দার্জিলিং সাজেক ভ্যালি পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে

সাজেক ২
এম. সাইফুর রহমান, খাগড়াছড়ি ॥

দার্জিলিং এর প্রতিচ্ছবি রাঙামাটির’র সাজেক ভ্যালী। বাংলাদেশ ও ভারতের মিজোরাম সীমান্তের কূল ঘেঁষা অপার সম্ভাবনার জনপদ সাজেক ভ্যালীতে বসে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থেকে এক খণ্ড সময় কাটায় প্রকৃতি প্রেমিকরা। তাদের হৃদয় ও মন ছুঁয়ে যায় নৈসর্গিক এ স্থানটির রূপ-লাবণ্যে। মেঘাচ্ছন্ন দিনে সাজেক আরো বেশী দৃষ্টিনন্দন ও অপরূপ হয়ে উঠে। সাজেকের সৌন্দর্য্যতা ভ্রমণ পিপাসু যে কাউকেই মুগ্ধ করবে অনায়াশে।

সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত সাজেক। এ পাহাড়ের চুড়া থেকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে পড়বে যে কোন আগন্তুক। নাগরিক জীবনের সকল ক্লান্তির অবসানে চলে আসুন সাজেক ভ্যালীতে।

এখানকার প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতে বসে রঙের মেলা। সাজেক ভ্যালিতে উঠেই আকাশপানে তাকালে মনে হয় কালো মেঘগুলোকে যেন সরিয়ে দিয়ে সাদা মেঘের আনা গোনা শুরু হয়েছে। পাহাড় ঘেরা এ প্রাকৃতিতে বসে চাঁদনী রাতের দৃশ্যপট এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। সাজেকের আবহাওয়া ও সৌন্দর্য, রাতের আকাশে চন্দ্র-তারা ও দিনের আলোয় লাল সূর্য মিলেমিশে একাকার। এ দৃশ্য নিমিষেই সবার মনকে উদাস করে তোলে। সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে সাজেকের সৌন্দর্য্য অবলোকনে প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক ভীড় জমাচ্ছে রুইলুই ভ্যালিতে।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

দেশের সর্ব বৃহৎ ইউনিয়ন সাজেক। আয়তন ৬০৭ বর্গ মাইল। যা দেশের কোনো কোনো জেলার চেয়েও বড়। এখানকার লোক সংখ্যা মাত্র হাজার দশেক। দীঘিনালা থেকে সাজেক যেতে সময় লাগে মাত্র দেড় থেকে দু’ঘন্টা। পথিমধ্যে চোখে পড়বে ঢেউ খেলানো অসংখ্য উঁচু-নিচু ঢেউ তোলা সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে আপন মনে বয়ে চলেছে কাচালং ও মাচালংসহ নাম না জানা অসংখ্য নদ-নদী। নদীতে ভাসছে বাঁশের চালি। যা কাপ্তাই লেক হয়ে কর্ণফুলী পেপার মিলে যাবে।

রাস্তার দু’ধারে-চোখে পড়বে উপজাতীয়দের বসত বাড়ী, মাচাং ঘর ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতিসত্তার বিচিত্রময় জীবন ধারাসহ আরো কত কি! চড়াই উতরাই পেরিয়ে আপনি যখন রুইলুই এ পৌঁছাবেন ততক্ষণে আপনি সাজেক ভ্যালীতে পৌছে যাবেন। সাজেকে প্রবেশের সাথে সাথে আপনার চারপাশ যেন মুর্হুতে পরিবর্তন হয়ে যাবে।

এক সময় সাজেক যাওয়াটা স্বপ্ন ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর’র সুবাদে গত কয়েক বছর আগে সাজেক পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে বদলে যেতে শুরু করেছে সাজেকবাসীর জীবন চিত্র। সৌন্দর্যের টানে বহু পর্যটক এখন সাজেক আসছেন।

সাজেক রিসোর্টে

প্রকৃতির সাথে মিতালি করতে এসে পর্যটকরা যাতে আরো স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারে সে বিষয়টি মাথায় রেখে সম্প্রতি সেনাবাহিনী পর্যটনের নানা অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। সুদৃশ্য সড়ক, কটেজ, বিশ্রামাগার, সড়কবাতি, ক্লাবঘর, শিব মন্দির, পাবলিক টয়লেট, বিদেশি ঘরের আদলে তৈরি রিসোর্ট “রুম্ময়”ও থ্রি স্টার মানের হোটেলও এ পাহাড়ে তৈরি করা হয়েছে। সাজেকের বাসিন্দাদের অধিকাংশই ভারতে মিজো এবং বাংলাদেশের লুসাই বা পাংখোয়া নামে পরিচিত।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সাজেক সফরে এসে মুগ্ধ হয়ে এ স্থানটিকে আরো বেশী দৃষ্টিনন্দন ও সর্বসাধারণের জন্য সহজতর করতে গ্রহণ করেছেন নতুন প্যাকেজ। রাষ্ট্র প্রধানদের সে প্যাকেজ’কে বাস্তবে রূপ দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামস্থ ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা।

এছাড়াও রুইলুই ভ্যালিতে পর্যটকদের অবকাশ যাপনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আলো রিসোর্ট এর শুভ উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি জেলার রিজিয়ন কমান্ডার কাজী শামছুল ইসলাম। এসময় উপস্থিত ছিলেন আলো এনজিওর নির্বাহী পরিচালক অরুন কান্তি চাকমা, বাঘাইহাট জোনের জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল রসিদুল ইসলাম, দিঘীনালা জোনের জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল লোকমান হোসেন, ৩৯ বিজিবি মারিশ্যা জোনের জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল রবিউল ইসলাম প্রমুখ।

SAJEK VEALLI (1)

পর্যটকরা জানান, পর্যটকদের জন্য সাজেক একটি সম্ভাবনাময় স্পট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে কাজে লাগাতে পারলে সাজেক হতে পারে দেশের পর্যটন শিল্পের মধ্যে অন্যতম। সেই সাথে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চেহারা।

সাজেকের কংলাক পাড়ার হেডম্যান চংমিং থাং লুসাই জানান, সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সাজেক পর্যন্ত রাস্তা হওয়ায় এলাকার চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে। তবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারনে আজ থেকে ৭ বছর আগেও সাজেকের মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য পাড়ি জমাতো পাশ্ববর্তী মিজোরামে। তাদের লেখাপড়া, বাজারঘাট, আত্মীয়তা তথা দৈনন্দিন জীবনযাপন ছিল মিজোরাম নির্ভর। এখন সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় মাত্র ৩ ঘন্টায় খাগড়াছড়ি যাতায়াত করা যায়।

সাজেক রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্গত হলেও জেলা সদরের সাথে এখনো প্রায় বিছিন্ন। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দুরত্ব প্রায় ৫০কিঃ মিঃ। পক্ষান্তরে সাজেকবাসীকে নিজ জেলা সদর রাঙ্গামাটি যেতে হলে প্রায় ১শ ২০ কিঃ মিঃ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে খাগড়াছড়ি জেলার উপর দিয়ে যেতে হয়। এ জন্যে সাজেককে খাগড়াছড়ি জেলার সাথে অন্তর্ভূক্ত করার দাবী জানান স্থানীয়রা।

যেভাবে আসবেন:

সাজেক যেতে হলে সর্বপ্রথম আসতে হবে খাগড়াছড়িতে। ঢাকার কমলাপুর, সায়দাবাদ, কলাবাগান ও ফকিরাপুল থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে আসে। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে খাগড়াছড়ির বাস পাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি থেকে জীপ গাড়ী, মাইক্রোবাস ও মোটর সাইকেলে চড়ে যেতে পারেন সাজেক।

যেথায় থাকবেন:

একসময় সাজেকে গিয়ে রাত্রি যাপন করা অসম্ভব ব্যাপার হলেও এখন সাজেকে রয়েছে একাধিক কটেজ ও রিসোর্ট। পর্যটকদের সুবিধার্থে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সাজেকে চলছে নানান অবকাঠামো তৈরীর কাজ। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে আসছে মায়াভরা সাজেকের সৌন্দর্য্য অবলোকনে। দার্জিলিং এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় পর্যটকরা সাজেকের নাম দিয়েছেন বাংলার দার্জিলিং।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন