মাতামুহুরীতে ডুবে মৃত ৪ ছাত্রের জানাযা সম্পন্ন: শোকার্ত মানুষের ঢল

স্বজনদের আর্তনাদ ও আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস

চকরিয়া প্রতিনিধি:

চকরিয়া গ্রামার স্কুলের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে রেখে গেছে অজস্র স্মৃতি। বই-খাতা নিয়ে আর কোনদিন স্কুলে আসবে না এমশাদ, অরভি, ফারহান, তূর্ণ ভট্রাচার্য্য ও মেহেরাব।

স্কুলের প্রিয় সহপাঠীদের দেখাও হবে না আর। স্কুলে হেসে খেলে দুষ্টুমি ও পড়ায় মনোনিবেশে তাদের আর দেখা মিলবে না। তারা আজ ওপারের মানুষ-ওখানের ছাত্র।

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীর চিরিংগা ব্রীজের নিচে জেগে ওঠা চরে ফুটবল খেলে নদীতে গোসল করতে গিয়ে সলীল সমাধি হয়েছে চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ৫ মেধাবী কৃতি ছাত্রের। মৃত ছাত্রদের মধ্যে ৪ ছাত্র দশম শ্রেণীর ও এক ছাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছিল।

স্কুল ছুটির শেষে মাতামুহুরী নদীর জেগে ওঠা চরে শনিবার ১৪ জুলাই সহপাঠীসহ ফুটবল খেলতে যায় ওই ছাত্ররা। যে বালির মাঠে তারা হেসে-খেলে খেলতে গিয়েছিল রোববার (১৫ জুলাই) সেখানে আজ চুপচাপ করে শুয়ে আছে। তারা আর কখনও খেলবে না, পড়বে না। হাসবে না, দুরন্তপনা তাদের আর ছুঁবে না।

মাতামুহুরী নদীতে ৮ ঘন্টা ধরে ফায়ার সার্ভিসের দমকল বাহিনীর সদস্য, ডুবুরি ও স্থানীয়রা প্রশাসনের সার্বিক সহয়তায় অভিযান চালিয়ে নিহত ৫ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয় শনিবার রাত ১২টায়। উদ্ধার হওয়া ছাত্রের লাশগুলো একে একে আনা হলে তাদের বসতঘরে শুরু হয় স্বজনের গগণবিদারী কান্নারোল।

রোববার (১৫ জুলাই) সকাল ১১টায় চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীতে ডুবে যাওয়া ৪ ছাত্রের (তুর্ণ বাদে) জীবনের শেষ ফুটবল খেলার মাঠে (নদীর জেগে ওঠা চরেই) জানাযা নামাজ একত্রে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাতামুহুরী নদীর সদ্য জেগে ওঠা বালির মাঠে সবার জানাযার জন্য লাইন করা হলে তাদের স্বজনদের আর্তনাদে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কোমলমতি ৪ ছাত্রের লাশ দেখে হাজার হাজার জনতা সবাই নির্বাক, শোকাহত।

নিহত শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও স্বজনদের বিলাপে পুরো এলাকা শোকে শোকাতুর হয়ে গেছে।

শনিবার পাঁচ ছাত্র পানিতে ডুবে নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে শোকের শহরে পরিণত হয়েছে চকরিয়া উপজেলা সদর। পুত্র সন্তান হারানোর বেদনায় কাতরাচ্ছে মা-বাবা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার বাতাস। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তারা। ভাবতেও পারেননি এভাবে নিরবে চলে যাবে তাদের প্রিয় সন্তানেরা।

উল্লেখ্য যে, মাতামুহুরী নদীতে সদ্য জেগে ওঠা বালু চরে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলে নদীতে গোসল করতে গিয়ে পৌরশহরে অবস্থিত চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ৫ মেধাবী ছাত্রের সলিল সমাধি হয় শনিবার দুপুর সাড়ে ৩ টার দিকে।

নিহতরা হলো, স্থানীয় আনোয়ার শপিং কমপ্লেক্সের মালিক আনোয়ার হোছাইনের দু’পুত্র চকরিয়া গ্রামার স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র আমিনুল হোছাইন এমশাদ (১৭) ও তার ছোট ভাই একই স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র আফতাব হোছাইন মেহেরাব (১৫), একই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও মানিকপুর তর্দরূপ ভট্ট্রাচার্য্যের পুত্র তুর্ণ ভট্রাচার্য (১৭), গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলামের পুত্র ও ১০ম শ্রেণীর ছাত্র সাঈদ জাওয়াদ আরভি (১৭) ও চিরিংগা সরকারি হাসপাতাল পাড়ার মোহাম্মদ শওকতের পুত্র ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ফারহান বিন শওকত (১৭)।

তাদের বাড়িতে নিহত ছাত্রদের একনজর দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমেছিল। মূলত নিহত ছাত্ররা চিরিংগা ব্রীজের নিচে জেগে উঠা বালু চরে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে যায়। তাদের মধ্যে একদল আর্জেন্টিনা ও অপরদল ব্রাজিল হয়ে ২২ জন শিক্ষার্থী দুই দলে বিভক্ত হয়ে ফুটবল খেলেন। খেলে শেষে বেলা সাড়ে ৩ টার দিকে মাতামুহুরী নদীতে গোসল করতে নামে ওই ক্ষুদে ফুটবলাররা। তাদের মধ্যে ৬ জন ছাত্র নিখোঁজ হয়ে যায়। একজনকে তাদের সহপাঠিরা মুমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে চকরিয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ঘটনার ৮ ঘন্টা পর স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিস ডিফেন্স স্টেশনের একদল ডুবুরি নদীতে জাল ফেলে নিখোঁজ ৫ ছাত্রের লাশ এক এক করে উদ্ধার করেন।

এদিকে জানাযায় অংশ নিতে আসা শোকার্ত মানুষের ভীড়ে ২ ঘণ্টা পূর্ব থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়। পুরো কক্সবাজার জেলায় শোকাহত লক্ষাধিক মানুষ চার ছাত্রের জানাযায় অংশ নেয়ার জন্য ছুটে আসে মাতামুহুরী বালুর চরে।বর্তমানে পুরো জেলায় চলছে শোকের মাতম।

জানাযা শেষে নিহতের পরিবারে চলছে কান্নার আহাজারী। তাদের পিতা-মাতা কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। তাদেরকে শান্তনা দেওয়ার জন্য ছুটে আসে পুরো উপজেলার হাজার হাজার নারী-পুরুষ।

চার ছাত্রের জানাযায় অংশ নেন চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন, চকরিয়া পৌর প্রশাসন, চকরিয়া থানার কর্মকর্তাবৃন্দ,বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

জানাযা নামাজের পূর্বে শোকার্তদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন, চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব জাফর আলম এমএ, চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো. আলমগীর চৌধুরী, চুনতি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবু নঈম, চকরিয়া গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও নিহত ছাত্র অরভির পিতা রফিকুল ইসলাম প্রমূখ।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী, কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম লিটু, কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমানসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানবৃন্দ, চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক নুরুল আখের, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও কলেজের অধ্যক্ষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক ও শোকাহত জনতা।

নিহত ছাত্রদের জানাযায় ইমামতি করেন চিরিংগা সোসাইটি জামে মসজিদের খতিব মাওলানা কফিল উদ্দীন ফারুখী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন