাঁড়িয়ে থেকে সময় কাটাতে হয়।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন