বোমাং রাজাদের ইতিকথা

sayed

সৈয়দ ইবনে রহমত
বান্দরবান– বাংলাদেশের অরণ্যময় এক জেলার নাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বতগুলো রয়েছে এখানে। উঁচু উঁচু পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা পাথুরে ঝরনা আর খরস্রোতা নদী এ জেলার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তবে তার চেয়ে বেশি মনোমুগ্ধকর হলো বিচিত্র জীবন-সংস্কৃতির অধিকারী মানুষদের আবাস এই বান্দরবান। সরকারের ডিসি, এসপি ছাড়াও এ জেলার মানুষদের কাছে আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আছেন; তিনি হলেন বোমাং রাজা। ১৭তম রাজা হিসেবে এখন দায়িত্ব পালন করছেন বোমাং রাজ পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি জনাব উ চ প্রু বোমাংগ্রী।

এ দেশের মায়েরা আজও সন্তানদের রূপকথা শুনিয়ে ঘুম পাড়ান। রূপকথা হিসেবে তারা যেসব গল্প বলেন, তার অধিকাংশই শুরু হয় : ‘এক যে ছিল রাজা…’ এই বাক্যাংশটি দিয়ে। শুধু রূপকথাতেই নয়, বাস্তবেও এদেশে অনেক রাজা-মহারাজা ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস অসংখ্য রাজা-মহারাজার রাজকীয় ঘটনার বর্ণনায় পরিপূর্ণ। এদের মধ্যে অনেক প্রজাহিতৈষী যেমন আছেন, তেমনি প্রজাপীড়ক হিসেবেও অনেক রাজা-মহারাজার বর্ণনা আছে। আজকাল আর সেই রাজা-প্রজার সম্পর্কের বাস্তব উদাহরণ নেই বললেই চলে।

যদিও একটা সময় গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাই নির্ভর করত রাজা-প্রজার সম্পর্কের ওপর। রাজার ছেলে রাজা হবেন, প্রজাদের শাসন করবেন, প্রজারা বিনা প্রশ্নে তাদের মান্য করবেন- এটাই ছিল নিয়ম। সেইদিন এখন আর নেই। রাজা-প্রজার ব্যবস্থা উঠে গেছে, এসেছে নতুন দিন। আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো আর গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এখন চলেছে- ‘আমরা সবাই রাজা’র যুগ।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরে রাজত্ব না থাকলেও অনেক রাজা-মহারাজার অস্তিত্ব ছিল। পাকিস্তান আমলে জমিদারী অধিগ্রহণ আইন করার পর রাজাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতে এখনো তিনজন রাজা আছেন; চাকমা রাজা, বোমাং রাজা এবং মং রাজা।  যদিও অফিসিয়ালি বা সরকারি খাতায় তাদের নাম সার্কেল চিফ। তবে নিজ সার্কেলে বসবাসকারী জনগণের কাছে তারা রাজা বলেই পরিচিত। চাকমা রাজার এলাকা রাঙ্গামাটি, বোমাং রাজার রাজত্ব বান্দরবান, আর মং রাজার শাসন চলে খাগড়াছড়ি জেলায়।

এই রাজাদের শাসন ব্যবস্থা যতটা না বাস্তবিক অর্থে, তার চেয়ে বেশি প্রতীকী। প্রতীকী অর্থে এই কারণে যে, রাজা হলেও ইতিহাস কিংবা রূপকথার রাজাদের মতো তাদের রাজত্ব এবং সৈন্য-সামন্ত নেই। প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই, নেই তেমন আয়-রোজগারও। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে সরকারের পক্ষে ট্যাক্স আদায় করাই তাদের মূল দায়িত্ব। একই সাথে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীগুলোর সামাজিক বিচার-শালিস করার দায়িত্বও তাদের। উচ্চ শিক্ষিত এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এর প্রয়োজনীয়তা ফিকে হয়ে এলেও পার্বত্য তিন জেলায় টিকে আছে এই প্রতীকী রাজপ্রথা। প্রতীকী হলেও পার্বত্য দুর্গম অঞ্চলের কোনো কোনো মানুষের কাছে এখনও রাজাই সবকিছু। বিশেষ করে বান্দরবান জেলার দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ী জনগোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া রাজকীয় অনুষ্ঠান রাজপুণ্যাহ (প্রজাদের কাছ থেকে বাৎসরিক ট্যাক্স আদায় অনুষ্ঠান) নিয়মিত আয়োজন করায় বান্দরবানের বোমাং রাজার সাথে প্রজাদের তাৎপর্যপূর্ণ যোগাযোগ এখনও বিদ্যমান রয়েছে।

Untitled-1 copy

বোমাং রাজাদের তালিকা
১.      মং চ প্যাই বোমাং (১৬১৪-১৬৩০ খ্রি.),
২.      মং গ্রই বোমাং (১৬৩০-১৬৬৫ খ্রি.)
৩.       হেরী প্রু বোমাং (১৬৬৫-১৬৮৭ খ্রি.)
৪.       হেরী ঞো বোমাংগ্রী (১৬৮৭-১৭২৭ খ্রি.)
৫.       কং হ্লা প্রু বোমাংগ্রী (১৭২৭-১৮১১ খ্রি.)
৬.      সাক থাই প্রু বোমাংগ্রী (১৮১১-১৮৪০ খ্রি.)
৭.       কং হ্লা ঞো বোমাংগ্রী (১৮৪০-১৮৬৬ খ্রি.)
৮.      মং প্রু বোমাংগ্রী (১৮৬৬-১৮৭৫ খ্রি.)
৯.      সাক হ্ন ঞো বোমাংগ্রী (১৮৭৫-১৯০১ খ্রি.)
১০.     চ হ্লা প্রু বোমাংগ্রী (১৯০১-১৯১৬ খ্রি.)
১১.      মং সা ঞো বোমাংগ্রী (১৯১৬-১৯২৩ খ্রি.)
১২.     ক্য জাই প্রু বোমাংগ্রী (১৯২৩-১৯৩৩ খ্রি.)
১৩.     ক্য জ সাইন বোমাংগ্রী (১৯৩৩-১৯৫৯ খ্রি.)
১৪.     মং শোয়ে প্রু বোমাংগ্রী (১৯৫৯-১৯৯৬ খ্রি.)
১৫.     অংশৈ প্রু চৌধুরী বোমাংগ্রী (১৯৯৮ থেকে ৮ আগস্ট ২০১২ খ্রি.)
১৬.     ক্যসাইন প্রু চৌধুরী বোমাংগ্রী (১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ খ্রি.)
১৭.     উ চ প্রু বোমাংগ্রী (২৪ এপ্রিল ২০১৩ থেকে …চলমান )
(সূত্র : ১৬তম বোমাংগ্রী উ ক্যসাইন প্রু চৌধুরীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ)

শুরুর কথা
প্রাচীনকালে শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ড শ্বেতহস্তীর জন্য বিখ্যাত ছিল। আর এই শ্বেতহস্তী ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ রাজাদের কাছে অতি পবিত্র। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, তথাগত বুদ্ধ এক জন্মে শ্বেতহস্তীরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পেগুর তেলেইং রাজা ন্যানডা বায়েং (১৫৮১-১৫৯৯ খ্রি.) শ্যাম রাজ্য আক্রমণ করে রাজধানী আইয়োথিয়া ধ্বংস করেন এবং শ্যাম রাজ্যের শ্বেতহস্তী চারটি ও রাজকুমারীকে পেগুতে নিয়ে আসেন। রাজকুমারীকে পেগুরাজ বিয়ে করেন। আরাকানরাজ মিন রাজাগ্রী (১৫৯৩-১৬১২ খ্রি.) পেগুরাজের শ্বেতহস্তীর লোভে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মহাপিন্নাক্যকে পেগু অভিযানে প্রেরণ করেন। আরাকানি বাহিনী পেগুর পতন ঘটিয়ে শ্বেতহস্তী চারটি ও পেগুরাজকন্যা সিনডোনং, রাজপুত্র মং চ প্যাই ও কয়েক হাজার তেলেইং সৈন্য বন্দী করে আরাকানে নিয়ে আসেন। আরাকানরাজ পেগুরাজকন্যাকে বিয়ে করেন। আরাকান রাজা মিন রাজাগ্রীর মৃত্যুর পর তার পুত্র মিনখা মৌং (১৬১২-১৬২২ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন। তার রাজত্বকালে পূর্ববঙ্গের (চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল) বেশ কিছু অঞ্চল আরাকানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন এই অঞ্চলের সমুদ্র ও নদী উপকূলবর্তী এলাকায় পর্তুগীজ দস্যুদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়।

আরাকানরাজ মিনখা মৌং ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে তার সৎমামা ভূতপূর্ব তেলেইং রাজপুত্র মং চ প্যাইকে আরাকান অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠান। তিনি তার অনুগত তেলেইং বাহিনীসহ চট্টগ্রাম আগমন করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে এখানকার পর্তুগীজ দৌরাত্ম্য দমন করে আরাকানরাজের প্রশংসাভাজন হন। আরাকানরাজ তাকে ‘বোমাং’ (সেনাপতি বা সেনানায়ক) উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। মং চ প্যাই ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ অবধি আরাকান অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। মং চ প্যাইয়ের মৃত্যুর পর তাদের অনুগত তেলেইং বাহিনীসহ তার চার উত্তরপুরুষ মং গ্রুই ১৬৩০ থেকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ, হেরী প্রু ১৬৬৫ থেকে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ, হেরী ঞো ১৬৮৭ থেকে ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ এবং কং হ্লা প্রু ১৭২৭ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি বংশপরম্পরায় আরাকান অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করেন এবং চট্টগ্রামে বসবাস করেন।

উল্লেখ্য যে, হেরী প্রু‘র শাসনকালে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খাঁ আরাকানি বাহিনীকে পরাজিত করে শঙ্খ নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রামের বৃহদাংশ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু তখনও দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকান অধিকারে থাকে। আঠারো শতকে যখন কামানচি বিদ্রোহ আরাকানে অরাজকতা সৃষ্টি করছিল, তখন সেনাপতি মহাদন্ডায়ু কামানচি বিদ্রোহ দমনে তৎপর হন। এ সময় দক্ষিণ চট্টগ্রামের আরাকানি শাসনকর্তা হারিও মহাদন্ডায়ু সান্দাউইজিয়া নাম গ্রহণপূর্বক আরাকানের রাজা হন এবং কামানচি বিদ্রোহ দমনে সফল হওয়ায় তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের হেরী ঞোকে বোমাংগ্রী (বোমাংদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তথা সেনাপতিদের সেনাপতি) উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। হেরী ঞো জীবিতকালে তার পুত্র ছদা প্রুর মৃত্যু হয়। হেরী ঞোর মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র কং হ্লা প্রু দক্ষিণ চট্টগ্রামের আরাকানি শাসনকর্তা হন। তিনি দুহাজারী দুর্গের মোগল সেনাপতি আধু খাঁ ও তার পুত্র শের জামাল খাঁর আক্রমণে চাপের মুখে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকেন। একে একে রামু, ঈদগড়, ইয়াংছা, মাতামুহুরী হয়ে লামায় গিয়ে আবাস গড়েন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে দুহাজারী দুর্গের সেনাপতি শের জামাল খাঁর আক্রমণের মুখে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শেষ আরাকানি শাসনকর্তা বোমাং কং হ্লা প্রু তার শেষ অবস্থান লামা থেকেও তেলেইং অনুগামীগণসহ আরাকানে চলে যেতে বাধ্য হন। কং হ্লা প্রুর দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার ঘটনার সাথে সাথে এ অঞ্চলের ওপর থেকে আরাকানি শাসনেরও অবসান ঘটে। কিন্তু আরাকানরাজের আনুকূল্য না পেয়ে কং হ্লা প্রু ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।

ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে মোগল শাসনের অবসান হয়েছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। কোম্পানি প্রথমে ঠিকাদারদের দ্বারা কং হ্লা প্রুর মাধ্যমে তেলেইং এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে বসবাসকারী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করত। তবে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা প্রথম বোমাং কং হ্লা প্রুর সাথে কর আদায় সংক্রান্ত ব্যাপারে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এর মাধ্যমেই মূলত সার্কল চিফ হিসেবে ইংরেজদের কাছ থেকে বোমাংদের স্বীকৃতি মিলে। এর পর থেকে ইংরেজদের সাথে বোমাং পরিবারের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্কেলসমূহ গঠিত হলে কং হ্লা প্রু পরিবারের খেতাবের স্মারক হিসেবেই গঠিত হয় বোমাং সার্কেল।

বর্তমানে বোমাং রাজার বাড়ি বান্দরবান শহরে। বলা চলে বোমাং রাজার বাড়িকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে অরণ্যময় শহর বান্দরবান। তবে বোমাং রাজপরিবার বান্দরবান আসার আগে নানাস্থানে বিভিন্ন সময় অবস্থান করেছে। চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়ার অন্তর্গত বাজালিয়া গ্রামের শঙ্খ নদীর খায়েরুজ্জামান চৌধুরী চরে কিছুকাল অবস্থান করে বোমাং রাজপরিবার। এই এলাকাটি এখনও বান্দরবানের মারমাদের কাছে ‘ইংরা হংপ্রা’ অর্থাৎ ‘প্রাচীন বসতি এলাকা’ হিসেবে পরিচিত। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, কং হ্লা প্রু ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকান থেকে চট্টগ্রামে ফিরে আসার পর এই রাজপরিবার তাদের অনুগত তেলেইং জনগোষ্ঠীকে নিয়ে রামু, ঈদগাহ, মাতামুহুরী নদীর তীর, এমনকি মহেশখালীতেও বসবাস করেছেন।

তেলেইং থেকে মারমা
মি. হার্ভে রচিত ‘হিস্ট্রি অব বার্মা’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে এবং গবেষণায় প্রাপ্ত নতুন নতুন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে একাধিক ইতিহাসবিদ বলেছেন যে, বর্তমান বোমাং রাজপরিবার ভূতপূর্ব পেগু রাজার বংশধর। আর তাদের অনুগত জনগোষ্ঠী হলো সেই পেগুরাজের অনুগত তেলেইং সৈন্যরা, যারা ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজের সেনাপতি মহাপিন্নাক্যর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এবং বন্দী হয়ে আরাকানে এসেছিলেন। প্রাচীনকাল থেকেই এই তেলেইংরা এদেশে মগ নামে পরিচিত ছিলেন। তেলেইং থেকে মগ পরিচিতি কীভাবে এলো তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া না-গেলেও অনেকেই ধারণা করেন, মগ নামটি ‘মগধ’ শব্দজাত। অর্থাৎ মগধের ধর্মের তথা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরাই মগ নামে পরিচিত হয়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামে এসে।
তাছাড়া সে-সময় আরাকানিরাও নিজেদের মগধাতদের বংশধর বলে পরিচয় দিতেন। তাই চট্টগ্রামের স্থানীয়দের কাছে আরাকান থেকে আসা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী তেলেইংরা মগ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু ইতিহাসের নানা ঘটনার পরম্পরায় চট্টগ্রামের স্থানীয়দের কাছে এক সময় ‘মগ’ শব্দটি লুটতরাজ আর দস্যুতার প্রতীক হয়ে ওঠে। মানুষ মগ শব্দটিকে ঘৃণ্য একটি অভিধা হিসেবেই গ্রহণ করে। ‘মগের মুল্লুক’ কথাটি তারই বহিঃপ্রকাশ। একারণেই তারা নিজেদের মগ পরিচয় নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েন। ফলে পাকিস্তান আমল থেকে তারা নিজেদের আরাকানের মারমা জনগোষ্ঠীর অংশ বলে দাবি করেন। যদিও প্রাচীন আরাকানে মারমা নামের কোনো জনগোষ্ঠীর বসবাসের প্রমাণ খুঁজে পান নি ইতিহাসবিদরা।

এ প্রসঙ্গে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ইতিহাস’ শীর্ষক গ্রন্থের ৫১ পৃষ্ঠায় প্রভাংশু ত্রিপুরা লিখেছেন, “… পূর্বে এ জনজাতি সাধারণ মানুষের কাছে ‘মগ’ নামে পরিচিত ছিল কিন্তু মগ শব্দটি নিয়ে অপব্যাখ্যা প্রয়োগ ও বিতর্ক হওয়ার প্রেক্ষিতে মারমাগণ মগ শব্দটি বর্জন করে। এ প্রেক্ষিতে, বান্দরবান জেলার বোমাং সার্কেলের ভূতপূর্ব চীফ মং শৈ প্রু চৌধুরী ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত মগ শব্দের বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে নিজেদেরকে মারমা নামে পরিচয় দিতে আহ্বান জানালে তখন থেকে ‘মারমা’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হয়।”

বোমাং রাজা নির্বাচন
শুরুতে বোমাং রাজার মৃত্যুর পর তার পুত্রই পরবর্তী বোমাং রাজা হতেন। কিন্তু কোনো কোনো বোমাং রাজা মৃত্যুর সময় পুত্র সন্তান রেখে যান নি। ফলে তার মৃত্যুর পর কে বোমাং হবেন তা নিয়ে রাজপরিবারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে। কোনো কোনো সময় এটা পরিবারের মধ্যে ভাঙনেরও সৃষ্টি করেছে। পরাজিত হয়ে কিংবা অভিমান করে কোনো কোনো অংশ রাজপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে চলে গেছেন। এদের মধ্যে কারও কারও বংশধররা এখনও আরাকানে বসবাস করছেন। রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনকল্পে বোমাং রাজের পুত্রকে বোমাং করার রীতি পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে কোনো বোমাং রাজের মৃত্যু হলে বোমাং রাজপরিবারের জীবিতদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ও উপযুক্ত ব্যক্তিই পরবর্তী বোমাং হন। রাজ প্রথা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার নতুন রাজার হাতে বোমাং রাজপরিবারের ঐতিহ্যের প্রতীক রাজকীয় তরবারি হস্তান্তর করে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন।

গত ২৪ এপ্রিল ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল্লাহ রাজ প্রথা অনুযায়ী নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৭তম রাজা উ চ প্রুর হাতে তরবারি হস্তান্তর করে তাঁকে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন। এর আগে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে বিভাগীয় কমিশনারের হাতে রাজকীয় তরবারিটি তুলে দেন ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য বোমাং রাজা চ হ্লা প্রু জিমি।

বোমাং সার্কেল
ট্যাক্স আদায়ের সুবিধার্থে ব্রিটিশরা ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সার্কেলের সীমানা চিহ্নিত করে। পরে ‘চিটাগং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন-১৯০০’ এর মাধ্যমে এই সার্কেলগুলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সার্কেলের মধ্যে বোমাং সার্কেল অন্যতম। বোমাং সার্কেলের চিফ হচ্ছেন বোমাং রাজা। বান্দরবান জেলার ৯৫টি মৌজা এবং রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার ৯টি ও কাপ্তাই উপজেলার ৫টি মৌজাসহ মোট ১০৯টি মৌজা নিয়ে বোমাং সার্কেল গঠিত। সাধারণত কয়েকটি পাড়া বা গ্রাম নিয়ে একটি মৌজা গঠিত। প্রতিটি মৌজায় একজন করে সার্কেল চিফের প্রতিনিধি আছেন। যিনি প্রশাসনিকভাবে হেডম্যান হিসেবে পরিচিত। সার্কেল প্রধানের সাথে পরামর্শ করে জেলা প্রশাসক হেডম্যানদের নিয়োগ দেন। আর পাড়া বা গ্রামগুলোতে থাকেন একজন করে কারবারী। যারা ট্যাক্স আদায় এবং সামাজিক বিচার-শালিসে হেডম্যানকে সহায়তা করেন। কোনো বিচার বা শালিসের বিষয়ে হেডম্যান সমাধান দিতে অপারগ হলে সার্কেল চিফ তার সমাধান দিয়ে থাকেন। সার্কেল চিফ সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠ এবং তাদের নিজস্ব রীতিনীতিতে অভিজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে বিচার কার্য পরিচালনা করেন।

রাজপুণ্যাহ
রাজপুণ্যাহ হচ্ছে সার্কেল চিফের ট্যাক্স আদায়ের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন মৌজার হেডম্যান-কারবারীগণ রাজপুণ্যাহতে অংশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ট্যাক্স সার্কেল চিফের হাতে তুলে দেন। তবে এই অনুষ্ঠান শুধু ট্যাক্স আদায়ের মধ্যে সীমাবব্ধ থাকে না। সার্কেল চিফ তথা রাজার সাথে প্রজাদের দেখা সাক্ষাতের এক সুবর্ণ সুযোগ এই রাজপুণ্যাহ। তাই প্রজাদের পক্ষ থেকে হেডম্যান-কারবারীগণ ট্যাক্সের পাশাপাশি নানারকমের উপঢৌকন দিয়ে রাজাকে খুশি করেন এই অনুষ্ঠানে। অন্যদিকে রাজার পক্ষ থেকে প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্যও থাকে নানা আয়োজন। যাত্রা, সার্কাস, বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট নাচ-গান-নাটক, ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রীর মেলাসহ নানারকমের বিনোদনমূলক আয়োজন থাকে। সাধারণত ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারি মাসে আয়োজন করা হয় রাজপুণ্যাহ। কয়েকদিন ধরে চলে এই অনুষ্ঠান। রাজকীয় সাজসজ্জা আর বিউগলের সুরে মুখরিত থাকে রাজপুণ্যাহর দিনগুলো। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে সাক হ্ন ঞো বোমাংগ্রী  প্রথম রাজপুণ্যাহর আয়োজন করেছিলেন।

বর্তমানে শুধু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষই নয় বরং রাজপুণ্যাহকে ঘিরে মেতে উঠেন সকলেই। দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও হাজার হাজার মানুষ রাজপুণ্যাহ দেখতে ভিড় করেন বান্দরবানে। প্রতিবছর রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠানে যোগদেন অনেক বিদেশি পর্যটকও। পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর দুই সার্কেল তথা চাকমা সার্কেল এবং মং সার্কেল প্রধানগণ নিয়মিত রাজপুণ্যাহর আয়োজন করেন না। ফলে বান্দরবান বোমাং সার্কেল চিফের রাজপুণ্যাহই এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একমাত্র রাজকীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

তথ্যসূত্র
১.      পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, জামাল উদ্দিন, বলাকা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১১।
২.      রাঙ্গামাটি বৈচিত্র্যের ঐকতান, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক ড. জাফর আহমেদ খান সম্পাদিত, এপ্রিল ২০০৪।
৩.      পার্বত্য জেলা আইন সংকলন, জেলা প্রশাসন : খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, ১ম সংকলন নভেম্বর ২০০৫।
৪.      খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ইতিহাস, প্রভাংশু ত্রিপুরা, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০০৬।
৫.      আমিনুল ইসলাম বাচ্চু সম্পাদিত, ১৬তম বোমাংগ্রী উ ক্য সাইন প্রু চৌধুরীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারি ২০১৩।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment
আরও পড়ুন