বম সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করছেন তরুণ মিউজিক মাষ্টার ডানিয়েল
রুমা (বান্দরবান) প্রতিনিধি :
নিজের লেখা গান, নিজেই সুর দিয়ে স্ব-কন্ঠে গান পরিবেশন করা বিশেষত্বই আলাদা। এর স্বাদ অন্য লোকের কাছে ব্যাখ্যা করে বলা অসম্ভব। মনের এক অনুভূতির বিষয়। তবে ধর্ম, জাতি ও দেশের নতুন প্রজন্মের জন্য গান লেখা ও সুর দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে নিজেরই সুর দেয়া ১১টি গান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন হচ্ছে। ধর্মীয়, আধুনিক ও দেশাত্ববোধক মোট চারটি গান রেকর্ড হয়েছে। তার মধ্যে একটি বিদেশে, মিজোরামে এক টিভি চ্যানেল-Doordarsun স্টুডিও-এ। তবে আমার সব গান কুকি-চিনভুক্ত বম ভাষায় লেখা। আমার লেখা গানে-সুরে নৃত্য পরিবেশন করবে নৃত্য শিল্পীরা, এটাই আমার ইচ্ছা। প্রয়াস।
কথাগুলো বলেছেন ডানিয়েল লাল ঙাইজুয়াল বম। সে একাধারে তরুণ শিল্পী, গান লেখক ও সুরকার। নিজের লেখা গানে নিজেই সুর দেন। সম্প্রদায় হিসেবে বম জাতিভূক্ত। সংগীত অঙ্গনে বম সমাজ তথা সমগ্র রুমা উপজেলায় সবার কাছে অতি পরিচিত শিল্পী ডানিয়েল বম।
বৃহস্পতিবার(১৪ জুলাই) দুপুরে রুমা সদরে জাইঅন পাড়া এলাকায় বসে তার ইচ্ছা-অনুভূতি, সাফল্য-প্রতিবন্ধকতা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এক খোলামেলা আলাপ চারিতায় ডানিয়ে বম জানান, তিনি পেশায় এখন একজন মিউজিক ডিরেক্টর। রুমা চাইল্ড স্পন্সরশীপ প্রোগ্রামে কর্মরত। এ প্রতিষ্ঠানে শতাধিক শিক্ষার্থীকে মিউজি ও সংগীত চর্চায় দেখাশুনা করেন। তাছাড়া “শিপ্পী ব্যান্ড” র একজন সক্রিয় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
নিজের গান নিয়ে শিল্পী ডানিয়েল বলেন, শিক্ষার্থী তথা মানুষের শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহ ও উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে শিক্ষামূলক আমার লেখা একটি গান খুব আনন্দের সাথে উপভোগ করছে শ্রুতারা। এ গানটি একক বা দলীয়ভাবে পরিবেশন করছে অন্য শিল্পীরা। ২০১৩ সালে শীতকালে রুমা পাইন্দু ইউনিয়নে আরথাহ পাড়ায় কেন্দ্রীয় বম যুব কল্যাণ সংস্থা(সি-ওয়াই.বি.এ) সম্মেলন আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। আগত অসংখ্যক শিল্পীদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন নৃত্যও পরিবেশিত হয়। ততোক্ষনে উপস্থিত দর্শকরা ঝিমিয়ে পড়ল। তারপর ডাক এল আমার। কোনো পর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই নিজে লেখা ও সুর দেয়া এগানটি নিজেই পরিবেশন করলাম। ওঠে দাঁড়িয়ে সবাই আনন্দে-নেচে মেতে ওঠেছিল উপস্থিত দর্শকরা। এতে নিজেও আনন্দবোধ করি।
শৈশবকাল নিয়ে ডানিয়েল বম বলেন, আমি যখন নিজ জন্মস্থান দুর্গম রনিন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বাড়িতে একটি গিটার ছিল। যা ছিল উচ্চতায় আমার সমান। কিন্তু ওজনে ছিল হালকা, তাই সুযোগ পেলে গিটার বাজিয়ে ইচ্ছেমতো গান করতাম। ছোটবেলা থেকে গান করা আমার খুব পছন্দ। তখন থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি গানের চর্চাও শুরু। চর্চা চলে কলেজ জীবনে। তবে অন্য বিষয় অপেক্ষায় গানের মিউজিক আমার মনকে টানে বেশি। এর মধ্যে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া ২০০৮ সালে বান্দরবান সদর উপজেলায় হেব্রন পাড়ায় একটি সম্মেলনে গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেকজনের মধ্যে আমি দ্বিতীয় স্থান লাভ করি। এ সফলতা গানের জগতে প্রবেশের আমাকে আরো উৎসাহিত করে।
কিন্তু গান করতে গিয়ে দেখা যায় বমদের নিজস্ব গান খুব কম। বেশির ভাগ গান লাইমি ও মিজোরামের মিজোদের গান। ওইসব গানের কথা অনুবাদ করা, সেসব গান আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করছি। তাই নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে আমার গান লেখার এ প্রয়াস। লেখা শুরু করি- ২০০৯ সাল থেকে।
গেল সময়ে তার প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এ তরুণ সুরকার ডানিয়েল বলেন ২০০৮সালে বান্দরবানের লাইমি পাড়ায় ইউএনডিপি‘র একটি অনুষ্ঠানে শিল্পীরা নাচ-গান প্রস্তুতি চলে। ঠিক তখন সংবাদ এলো যে, অন্য কোনো জাতির অনুবাদ করা গান ও নৃত্যের অনুকরণ করা যাবে না। তাই বম সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব গান ও নৃত্য পরিবেশন করতে গিয়ে- হলো বিপত্তি। বমদের তো নিজস্ব নৃত্য ও গান তেমন নেই। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী বলতে বমদের শিং ও বাঁশ নৃত্যসহ ক‘টি গান করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়েছে। এটি আমার সাধারণ অভিজ্ঞতা।
সামনে আগানোর স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও উৎসাহের সম্পর্কে মিউজিক ডিরেক্টর ডানিয়েল বম আরো বলেন, এ প্রজন্ম ও নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে বিশেষ করে নৃত্যের গান লেখা শুরু করছি। শুধু তাই নয়। ধর্মীয়, দেশাত্ববোধক ও আধুনিক গানও সমানতালে লিখছি। আশা করি, আমার নতুন গানগুলো শিল্পী-দর্শকরা পছন্দ করবেন। কেননা, বমদের নতুনত্ব নিজস্ব নৃত্য উন্নতি হলে বম জাতি হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য গন্ডি ও স্বকীয়তার পরিচিতি আরো বৃদ্ধি পাবে। এসব কর্ম সম্পাদনের পিছনে প্রবীণ লেখক ও উন্নয়ন কর্মী জিরকুং শাহু ও সংগীত শিল্পী বন্ধু মার্টিন, পাহিম ও মিল্টন এর অনুপ্রেরণার কথাও উল্লেখ করেন ডানিয়েল বম। তবে মার্টিন ছাড়া অন্য তিনজন উচ্চতর ডিগ্রী নিতে বিদেশে রয়েছে।