নেরিকা জাতের ধান চাষে ভাগ্য খুলেছে বান্দরবানের জুম চাষীদের

bandarban-pic-1-6-10

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বান্দরবানের পাহাড়ে যে দিকে চোখ যায় সেদিকে জুমের পাকা ধান। দুর থেকে দেখলে মনে হয় সোনার চাদর মুড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। পাঁকা ধানের গন্ধ মৌ মৌ করছে চারিদিকে। পাহাড়ি পল্লীগুলোতে নেচে গেয়ে জুম উৎসবে মেতে উঠেছে জুমিয়ারা পরিবারগুলো। এ বছর থেমে থেকে বৃষ্টি হওয়ায় আশানূরূপ ফলন উৎপন্ন হয়েছে এবং ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খুশি জুম চাষীরা।

ধান কাটার আনন্দে মেতেছে ম্রো, বম, মারামা, চাকমা, খেয়াং সম্প্রদায়ের পাহাড়ী নারী-পুরুষরা। ঘরে বসে নেই শিশু কিশোর, আবাল বৃদ্ধরা। কাঙ্খিত সোনালী ধান ঘরে তুলতে পরিবার-পরিজন নিয়ে জুমিয়া পরিবারগুলো ব্যস্ত সময় পার করছেন। ফলন আশানুরূপ হওয়ায় দেবতার উদ্দ্যেশ্য উৎসর্গ ও নবান্ন উৎসব উদযাপন করেছে বিভিন্ন সম্প্রদায় নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে।

বৃহস্পতিবার জেলা সদরের কুহালং ইউনিয়নের লু সাই অং এর জুমের পাহড়ে ক্ষুদ্র নৃ-গাষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্দ্যোগে মারমা ভাষায় কক্সই পোয়ে: বা নবান্ন উৎসবের উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি।

এ সময় মারমা সম্প্রদায় তাদের ঐতিহ্য অনুসারে জুমের বিভিন্ন ফসলকে দেবতার উদ্দেশে প্রদান করে পূজা করে। অনুষ্ঠানে মারমা সমাপ্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা লোক সংগীত, লোক নৃত্য ও পরিবেশনের মাধ্যমে নবান্ন উৎসব পালন করে।

নবান্ন উৎসবে জেলা দীলিপ কুমার বণিক, পার্বত্য জেলা জেলা পরিষদের সদস্য সিইয়ং ম্রো, ম্রাচা খেয়াং, ক্য সা প্রু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী, ইউপি চেয়াম্যান সানু প্রু, ক্ষুদ্র নৃ-গাষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং,কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুকসহ পাহাড়ী নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পাহাড়ীদের আদিপেশা জুম চাষ। অধিকাংশ পাহাড়ি জুম চাষের মাধ্যমে সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ করে। এই জায়গায় প্রতিবছর জুম চাষ করা যায়না তাই প্রতি বছর নতুন নতুন পাহাড়ে জুম চাষ করতে হয়। জুমে ধানের সাথে মারফা, বেগুন, মরিচ, ঢেঁড়শ, কাকরোল, কুমড়াসহ মিশ্র ফল চাষ করে সারা বছরেরে খাদ্য সংগ্রহ করে রাখে জুম চাষীরা।

সরকার খাদ্য শষ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে বান্দরবান কৃষি সম্প্রসান অধিদপ্তর বীজ, সার ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে এবছর পরীক্ষামূলকভাবে জুমে খরা সহায়ক নেরিকা মিউট্যান্ট জাতের ধানচাষ করা হয়েছে। অন্য দিকে মাটির ক্ষয় রোধ করে একই জমিতে বার বার ফসল উৎপাদনের লক্ষে কৃষকদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন।

কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, সাধারণত একবছর জুমচাষ করার পরের কয়েক বছর সেই পাহাড়ে চাষ করা যায় না। একই পাহাড়ে বারবার চাষ করা যাবে এবং কম বয়সী খরা সহায়ক ও পানির ব্যবহার কম লাগে আফ্রিকার উগান্ডা থেকে আনা হয়েছে নেরিকা মিউট্যান্ট জাতের ধান। স্থানীয় জাতের থেকে নেরিকা দিগুন ধানের ফলন হয়েছে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

এবারে জেলার প্রায় ৮৯৬৭ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। এর মধ্য আউশ প্রণেদনা/২০১৬  নেরিকা জাতের ধান ১০৮ হেক্টর চাষ করা হয়েছে। চলতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই জুম থেকে পাকা ধানসহ রকমারি ফসল কাটতে শুরু করেছেন জুম চাষীরা।

উপসহকারী ক্যহ্লউ মার্মা জানান, আমার ব্লগে এক বিঘা করে ৫জন কৃষককে আউশ প্রণেদনা/২০১৬  নারিকা জাতের ধান চাষ করতে বিনামূল্যে ২০ কেজি বীজ ধান, ২০ কেজি ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি ২০ কেজী এবং আগাছা পরিস্কারের জন্য ৮০০ টাকা করে দেয়া হয়েছে। গত বছর কৃষকদের লাগানো স্থানীয় জাতের ধানের থেকে নতুন জাতের নেরিকা ধান চাষ করে হেক্টর প্রতি প্রায় ৫০ মন ধান উৎপন্ন হয়েছে বলে তিনি জানান।

জুম চাষী অংপ্রু মার্মা বলেন, আগে স্থানীয় জাতের ধান চাষ করতাম। এবছর কৃষি বিভাগের সহায়তায় নেরিকা জাতের ধান চাষ করে বাম্পার ফলন হয়েছে। এজাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করে আগামী বছর জুম চাষীদের কৃষি পণ্য বিনিময়ে নেরিকা জাতের ধানের বীজ সরবরাহ করব।

জুম চাষী লু সাই অং জানান, জুমে ধান ছাড়াও মারফা, বেগুন, মরিচ, ঢেঁড়শ, কাকরোল, কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করি। সারা বছরের খাদ্য জুম থেকে উৎপন্ন করি। স্থানীয় জাতের ধান চাষ না করে কৃষি বিভাগের সহায়তায় নেরিকা জাতের ধান চাষ করে আশনুরূপ ফলন হয়েছে।

বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুখ জানান, জুমচাষ এই অঞ্চলের আদি চাষ। জুমচাষকে আরো আধুনিকায়ন ও ফলন বৃদ্ধি করতে করতে কৃষি বিভাগের সহায়তায় আউশ প্রণেদনা/২০১৬  আফ্রিকার ওগান্ডা থেকে আনা নেরিকা জাতের পরিক্ষা মূলক ধান চাষ করা হয়েছে। এবছর থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় নেরিকা জাতের ধানের ফলন ভাল হয়েছে। জেলার ৮০০ কৃষককে বীজ, সার ও অর্থনৈতিক এবং কৃষি সহায়তা দিয়ে ২৭০ হেক্টরে চাষ করা হয়েছে।

তিনি জানান, এবছর জুমে ৮০% এবং সমতলে ২০% পরিক্ষা মূলকভাবে চাষ করা হয়েছে। স্থানীয় জাতের ধান তাদের ভাষায় কানি প্রতি ৩০-৪০ আড়ি ধান পেত। সেখানে নেরিকা ধান চাষ করে তারা ৫০ আড়ির উপরে ধান পেয়েছে। আবার সমতলে এর উৎপাদন কানি প্রতি প্রায় ৮০ আড়ি ধান উৎপন্ন হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মো.আলতাফ হোসেন বলেন, পানির ব্যবহার কম লাগে এবং খরা সহায়ক নেরিকা মিউট্যান্ট উফসি জাতের ধানের বৈশিষ্ট। উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বীজ সংগ্রহ করে পরবর্তী বছর চাষ করা যাবে।

চলতি মৌসুমে জেলায় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে জুমচাষ করা হয়েছে। ৬ হাজার মেট্টিকটন ধান এবং ২লাখ মেট্টিকটন কৃষিপণ্য উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন