বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী প্রসঙ্গ

11900089_735987773195160_1612695082063932755_n

তৌহিদ আলম:
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা, যা বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের দশ ভাগের একভাগ। ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পার্বত্য এলাকায় বাঙালিসহ বসবাস করছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ১৪-১৫ লাখ মানুষ। এ এলাকার জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দেয়ার জন্য বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল সদা তৎপর রয়েছে। এমনকি একশ্রেণির প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার সংস্থা এবং এনজিও কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণির প্রভাবশালীরা স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যাচার করছে।

প্রতি বছরের মতো এবারও ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালিত হয়েছে। এই দিবসটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চলে বেশ ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে। এ দেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উপজাতীয় জাতিসত্তাগুলো আমাদের অংশ, বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাদেশি। এ দেশের সম্পদ অর্জনে এবং সমৃদ্ধি, সৌহার্দ্য সবকিছুতেই তাদের রয়েছে সমান অধিকার। কিন্তু তারা কোনোক্রমেই এ দেশের আদিবাসী হতে পারে না। কেননা, এটা নিতান্ত অযৌক্তিক ও ভুল তথ্য।

উপজাতিদের ঐতিহাসিক অভিবাসন, পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের প্রেক্ষাপট, আইএলও কনভেনশন ১০৭ এবং ১৬৯-এর আলোকে বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতি যাদের দাবির যৌক্তিকতা, সরকারের অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয়াদির তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ প্রবন্ধে তুলে ধরা হবে আদিবাসী কারা- বাঙালি না উপজাতিরা? আর উপজাতিরা যদি আদিবাসী না হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদযাপনের যৌক্তিকতা বা গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

উপজাতি এবং আদিবাসী বলতে ইংরেজিতে indigenous people বা Aboriginals বলে উল্লেখ করা হয়। উপজাতি হলো  tribe, এটা উপনিবেশিক শব্দ। আমাদের দেশে বাঙালি মূলধারার বাইরে যারা আছে তারা আদিবাসী নয়। তারা মূলত Ethnic বা নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী।

নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় আদিবাসী বা Aboriginals হচ্ছে কোনো অঞ্চলের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা son of the soil. প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী, আদিবাসী হচ্ছে কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।

বাংলাদেশের উপজাতি তথা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা এ দেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয়। তার প্রমাণ প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ RHS Huchenson (1906) , TH Lewin (1869)  (১৯০৬) , J.Jaffa  (১৮৬৯) , অমরেন্দ্র লাল খিসা (১৯৯৬), এবং ­­N Ahmed   (১৯৫৯) প্রমুখের লেখা গবেষণাপত্র, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। তারা সবাই একবাক্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতির নিকট অতীতের কয়েক দশক থেকে নিয়ে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এদেশে স্থানান্তরিত হয়ে অভিবাসিত হওয়ার যুক্তি, প্রমাণ ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

খোদ চাকমা পণ্ডিত অমরেন্দ্র লাল খিসা অরিজিনস অব চাকমা পিপলস অব হিলট্রেক্ট চিটাগাং-শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তারা এসেছেন মংখেমারের আখড়া থেকে পরবর্তীতে আরাকান এলাকায় এবং মগ কর্তৃক তাড়িত হয়ে বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করে। আজ থেকে আড়াইশ’-তিনশ’ বছর পূর্বে ছড়িয়ে পড়ে উত্তর দিকে রাঙ্গামাটি এলাকায়।’ এর প্রমাণ ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি প্রকাশিত দি অরিয়েন্টাল জিওগ্রাফার জার্নাল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান লোকসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাঙালি এবং বাকি অর্ধেক বিভিন্ন মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে উপজাতি জনগোষ্ঠীর বাইরের ভূমিপুত্র বাঙালিরা বসবাস করে আসছে। তবে জনবসতি কম হওয়ায় বিভিন্ন ঘটনার বা পরিস্থিতির কারণে আশপাশের দেশ থেকে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর লোকজন এসে বসতি স্থাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জাতি ব্যতীত অন্য সকল উপজাতীয় গোষ্ঠী এখানে তুলনামূলকভাবে নতুন বসতি স্থাপনকারী। এখানকার আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ম্রো, খ্যাং, পাংখো এবং কুকিরা মূল কুকি উপজাতির ধারাভুক্ত। ধারণা করা হয়, এরা প্রায় ২ থেকে ৫ শত বছর আগে এখানে আগমন করে। চাকমারা আজ থেকে মাত্র দেড়শ’ থেকে ৩শ’ বছর পূর্বে মোগল শাসনামলের শেষ থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। (খবরিহ ১৮৬৯). প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং ব্রিটিশ প্রশাসক টি এইচ লিউইনের মতে,A greater portion of the hill tribes at present living in the Chittagong Hill Tracks undoubtedly came about two generations ago from Aracan. This is asserted both by their own traditions and by decords in Chittagong collectorate. (Lewin, 1869, p-28)। পার্বত্য অঞ্চলের মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী ১৭৮৪ সালে এ অঞ্চলে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং আধিপত্য বিস্তার করে (Shelley, 1992 and Lewin 1869). এরা ধর্মে বৌদ্ধ মতাবলম্বী। এরা তিনটি ধারায় বিভক্ত। যেমন : জুমিয়া, রোয়াং ও রাজবংশী মারমা।

বোমরা মিয়ানমার-চীন পর্বত থেকে নিয়ে তাশন পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চল থেকে চট্টগ্রামে আগমন করে। খ্রিস্টান মিশনারি তৎপরতার ফলে এদের অধিকাংশই বর্তমানে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। লুসাইরাও এখন অধিকাংশই খ্রিস্টান। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য একটি বড় জনগোষ্ঠী মুরং। এদের বেশির ভাগই এখন পর্যন্ত প্রকৃতি পূজারী এবং এদের কোনো ধর্মগ্রন্থও নেই। চাকমারা এখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও ভাষার দিক দিয়ে তারা ত্রিপুরা, মারমা বা অন্য যে কোনো পার্বত্য জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের ভাষা এখন অনেকটা বাংলা ভাষার কাছাকাছি। মারমাগণ আরাকানী বর্মীয় উপভাষায় কথা বলে এবং ত্রিপুরাগণ ত্রিপুরি তিব্বতিধর্মী উপভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনারি ও সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের ধর্মপ্রচারে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তসংলগ্ন মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরার বেশিরভাগ উপজাতীয় জনগোষ্ঠী খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে এসব বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্ট ধর্মের ছত্রছায়ায় একত্রিত করে বঙ্গোপসাগরের উত্তরাংশে বাংলাদেশ-ভারতের এই পার্বত্য ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-পূর্বাশে যুক্তরাষ্ট্রে ও পাশ্চাত্য শক্তি ইসরাইলের মতো একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আদিবাসী বিষয়ে আভিধানিক সংজ্ঞার বাইরে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটি সংজ্ঞা আমরা পেয়ে থাকি। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও এর অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত প্রধানত তিনটি চার্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এগুলো হলো,  ১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অধিভুক্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৪০তম অধিবেশনে প্রদত্ত indigenous and Tribal populations Convention, 1957 (No. 107), আইএলওর ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169),  এবং ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইর্য়কে জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples. এখানে আইএলওর প্রথম চার্টার দুটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চার্টার দুটির শিরোনাম হচ্ছে, Indigenous and Tribal Populations Convention. অর্থাৎ আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী বিষয়ক কনভেনশন। অথচ বাংলাদেশে এই চার্টারকে আদিবাসীদের জন্য এক্সক্লুসিভ করে উপস্থাপন করা হয়।

এখানে উপজাতি ও আদিবাসীদের জন্য আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। | Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (169)-এর আর্টিকেল ১-এর (ধ) তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, Tribal peoples in independent countries whose social cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulation. অর্থাৎ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদের উপজাতি বলা হয়। এখন আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও অন্যান্য সাব-স্পসিসসমূহের সাথে বিচার করি তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায়- এরা উপজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী আইএলও কনভেনশনের আর্টিকল-১ এ উপস্থাপিত ট্রাইবাল ডেফিনেশনটি সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু ইনডিজিন্যাসের সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করেন। এখানে আমরা ইনডিজিন্যাসের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করব। Indigenous and Tribal peoples Convention, 1989 (No. 169)-এর আর্টিকেল ১-এর ((b)-তে ইনডিজিন্যাস বা আদিবাসী সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, peoples independent countries who are regarded as indigenous on account of their descent from the populations which inhabited the country, or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonization or the establishment of present state boundaries and who, irrespective of their legal status, retain some or all of their own social, economic, cultural and political institutions. অর্থাৎ আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া ও উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করছে। এবং যারা তাদের কিছু বা সকল নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনেতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ধরে রাখে। আইএলও কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী সংজ্ঞার মূল পার্থক্য হচ্ছে, নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার বা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি এক। অর্থাৎ একজন উপজাতি আধিবাসী হবেন বা হবেন না উপরোক্ত শর্তের ভিত্তিতে। এছাড়াও রয়েছে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples  চার্টার। একটি এক্সক্লুসিভলি আদিবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, উপজাতিদের নয়।

এখন বিবেচনা করা যাক, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসমূহ বাংলাদেশের বর্তমান ভূখ- অধিকৃত হওয়ার পূর্ব থেকে বা প্রি-কোলানিয়াল কিনা? তবে এ আলোচনার পূর্বে একটি বিষয় নির্ধারণ করা জরুরি যে, বিবেচনাটি কি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উপর হবে, না বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক হবে। কারণ অঞ্চলভিত্তিক হলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যিনি প্রথম বসতি স্থাপন করেছেন তিনিও বাংলাদেশের আদিবাসী এবং আগামীতে যদি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে নতুন কোনো দ্বীপ সৃষ্টি হয় সেই দ্বীপে যারা বা যিনি নতুন বসতি গড়বেন তিনিও আদিবাসী হবেন। একইভাবে ঢাকার আদি বাসিন্দা যারা তারাও বাংলাদেশের আদিবাসী এবং যে সকল উপজাতি ঢাকায় নানাভাবে স্যাটেল করেছেন, তারা স্যাটেলার। কারণ এই সংজ্ঞার উপাদানগুলো ইংলিশ OR  শব্দ দ্বারা বিভক্ত। আর যদি সমগ্র বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ধরা হয়, তবে বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশকারী হচ্ছে আর্য জাতি। আর্যরা উত্তরবঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। তখন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চাকমা, মারমা, গারো, হাজং, সাঁওতাল কারো অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ আর্যদের আগমনের পূর্বে এখানে যে অনার্য জনগোষ্ঠী বসবাস করতো তারা প্রি-কোলানিয়াল। আর্যদের আগমণের পূর্বে এখানকার অনার্য বাসিন্দারা প্রাকৃত ধর্মের বিশ্বাসী ছিল। আর্যদের প্রভাবে তারা সনাতন ধর্ম গ্রহণ করে। পরে হিন্দু রাজাদের নিকট থেকে বাংলা বৌদ্ধ রাজাদের দখলে যায়। বাংলাদেশে বৌদ্ধদের ইতিহাস সমৃদ্ধির ও গৌরবের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের আদি পুস্তক চর্যাপদ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। পাল রাজারা বাঙালি ছিলেন, যেমন ছিলেন মহামতি অতীশ দীপঙ্কর। বাংলায় বৌদ্ধদের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস এক নয়।

এখন খুব সংক্ষেপে আইএলও কনভেনশনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্য, আইন ও রাজনৈতিক বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা যাক। বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীগুলো শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক ও আইনি কাঠামো মেনে চলছে না। একই সাথে পরিবর্তন এসেছে ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ধারাতেও। রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে। শুরুতেই চাকমাদের নিয়ে কথা বলা যায়। চাকমাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক কাঠামো কোনো কালে ছিল বলে ইতিহাসে প্রমাণিত নয়। বর্তমানে চাকমারা প্রাচীনকালের বিভিন্ন চাকমা রাজার নানা বীরত্বগাঁথার কথা বলে থাকেন। চাকমাদের লেখা বইতেই বলা হচ্ছে, এগুলো কিংবদন্তি। কিংবদন্তি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে কিন্তু ইতিহাস হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত নয়।

মোগল আমলে বিভিন্ন মুসলিম নামধারী চাকমা রাজার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু তারা মোগল সুবাদার, চাকমা নয়। চাকমারা তাদের রাজা মেনে নিয়েছিল ও মানতে বাধ্য হয়েছিল। আজকের চাকমা রাজার কাঠামোটি ব্রিটিশদের দেয়া। এর প্রকৃত নাম সার্কেল চিফ। কার্যত তা কালেক্টর বা প্রধান খাজনা আদায়কারী। মোগল বা ব্রিটিশরা তাদের রাজা বলে কোনো সনদ দেয়নি। ব্রিটিশ সরকার সমতলের জমিদারদের জমিদারী বা প্রধান খাজনা আদায়কারী। মোগল বা ব্রিটিশরা তাদের রাজা বলে কোনো সনদ দেয়নি। ব্রিটিশ সরকার সমতলের জমিদারদের জমিদারী দিলেও সার্কেল চিফদের জমির মালিক ছিল ডিস্ট্রিক্ট সুপারিনটেনডেন্ট তথা সরকার। কিন্তু খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে চাকমা সার্কেল চিফ নিজেকে সামন্ত রাজায় পরিণত করেন খাজনা আদায়ের নানা আচার যোগ করে। সাম্যবাদী এমএন লারমা শুরুতে এই সামন্ততন্ত্রের শোষণ থেকে উপজাতীয় জনগণকে মুক্তি দিতে সমাজতান্ত্রিক (বামধারা) আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধান ইতিহাসের গতি পাল্টে দিলেও সন্তু লারমা ও দেবশীষ রায়ের সেই দূরত্ব এখনো বিদ্যমান ভেতরে ভেতরে। কিন্তু এমএন লারমার প্রতিষ্ঠিত জেএসএস বা পরবর্তীকালের ইউপিডিএফ কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কাঠামো নয়, এটি অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো। তাছাড়া সকল উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরাই এখন বিএনপি, আওয়ামী লীগের মতো বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতির সাথে জড়িত। এভাবেই চাকমা সমাজেরও নানা পরিবর্তন এসেছে।

অন্যদিকে উপজাতীয় সংস্কৃতি প্রধানত ধর্ম থেকে উৎপন্ন কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা বাদে অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী গড়ে ৯০ ভাগ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। মারমা ও ত্রিপুরাদের মধ্যেও প্রায় ৫০ ভাগ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। চাকমাদের ক্ষেত্রে এই হার কিছুটা কম। কিন্তু চাকমাদের আদি ধর্ম বৌদ্ধ নয়। ব্রিটিশ আমলে রানী কালিন্দী রায়ের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার আগে চাকমা রাজারা মুসলমান ছিলেন। মোগল আমলের পূর্বে তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করত। এভাবে ধর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, আচার-রীতিতে পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রভাবেও পাল্টে গেছে জিবন যাপনও। কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া নাগরিক ও সচ্ছল উপজাতিদের নিজস্ব পোশাকের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। সেখানকার মিশনারিরাও ধর্মান্তরিত উপজাতিদের পূজা-অর্চনায় বাধা দেয় না, আদিবাসী তকমা ধরে রাখার জন্য।

নিজস্ব বর্ণমালার কথা বলে যদি কেউ বাংলা বর্ণমালা বর্জন করে তাহলেও আদিবাসী বলে আখ্যায়িত করার কোনো কারণ নেই। যদি আদিম পদ্ধতিতে জীবন যাপনের কথা বলা হয়, তাহলে পৃথিবীর আদিম পেশা হচ্ছে কৃষি ও শিকার। সে বিচারে বাংলার কৃষক ও জেলেদের আদিবাসী বলতে হয়। এক কথায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিচারেও বাংলাদেশের উপজাতিরা আদিবাসী নয়।

চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে যারা উস্কে দিতে চায় তারা জানেন না যে, এখানে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও জাতি তাত্ত্বিক তিন দিক থেকে অভিবাসী। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানকার আদিবাসী ও বাঙালিরা অন্যান্য বাঙালি নাগরিকের মতো এ ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর সদস্যরাও বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশি। তারাও প্রত্যেক বাংলাদেশির মতো সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব তাদেরও। বনজসম্পদ, গ্যাসসহ বিভিন্ন খনিজসম্পদ, পানিসম্পদ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অফুরন্ত সম্পদের ভাণ্ডার এ এলাকায় পর্যটন শিল্প, স্কুল-কলেজ নির্মাণ, হাসপাতাল, বিভিন্ন একাডেমি, ক্যাডেট কলেজ ও মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করে আরও ব্যাপক জনবসতি গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার উন্মুক্ত হবে।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন