তিন সংগঠনের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পাহাড়ের সাধারণ মানুষ

সম্ভাবনার পাহাড়- ৪

চাঁদাবাজি

জাহিদুল ইসলাম, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে:
অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বিবেচনায় পাহাড়ি জনসাধারণকে করের আওতা থেকে মুক্তি দিয়েছে সরকার। কর দিতে না হলেও সন্ত্রাসী সংগঠনের চাঁদার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ। বাঙালি কিংবা উপজাতি- সবাই এসব সন্ত্রাসীকে চাঁদা দিতে বাধ্য। বিভিন্ন ফসল, ফল এমনকি মুরগি ও মুরগির ডিম বেচাকেনা হলেও চাঁদা আদায় করছে সন্ত্রাসীরা।

প্রকাশ্যে চিঠি দিয়েও চাকরিজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে তারা। প্রাণভয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনের কাছে এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে অভিযোগ করছে না কেউ। অভিযোগ এলেও প্রমাণের অভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে জড়িতরা। পার্বত্য তিন জেলা ঘুরে এমন চিত্রই উঠে এসেছে।

নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছর বান্দরবান জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক তিন সংগঠন সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির চিত্র প্রকাশ্যে তুলে ধরেন।

সভায় তিনি বলেন, এখানে তিনটি গ্রুপ চাঁদা সংগ্রহ করে। এলাকায় চলাচল করা প্রতিটি বাসকে জেএসএসের দুই গ্রুপকে বছরে ৫ হাজার টাকা করে এবং ইউপিডিএফকে ৩ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। ট্রাকপ্রতি প্রতিটি গ্রুপকে ৬ হাজার টাকা করে, চাঁদের গাড়ি ৩ হাজার, ২ হাজার ও দেড় হাজার টাকা হারে চাঁদা দিতে হচ্ছে।

সভায় তিনি বলেন, প্রতিটি খাতের পণ্য বেচাকেনায় চাঁদা আদায় করছে সন্ত্রসীরা। ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীরাও চাঁদার আওতার মধ্যে রয়েছেন। গ্রামের চাষীরা বাজারে আনারস, কাঁঠাল, আমসহ বিভিন্ন ফল ও ফসল বিক্রি করলে সেখান থেকেও চাঁদা দিতে হচ্ছে তাদের। একটা কাঁঠাল বিক্রি হলে তিন গ্রুপ মিলে ৫ টাকা চাঁদা আদায় করে। প্রতিটি কলার ছড়িতে দিতে হয় ৫ টাকা করে। এমন কোনো আইটেম নেই যেখানে চাঁদা দিতে হয় না।

সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চল ঘুরে দেখার সময় আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের অপহরণ ও চাঁদাবাজির চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এ তিনটি সংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন তিন জেলার সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা। এমনকি স্থানীয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও পাহাড়ি এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে অসহায়।

নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ মাঝে-মধ্যে চাঁদাবাজদের আটক করলেও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। অভিযান কঠোর হলে নতুন উপায়ে চাঁদা আদায় করা হয়। এদিকে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা না দিলে প্রাণনাশের পাশাপাশি নানাভাবে হয়রানি করা হয়। এ কারণে পার্বত্য এলাকার মানুষের মাঝে এখন বিরাজ করছে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর ‘চাঁদা আতঙ্ক’।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে উপজাতি সশস্ত্র গ্রুপ এক থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ কোটি। চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। আদায় করা চাঁদার টাকা দিয়েই দলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রেশন, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি দেয়া হয়। এছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার এ অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে বাঙালিবিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজ করে।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক পার্বত্য খাগড়াছড়ির এক ব্যবসায়ী বলেন, আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি অহরহ ঘটছে। চাঁদাবাজিতে তারা কেউ পিছিয়ে নেই। কোনো পরিবহন মাল নিয়ে খাগড়াছড়ি ঢোকার সময় অথবা বের হওয়ার সময় চাঁদা দিতে হয়। একেক সময় তারা একেক স্থান থেকে চাঁদা তোলে। চাঁদা না দিলে গাড়ি থামিয়ে স্টাফদের মারধর করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। চাঁদা না দেয়ায় সম্প্রতি বিআরটিসি’র একটি ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় ইউপিডিএফ।

রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার সাঈদ তরিকুল হাসান বলেন, অনেকেই অভিযোগ করতে ভয় পায়। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে। গ্রেফতার করে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। তবে পার্বত্য এলাকার ভৌগোলিক বাস্তবতা, সড়ক, ভাষার প্রতিবন্ধকতা, সচেতনতার অভাব ও লোকবল সংকটের কারণে চাঁদাবাজি প্রতিরোধ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

জেএসএসের মুখপাত্র ও সহ-প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা তাদের বিরুদ্ধে আনীত চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, জেএসএস চাঁদাবাজি করে না। পাহাড়িদের কল্যাণে সংগঠনটি কাজ করছে দাবি করে তিনি বলেন, জেএসএসের নামে অন্য কেউ চাঁদা দাবি করছে।

চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপিডিএফ মুখপাত্র নিরন চাকমা দাবি করেন, মানুষের সহযোগিতায় তাদের দল পরিচালিত হয়।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সবার আগে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। এগিয়ে এসে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে এলিট ফোর্স র‌্যাবের ক্যাম্প স্থাপন করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হবে।

সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন