পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি স্পষ্ট

পাহাড়ি-সন্ত্রাসী

আসাদুজ্জামান সম্রাট:

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আন্দোলনে অস্ত্র হাতে সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে জনসংহতি সমিতির যে ক’জন কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রাণ দিতে হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে। রোববার রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইউপিডিএফ-এর তিন কর্মী খুন হলেও শান্তিচুক্তি পরবর্তী ১৭ বছরে এই তিন সংগঠনের ৭শ’ ৬৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। যার সঙ্গে রোববার যুক্ত হয়েছে আরও তিনটি নাম।

১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর সশস্ত্র সংগ্রামরত জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তিচুক্তি পরবর্তী তাদের সশস্ত্র যোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও ওই চুক্তির বিরোধিতা করে তাদের একাংশ গঠন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। যার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন থাকায় ক্রমেই শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে প্রায়শই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। জনসংহতি সমিতির এক সময়ের কয়েকজন শীর্ষ নেতার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপ। এ গ্রুপটিতে সন্তু লারমার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতাকারী এবং চুক্তি পরবর্তী সুবিধাবঞ্চিতরা যোগ দেয়। ফলে এরও একটি শক্তিশালী ভিত্তি সৃষ্টি হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী ১৭ বছরে ইউপিডিএফ আর সন্তু লারমাপন্থী জেএসএস কর্মীদের গুলিতে নিহত হন অন্তত ৭শ’ ৬৬জন। এর মধ্যে ৪৩৩জন জেএসএস এবং ২৯৬ জন ইউপিডিএফ কর্মী। অবশিষ্টরা বাঙালি ও জেএসএস-লারমা গ্রুপের। রোববারের ৩ জন নিয়ে এ পর্যন্ত ইউপিডিএফ-এর নিহত কর্মী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯৯ জন। অথচ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ৪৫০ জনের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন সেখানে পূনর্বাসিত বাঙালি সেটেলাররা। শান্তিবাহিনীর অল্প কিছু সংখ্যক কর্মী সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে নিহত হন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে ইউপিডিএফ-কে এখনও এমএন লারমাপন্থী জনসংহতি সমিতির সঙ্গে কোন সংঘর্ষে জড়ানোর ঘটনা শোনা যায়নি। তবে সন্তু লারমাপন্থী জনসংহতি সমিতির সঙ্গে এমএন লারমাপন্থী জনসংহতি সমিতির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এই সংগঠনটি সবসময়ই পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিবেশের জন্য সন্তু লারমাকে দায়ী করে আসছেন।

ইউপিডিএফ-এর মুখপাত্র বাবুল চাকমা বলেছেন, জুম্মজাতির অধিকার আদায়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে আসছি। এ আহ্বানটি জনসংহতি সমিতির প্রতিও আমাদের ছিল। কিন্তু সন্তু লারমার একগুয়েমির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ নরকে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে জেএসএসএস-এর হামলায় আমাদের ৩৩ নেতা-কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছে। যার মধ্যে মহিলাও রয়েছেন। সন্তু লারমা পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন আবারও অস্ত্র হাতে নেবেন। সরকার ও প্রশাসনের সহায়তায় তারা জুম্মজাতির অধিকার পালিত করে সেই অস্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। আমরা সশস্ত্র আন্দোলনে নয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী।

জুম্ম অধিকারের নামে এ তিনটি সংগঠনের প্রতিনিয়ত নৃশংস ঘটনায় তিন পার্বত্য জেলা সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিদের কাছে আতঙ্কের একটি নামে পরিণত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোন আইন চলে না। আর এ নিয়েই মূলত: সংঘাত-সংঘর্ষ। ২০১২ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন-অপহরণ-ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি বাড়তে থাকে। যার সূত্রপাত হয়েছিল ৩ ও ৪ জুলাই খাগড়াছড়ির দুর্গম এলাকা নাইক্ষ্যাংছড়িতে দু’টি সংগঠনের মধ্যে ৮ ঘণ্টা সংঘর্ষেও মধ্য দিয়ে। যাতে প্রাণ হারান ৪ জন। আহত হন অনেক কর্মী। পরের বছর ২৯ জুন রাতে প্রতিপক্ষের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সংস্কার গ্রুপের পানছড়ি উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুপন চাকমা ওরফে সাগর বাদশা। ১৪ জুলাই পানছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা) খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক অরুণ কান্তি চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে। ৫ জুলাই মানিকছড়ি-লক্ষীছড়ি সীমান্তে তিনট্যহরী ভোলাছলা পাড়ায় প্রতিপক্ষের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সন্তু লারমা গ্রুপের কর্মী ও সাবেক শান্তিবাহিনী সদস্য উমং মারমা। ৪ জুলাই পানছড়ি উপজেলার চেঙ্গী ইউনিয়নের দুর্গম পুজগাং এলাকায় ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পানছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক সমীরণ চাকমা ও জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের সদস্য জার্মান চাকমাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা এবং অস্ত্রের মুখে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্য শ্যামল চাকমাকে অপহরণ করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। ২ জুলাই দীঘিনালা উপজেলার পূর্ণচন্দ্র কার্বারীপাড়ার তাজটিলা এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এমএন লারমা গ্রুপের সদস্য মিঠুন চাকমাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল লক্ষীছড়িতে নারায়ণ লারমা (৩০) নামে (জেএসএসএম, এন লারমা) গ্রুপের কর্মী প্রতিপক্ষের ব্রাশফায়ারে নিহত হন এবং পানছড়িতে ১২ এপ্রিল ইউপিডিএফের দুই কর্মী নতুন কুমার চাকমা (৩৫) ও প্রতুলময় চাকমা (২৮) প্রতিপক্ষের ব্রাশফায়ারে নিহত হন।

পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি স্পষ্ট হলেও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এসব গ্রুপই অস্ত্র ব্যবহারের কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। বান্দরবান-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটির পাহাড়ে অস্ত্রধারী যুবকদের আনাগোনা এখন হরহামেশাই দেখা যায়। তাদের হাতে আছে এম-১৬, একে-৪৭ আর জি থ্রি রাইফেলের মতো মারাত্মক অস্ত্র-ও। এরা পালা করে পাহারা দেয় কিছু এলাকা। অথচ এক সময় এরকম অস্ত্র ছিল কেবল শান্তি চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ এর হাতে। বছর তিনেক আগে সন্তু লারমার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে গঠিত এমএন লারমাপন্থী জেএসএস কর্মীরাও এখন হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। কয়েকশ’ সশস্ত্র যুবককে নিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ার বিষয়টি গত বছর এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন জেএসএস সভাপতি ও প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা।

তিন পার্বত্য জেলার উন্নয়ন কাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন সেক্টর, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, চাকরিজীবী, অরণ্যের বাঁশ, কাঠ, পশু ব্যবসা, আবাদি জমি, বসতভিটা থেকে শুরু করে তৃণমূল হাটবাজারের সবজি বিক্রেতাও এ চাঁদার কবল থেকে মুক্ত নয় এখন। অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে জিম্মি করে সাধারণ মানুষকে চাঁদা দিতে বাধ্য করছে। অন্যথায় চালিয়ে যাচ্ছে হত্যা, অপহরণসহ নজিরবিহীন ধ্বংসাত্মক জঘন্য এসব ঘটনা।

জনসংহতি সমিতি জেএসএসের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজিব চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়ন হলেই এসব সমস্যার সমাধান হবে। অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের বিরুদ্ধে ইউপিডিএফের টিন অভিযোগ। আমাদের কোনো সশস্ত্র কর্মী নেই। আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন