দালালরা লুট করছে রোহিঙ্গা নারীদের স্বর্ণলঙ্কার, ৩২ দালালকে সাজা: ২৬৭৮ রোহিঙ্গা প্রতিহত

টেকনাফ প্রতিনিধি:

টেকনাফ সীমান্তের উপকূল দিয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আনছে তালিকাভূক্ত মালয়েশিয়া মানবপাচারের দালালেরা। রোহিঙ্গাদের আনার পরপরই মাথাপিছু ১০-৫০ হাজার ভাড়া নিচ্ছে এবং তাদের হাতে থাকা মূল্যবান স্বর্ণলঙ্কার লুটসহ রোহিঙ্গা নারীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। তম্মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৩২ দালালকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা প্রদান করেছে এবং টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ২৬৭৮জন মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা প্রতিহত করেছে।

স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, টেকনাফের উপকুলে কয়েক হাজার নৌকা সাগরে ও নদীতে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে এসব নৌকা ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কাজে। সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিনদ্বীপ, শাহপরীরদ্বীপ, শাপলাপুর, শীলখালী, মহেশখালীয়া পাড়া, তুলাতুলী, বাহারছড়া, হাদুর ছড়া, মুন্ডার ডেইল, কাটাবনিয়া, খুরের মুখ, লম্বরী, মিঠাপানিরছড়া, জাহাজপুরা, উখিয়া উপজেলার ছেপট খালী, মনখালী ঘাটে এখন কোন নৌকা নেই। সব নৌকা দালালের সাথে আঁতাত করে রোহিঙ্গা আনার জন্য মাগরিরের পরপরই মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। দালালেরা সকলেই চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত। দালালেরা উপকুলে তীরে ভিড়ার আগে বোটের উপর স্বর্ণালংকার ও টাকা কেড়ে নিতে ধস্তাধস্তির কারণে বোট ডুবির মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে। এদের দেখাদেখি আরও কিছু নতুন দালাল সিন্ডিকেট সৃষ্টি হচ্ছে।

বেপরোয়া দালাল সিন্ডিকেট:

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে দালাল সিন্ডিকেট চরমভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনা এবং লাশ উদ্ধারের পর প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়া সত্বেও দালাল সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধ হয়নি বরং লুটপাট ও রোহিঙ্গা নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাহপরীরদ্বীপে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে জালিয়াপাড়ার মৃত আলতাজ মিয়ার ছেলে শামসুল আলম হাসু, দুদু মিয়ার ছেলে নুরুল আলম, নুর মোহাম্মদের ছেলে আবু তাহের, মোজহার মিয়ার ছেলে আকবর,  মিস্ত্রীপাড়ার লম্বা সলিম, মৃত জালাল আহমদের ছেলে শরীফ হোছন, নাজির হোছন, নুর হোছন, মো. হোছন, মো. নুরুল আলমের ছেলে ইলিয়াছ, বশির আহমদের ছেলে এনায়ত উল্লাহ এবং ঘোলাপাড়ার কবির আহমদ কবিরা, বাজারপাড়ার নজির আহমদের ছেলে সৈয়দ ও জিয়াবুল, ঘুঘুর ছেলে বাইল্ল্যাসহ বিশাল সিন্ডিকেট। তম্মধ্যে জালিয়াপাড়ার শামসুল আলম হাসু, মিস্ত্রীপাড়ার লম্বা সলিম ও শরীফ হোছন, এবং ঘোলাপাড়ার কবিরা, বিগত কয়েক যুগ ধরে এপার-ওপার ব্যবসা করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় মানব পাচারে পারদর্শী হয়ে উঠেছে।

৩২ দালালকে সাজা প্রদান:

টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করার দায়ে ৩২জন দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। তম্মধ্যে ২৭জন দালালকে ভ্রাম্যমান আদালতে ৬ মাস, ১জনকে ১৫ দিনের ৩ জনকে ১মাস করে বিনাশ্রম সাজা দেয়া হয়েছে।

তাছাড়া শাহপরীরদ্বীপে বিক্ষুব্ধ জনতা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করার দায়ে ৩টি ট্রলার পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক এবং টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভুমি) প্রণয় চাকমা পৃথকভাবে দণ্ডাদেশ প্রদান করেন। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশণার (ভুমি) প্রণয় চাকমা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন সেন্টমার্টিনদ্বীপ পুর্বপাড়া কালা মিয়ার পুত্র মো. হোসেন (৫১), শামসুল ইসলামের পুত্র মো. হারুন (৩২) এবং দক্ষিণপাড়া মো. হাশেমের পুত্র রফিক আহমদ (৩৫), হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব লেদা গ্রামের মাস্টার হাফেজ আহমদের পুত্র শাহীন উদ্দিন (২৬), নবী হোছনের পুত্র আবদুল্লাহ (২৪), আমির হামজার পুত্র আবুল হোছন (২১), শাহপরীরদ্বীপের আলী হোছনের পুত্র কামাল হোছন (৪৫),কবির আহমদের পুত্র দিল মোহাম্মদ (২৫), মৃত মকবুল আহমদের পুত্র নুর আহমদ (৫৮), মৃত ছিদ্দিক আহমদের পুত্র আবুল কাসেম (৪৮), মৃত আবুল হাসেম ভুইয়ার পুত্র আলী হোসেন (৪৫), মৃত আলী হোসেনের পুত্র কাদের হোসেন (৪৫), সুনা মিয়ার পুত্র হারুনুর রশিদ (২৫), হাবিবুল্লাহর পুত্র সানাউল্লাহ (১৯), মৃত সুলতান আহমদের পুত্র নুরুল হোসেন (৫৫), নুরুল আলমের পুত্র মোঃ রফিক (৩২), টেকনাফ সদর ইউনিয়নের উত্তর লম্বরী গ্রামের হাবিবুল্লাহর পুত্র ছৈয়দ কাসেম (৫৫), জাফর আলমের পুত্র শাহাবুদ্দিন (১৯), মৃত মিরাজের পুত্র আবদুল আমিন (২৪), হামিদুল হকের পুত্র গফুরুল ইসলাম (২২)। ১৫ দিনের দন্ডপ্রাপ্ত ১ জন হলেন শাহপরীরদ্বীপ মাঝেরপাড়া নুর হোসেনের পুত্র মোঃ শরীফ (৩০)। নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মৃত আমির হোসেনের পুত্র মোঃ হাসান (৩৩), হোয়াইক্যং উনছিপ্রাং নুরুল ইসলামের পুত্র মো. বাবুল (৩৫), চন্দনাইশ গাছবাড়িয়া উত্তর কাশিমপুর মৃত সুলতান আহমদের পুত্র আবু তালেব (৫৬), রাউজান আজিমপুর মৃত আজিজুল হকের পুত্র হাসানুল হক (৩৮), টেকনাফের হ্নীলা মৌলভীবাজার নুরুল আলমের পুত্র মো. রফিক (২৫), হোয়াইক্যং পশ্চিম মহেশখালীয়াপাড়া মোঃ শরীফের পুত্র আজিজুল হক (২১), টেকনাফ পৌরসভা পুরান পল্লানপাড়া মকবুল আহমদের পুত্র ছৈয়দ হোসেন (২৪)। এই ৭ জনের প্রত্যেককে ৬ মাস করে বিনাশ্রম সাজা দেয়া হয়েছে। শাহপরীরদ্বীপের আবুল হোসেনের পুত্র মোস্তাক আহমদ (৪২), মৃত ওমর আলীর পুত্র মো. ফয়েজ (৩৫) এবং কালা মিয়ার পুত্র মো. হাছান (২২) এই ৩ জনকে ১ মাস করে বিনাশ্রম সাজা দেয়া হয়েছে।

সাজা প্রাপ্তরা রোহিঙ্গাদের ফিশিং বোট করে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এনে মোটা অংকের টাকা, স্বর্ণালংকার লুটসহ বিভিন্ন ভাবে হয়রানিরও অভিযোগ রয়েছে। শাহপরীরদ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও কোস্টগার্ডসহ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে এদেরকে আটক করা হয়েছে বলে জানা  গেছে।

২৬৭৮ রোহিঙ্গাকে ঢুকতে বাধা:

টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা কালে দুই হাজার ৬৭৮জন রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মঙ্গলবার ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টেকনাফের পাঁচটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকতে চেয়েছিল। এ সময় তাদের প্রতিহত করা হয়। টেকনাফস্থ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং অনুপ্রবেশের চিহ্নিত পয়েন্ট সমূহে বিজিবি টহল বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সীমান্তবর্তী কয়েকটি চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার জন্য মিয়ানমারের সরকার স্থানীয় আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিকে দায়ী করে। এরপর থেকে রোহিঙ্গা জনপদে দমন-পীড়ন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে রাখাইন থেকে লাখো শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে। এসব শরণার্থীর মধ্যে প্রায় সবাই রোহিঙ্গা মুসলিম।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশণার (ভুমি) প্রণয় চাকমা জানান টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং একাধিক নৌকা ডুবির ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানীতে শাহপরীরদ্বীপের বিক্ষুব্ধ জনতা ৩টি ট্রলার পুড়িয়ে দেয়াসহ ৩২জন দালালকে সাজা প্রদান করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন