পাহাড়ি বাঙ্গালী সম্পর্কের জটিলতা ও সম্ভাব্যতা
মমতাজ উদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশের এক দশমাংশ এলাকাজুড়ে সবুজ অরণ্যে গঠিত আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম। অন্তর্বিহীন মৌন নিস্তব্ধ সৌন্দর্য আর দিগন্ত বিস্তৃত গ্রন্থিল পাহাড়িকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক জটিল সমস্যার নাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কল্যাণে দেশের এই এক দশমাংশ এলাকাজুড়ে এখনো শান্তি বজায় রয়েছে। তবু পাহাড়ি- বাঙ্গালীর সম্পর্কের জটিলতা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও ঘটনার গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন।
ইতিহাসের পাতা থেকে
১৮৬০ সালের আগে পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার অংশ ছিল। ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা জেলার মর্যাদা লাভ করে। কালের প্রেক্ষাপটে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভাগ হয়ে গঠিত হয় তিন প্রশাসনিক জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। পৃথিবীতে জাতিগত বৈচিত্রে সৃষ্টি হয়েছে অনেক দেশ। আদি বাংলার অঙ্গভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে এমন কোন জাতি ছিল না যে, এটি তাদের স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসাবে রূপ নিতে পারবে। পার্বত্য এলাকায় অবস্থানরত বাঙ্গালীরা বহিরাগত হলে শান্তিচুক্তি পক্ষীয়দেরও বহিরাগত অভিধায় পড়তে হবে। ইতিহাস তার প্রমাণ দেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি অবস্থিত ত্রিপুরা রাজ্য, আসাম ও তার উত্তরাঞ্চল, লুসাই বা মিজোরাম অঞ্চল এবং মায়ানমার বা বার্মা থেকে উপজাতীয়রা আদি বাংলার অঙ্গভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় ঢুকে পড়েছে। যা তাদের ভাষা নৃতাত্তিক গঠন প্রভৃতিরই স্বাক্ষর বহন করে থাকে। ইতিহাসকে ভুলে কেউ সামনে অগ্রসর হতে পারে না। সুতরাং বাঙ্গালীদেরকে বহিরাগত বলে পাহাড়ি নেতাদের দাবী পূরণ করে পাহাড়ি-বাঙালী সম্পর্কে আদৌ কোন সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। বাস্তবতার নিরিখে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে।
পার্বত্য এলাকায় বিরাজমান সমস্যা একটি জাতীয় ইস্যু। এটিকে ছোট করে বা হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এর সমাধানের প্রক্রিয়ার প্রতি সমগ্র জাতির দৃষ্টি নিবদ্ধ। এ সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। পার্বত্য জনগণ ও রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা, সমস্যা সমাধানে পাহাড়ি নেতাদের ঔদ্ধ্যত্যপূর্ণ ব্যবহার, বাঙ্গালী বিদ্বেষী মনোভাব, সর্বোপরি পারস্পরিক আস্থার অভাব এবং সমতলভূমির সাথে পাহাড়ি জনগণের জীবন-জীবিকা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সৃষ্ট ব্যবধানের পরিণতিই বর্তমান সংকটের কারণ।
বিবাদের সূত্রপাত যেখান থেকে
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসনিকভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার মর্যাদা লাভ করে ১৯৮৩ সালে। পার্বত্য চট্টগ্রাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয় ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট। বৃটিশ আমলে ১৩টি উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনকার্য পরিচালিত হয়ে আসছিল ১৯০০ সালের হিল ম্যানুয়্যাল দ্বারা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এই হিল ম্যানুয়েল এডাপ্ট করেনি। এই ম্যানুয়ালে তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি ছিল এবং জমির উপর তাদের অধিকার প্রদান করা হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের একাধিক সিদ্ধান্ত উপজাতীয়দের ক্ষুব্ধ করে তোলে। কাপ্তাই বাঁধ অসংখ্য পার্বত্যবাসীকে ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করে এবং কাপ্তাই হ্রদে ডুবে যায় চাকমা রাজার প্রাসাদ। এতে তারা সংগত কারণেই বিক্ষুব্ধ হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য এমএন লারমা ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ১৯৭৩ সালে তারা সংগঠনের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী গঠন করে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়। শান্তিবাহিনী পাহাড়ি এলাকায় হত্যা, গুমসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যে লিপ্ত হয়। এই অবস্থার মোকাবেলার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ঐ এলাকায় প্রথম সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। শান্তিবাহিনীর আক্রমণে এ পর্যন্ত সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর প্রায় ৪ শতাধিক সদস্যসহ বিশ হাজার বাঙ্গালী নিহত হয়েছে বলে জানা যায়।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়ি-বাঙ্গালী, জাতি-উপজাতির পার্থক্য ভুলে যাওয়ার আহবান জানিয়ে রাঙ্গামাটির স্টেডিয়ামে নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দেন। পার্বত্য জেলার ত্রিদিব রায়কে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এতে উপজাতীয়রা আরো প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করেন। এমএন লারমার নেতৃত্বে বিক্ষিপ্তভাবে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে সন্তু লারমা আত্মগোপনে যান। সেই বছরের ২৬ অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৮০ সালে ছাড়া পান। ১৯৮১-তে একবার গ্রেপ্তার হয়ে মুক্ত হওয়ার পর আবার তিনি আত্মগোপন করেন। এদিকে এসময় সংগঠনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হয়। প্রাথমিকভাবে সমঝোতা হলেও ১৯৮২ সালে অপর গ্রুপের আক্রমণে নিহত হন মানবেন্দ্র লারমাসহ আটজন। এরপর দায়িত্ব নিয়ে সন্তু লারমা দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। সে বছর অনুষ্ঠিত সংগঠনের জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়, যার সভাপতি নির্বাচিত হন সন্তু লারমা। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সংগ্রামের পাশাপাশি সরকারের সাথে সংলাপের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ ১৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে এ চুক্তিটি সই হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল, দেশের সংবিধান অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। চুক্তির পর থেকে উপজাতীয়দের উচ্চাভিলাসি নেতা সন্তু লারমা গং দাবী করে আসছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চলের স্বীকৃতি দিয়ে বিশেষ শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। কিন্তু তার এ দাবী আমাদের সংবিধান সম্মত নয়। আমাদের সংবিধানে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলেছে। সংবিধানে কোন অঞ্চল বিশেষের জন্য আলাদা শাসনতন্ত্র তৈরীর সুযোগ নেই। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রতিটি সরকার দাবি করে এসেছে যে, চুক্তির বাস্তবায়ন কাজ এগোচ্ছে। বর্তমান মহাজোট সরকার চুক্তির শর্তানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অসংখ্যা সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারও করেছে।
তবে পাহাড়িদের মতে, চুক্তির মৌলিক বিষয়ের কোনোটিই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পরও অনেক পাহাড়ি পরিবারকে তাদের বংশ পরষ্পরায় ভোগদখল করা জমি বা বাগান থেকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এদিকে, বাঙ্গালিদের দাবী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনী অবস্থান অত্যন্ত যুক্তিসংগত। তাই শান্তিচুক্তি ও পাহাড়ি নেতাদের দাবী মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা বাহিনীর নিরাপত্তা ক্যাম্পগুলি সরালে দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি, নিরাপত্তা বিঘিœত হবে।
চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ
২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দেয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতা গ্রহণের পরও সরকার একথা একাধিকবার বলেছে। মহাজোট সরকার ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ গ্রহণও করেছে।
পাহাড়ে শান্তির অন্বেষায় এখন পর্যন্ত যা হয়েছে
চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে শান্তিবাহিনীর প্রায় দু’হাজার সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তখন তাদের প্রত্যেককে সরকার ৫০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। এর ফলে অবসান হয় পাহাড়ে প্রায় দুই দশকের শান্তিবাহিনী-সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী বন্দুক যুদ্ধের। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর চুক্তিটি মন্ত্রিপরিষদে পাস হয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১০০ দিনের মধ্যে যে কাজগুলো সম্পন্ন করার কথা ছিল, এর অংশ হিসেবেই গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ১৯৯৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ মে যথাক্রমে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন এবং ৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন পাস হয়। ১৯৯৯ সালের ৯ মে অন্তবর্তীকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পাহাড়ি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠিত হয়। সে বছরই সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে। এছাড়া জেএসএসের ৬৪জন ও প্রত্যাগত শরণার্থীদের ১৮৪ জনকে তাদের সরকারি চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। জেএসএসের ৬৭৫ জনকে পুলিশ কনস্টেবল ও ১১ জনকে ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
যা বাস্তবায়িত হয়নি
উপজাতীয় নেতাদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেওয়া এবং এ বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্ব এবং ক্ষমতা এখনো সীমিত। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এখনো সরকার দলীয় নেতাদের পুনর্বাসনস্থল। আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের নির্বাচনও করা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী তিন জেলার অস্থায়ী সেনাক্যাম্প সরানো প্রক্রিয়া শুরু করলেও উপজাতীয় নেতারা তাতে সন্তুষ্ট নন। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের প্রধান সমস্যা ভূমি বিরোধ ও ভূমিদখল। পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এখনো এ সমস্যার কোনো পরিপূর্ণ সমাধান হয়নি। শান্তিচুক্তির ৫ নম্বর শর্ত অনুযায়ী এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে ২০০১ সালে গঠন করা হয় ৯ সদস্যের পার্বত্য ভূমি কমিশন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ কমিশন আইনি সীমাবদ্ধতা, অর্থ ও লোকবল সংকটের কারণে ১০ বছরে কাজই শুরু করতে পারেনি। দফায় দফায় কমিশনের কাঠামোর রদবদল হয়েছে মাত্র। ১/১১’র পরে বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় নতুন ভূমি কমিশন। অন্য দুইজেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানে এর সাব-অফিসের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। খাদেমুল ইসলামের পর বিচারপতি আনোয়ারুল হককে নতুন চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রশাসন তিনভাবে বিভক্ত। ১. বেসামরিক প্রশাসন, ২. সামরিক প্রশাসন, ৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। এই তিন অংশের মধ্যে কার্যত: সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পুনর্বাসিত বাঙ্গালী
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পাকিস্তান সরকারের আমলে শুরু হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবানে অনেক বাঙ্গালীদের বসতি স্থাপন করে দেয়। ১৯৬৬ সনে আবার কয়েক হাজার বাঙ্গালীদের পুনর্বাসিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর পরই দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০ হাজার বাঙ্গালী পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৯৭৪ সালে এম.এন.লারমা পাহাড়িদের পক্ষে আন্দোলনে নামলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থিমিত হয়। ১৯৭৯ সালে সরকার গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে পুনরায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া আরম্ভ করে। ঐ বছরই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বিধিমালার ৩৪ নং বিধি সংশোধনের মাধ্যমে সেখানে পুনর্বাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীভূত করে। একই বছর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ হাজার বাঙ্গালী পরিবার পুনর্বাসিত হয়। এরপর ১৯৮০ সালের শেষের দিকে আরো ২৫ হাজার পরিবার পুনর্বাসিত হয়ে যায়। এভাবে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ৪ লক্ষ বাঙ্গালী পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত হয়। ১৯৮৬ সালের দিকে সরকারি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের দেওয়া হয় খাস জমি হিসেবে পাহাড় ও টিলা। পুনর্বাসিতদের প্রায় সবাই ছিলেন নদীভাঙা এলাকার এবং হতদরিদ্র।
পুনবার্সিত বাঙ্গালীদের বর্তমান অবস্থা
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিতে পাহাড়িদের শান্তির কথা বিবেচনা করা হলেও ভাবা হয়নি পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের কথা। হাজারো সমস্যার মধ্যে দিনাতিপাত করছে তারা। দুর্গম পাহাড়ে নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করছে পুনবার্সিত বাঙ্গালীরা। তাদেরকে ৫ একর জমি ও এককালীন অর্থ দেওয়ার কথা বলে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। কিন্তু তারা কেউই এক থেকে দেড় একরের বেশী জমি পায়নি। উপজাতিদের কাছে হরহামেশা নির্যাতিত বাঙ্গালীরা এখানে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদাও পাচ্ছে না। এখানে পাহাড়িরা শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙ্গালীদের উপর বিভিন্ন প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। ১৯৮০-৯১ সালের মধ্যে শান্তি বাহিনীর আক্রমণে ৯৫২ জন বাঙ্গালী নিহত হয়। পাহাড়ি বাঙ্গালীরা দুর্গম পাহাড়ে টিকে থাকতে না পেরে গুচ্ছগ্রামে বাস করে। গুচ্ছগ্রামেগুলোতে একটা ঘরই তাদের সম্বল। চিকিৎসা এবং স্যানিটেশন অবস্থা ভাল নয় । এরপরও এক খ- জমি তাদের ভাগ্যে জুটছে না। বাঙ্গালীদের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বসবাস সবকিছুর নিয়ন্ত্রক উপজাতি নেতারা। পার্বত্য এলাকায় বসবাস, ফসল লাগানো কিংবা বিক্রি করতে হলে জেএসএস, ইউপিডিএফসহ উপজাতিদের বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়।
দু’জনগোষ্ঠীর মাঝে বৈষম্য জিইয়ে রেখে শান্তি প্রক্রিয়া সম্ভব নয়
পার্বত্যাঞ্চলে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৮০ ভাগ চাকরির সুবিধা ভোগ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতিরা। বাকি ২০ ভাগ বাঙ্গালীদের জন্য। বাঙ্গালী পরিচয়ই যেন এখানকার সবচেয়ে বড় অভিশাপ। বার্ষিক বরাদ্দকৃত প্রায় ৯৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের মধ্যে ২০ হাজার মেট্রিক টন বিশেষভাবে বরাদ্দ করা হয় উপজাতিদের জন্য। অবশিষ্ট অংশ বন্টন করা হয় শরণার্থী, গুচ্ছগ্রাম ও উপজাতি অধূষ্যিত অঞ্চলের বিভিন্ন উন্নয়নে। এক্ষেত্রে বাঙ্গালিদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। উন্নয়ন বরাদ্দের শতকরা ৯০ ভাগ উপজাতিদের জন্য ব্যয় করা হয়। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের এ দুটি গুরূত্বপূর্ণ সরকারি দফতরের প্রধান কর্তারা উপজাতীয়। সে কারণেও দুটি সরকারি দফতর থেকে বাঙ্গালিরা কোনোরকম সুবিধাই পাচ্ছে না। সংবাদপত্র তথা মিডিয়া এবং দেশের বুদ্ধিজীবি শ্রেণী সবাই পাহাড়ীদের অধিকারের কথা তুলে ধরে। কিন্তু ৬,৫০,০০০ এরও বেশি পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের দু:খ ও কষ্টের কথা কেউ তুলে ধরে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত কতিপয় এনজিও’র কর্মপরিধিও ভ্রান্তিমূলক। যা পার্বত্য শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে সাংঘর্ষিক।
দেশের সংবিধান, মানবাধিকার ও যুক্তির খাতিরেই বলতে হবে পার্বত্য এলাকায় উপজাতী-বাঙ্গালীদের সহাবস্থান ও সমঅধিকার প্রয়োজন। পার্বত্য বাঙ্গালী-উপজাতীদের সমঅধিকারের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে।
সংবিধানের সমস্যা সমাধানের মূলমন্ত্র খুঁজতে হবে
সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলাদেশ এককেন্দ্রীক রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত। তাতে আঞ্চলিক শাসন ব্যবস্থার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। সংবিধানের ১৯(১) অনুসারে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। অনুচ্ছেদ ২৭ অনুসারে রাষ্টের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান অধিকার লাভকারী। অনুচ্ছেদ ২৮(১) অনুসারে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষের ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। অনুচ্ছেদ ২৯(১) উল্লেখ আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার থাকিবে’।
সমাপনী কথা
‘অসুয়া ভূষণ হয়ে ভর করে থাকে সুন্দরেই, নির্মল বায়ুর স্রোতে নীলাকাশে উড়ে যায় কাক।’ পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রক্রিয়া সৃষ্টিতে অসুয়াদের চিিহ্নত করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্মল নীলাকাশে সকলকে বেঁচে থাকার সুযোগ নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশ কেবল পাহাড়ী বা বাঙালি কারো একার রাষ্ট্র নয়; এখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতালসহ সকল জনগোষ্ঠীই সমমর্যাদার নাগরিক। এই উপলব্ধিই বাংলাদেশের সংহতি ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। পাহাড়ি বাঙ্গালীর সম্পর্কের জটিলতা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে একে অপরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেবহাল হতে হবে। নতুবা একে অপরের প্রতি সন্দেহ থেকে যাবে। সেই বোধের বিকাশ ভিন্ন পার্বত্য চট্টগ্রমের সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নেই। আসলে পাহাড়ি-বাঙালি সৌহার্দ্যই পার্বত্যাঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত। নীতিনির্ধারকদের অবহেলা, উপেক্ষা আর ভ্রান্ত পদক্ষেপ সর্বোপরি পাহাড়ি কতিপয় নেতাদের উদগ্র বাসনা পার্বত্যবাসীর মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তা সদাশয় সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় নিয়োজিত সেনা বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সারিয়ে তুলতে হবে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রক্রিয়া সৃষ্টিতে দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পদায়ন করতে হবে।
লেখক: সভাপতি, আলীকদম প্রেস ক্লাব
চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম আর এতদ অঞ্চলের অধিবাসীদের সম্পর্কে জানতে নীচে দেওয়া দুটি লিংক থেকে পড়ার জন্য লেখকের প্রতি অনুরোধ রইল।
কী তামশা!
লেখাটা একাবারে এক পাক্ষিক, সবিরোধি, বিভ্রান্তিকর এবং উদ্দেশ্য মুলক।
পাহাড়িদের আড়ালে বাঙ্গালীরা নেত্রেত্ব দিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করে পাহাড়ীদের ভাতৃঘাতী সংঘাত জিয়ে রাখা হয়েছে, বাঙ্গালীরা বাঙ্গালী অথবা পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের দ্ধারা সংঘতিত অপরাধ গুলি নিরিহ পাহাড়িদের উপর চাপিয়ে দিয়ে সাম্প্রাদায়িক ডাঙ্গা সৃষ্টি করে পাহাড়িদের ভিতেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে । কথায় আছে ধন ভাঙলে ধন পাওয়া যায়, মন ভাঙলে সেই মন পাওয়া যায় না। মন যা ভাঙছে, সব কিছুতেই সরকার এগিয়ে না আছলে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সরকার যদি চুক্তি অনুযায়ী পুর্ন বাস্তবায়ন করে তাহলে শান্তি ফিরিয়ে আসবেই আসবে। কারণ পার্বত্য জেলা পরিষদ গুলোতে বাঙ্গালীদের ও প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানে শুধু পাহাড়িদের অস্তিস্থ রক্ষার জন্য জেলা পরিষদ আইন গতিত হয়নি।আরো নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে লেখা প্রয়োজন ছিল। তারপরো শান্তি ফিরিয়ে আনতে যা লিখেছেন তারজন্য ধন্যবাদ জানাই।