টেকনাফ-উখিয়ায় খাদ্য ও শীতবস্ত্র সংকট: রোহিঙ্গা শিশুদের চরম দুর্ভোগ

teknaf-news-pic-02-12-16-2-copy

টেকনাফ প্রতিনিধি:

টেকনাফ ও উখিয়ায় খাদ্য ও শীতবস্ত্র সংকটে সহস্রাধিক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এতিম শিশু চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে বলে জানা গেছে। তম্মধ্যে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সদ্য অনুপ্রবেশকারী ২ পরিবারের ১১ জন মা-বাবা হারা এতিম রোহিঙ্গা শিশু মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। প্রতি রাতেই দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, টেকনাফের শামলাপুর অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছাড়াও সমুদ্র উপকূলবর্তী ঝাউবাগান, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কক্সবাজার, মহেশখালী, উখিয়া, নাইক্ষংছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে জানা গেছে, অনুপ্রশেকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশীর ভাগই স্বামী ও স্বজন হারা নারী এবং শিশু। এদের নেই খাবর ব্যবস্থা, নেই শীতবস্ত্র ও পোষাক। শীতবস্ত্রের অভাবে ও খাদ্য সংকটে শত শত শিশু ঠান্ডাজনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এরা কোন চিকিৎসা সুবিধা এবং খাবার পাচ্ছেনা। পরিদর্শনকালেও শতাধিক রোহিঙ্গা লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।

পরিদর্শনকালে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলার সময় মিডিয়াসহ সকলের নজর কেড়ছে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সদ্য অনুপ্রবেশকারী ২ পরিবারের ১১ জন মা-বাবা হারা এতিম রোহিঙ্গা শিশু। এসব শিশু বর্তমানে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (স্থানীয় ভাষায় টাল) ‘এ’ ব্লকে মোঃ কবিরের আশ্রয়ে রয়েছে। তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায় মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারের লোমহর্ষক ঘটনা।

অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের উত্তর জামবইন্যা মুসলমান অধ্যুষিত বিশাল গ্রামে মিয়ানমার বাহিনী প্রায় তিন সপ্তাহ আগে অভিযান চালিয়ে দুই শতাধিক বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। অনেককে চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মহিলাদেরকে ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এই অভিযানে মিয়ানমার সেনাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন ছৈয়দ আহমদ (৪০), তাঁর দুই পুত্র মোঃ আয়ুব (২৩), আবদুস শুক্কুর (২০), ছৈয়দ আহমদের স্ত্রী নুর জাহান বেগম (৩৮), মোঃ আয়ুবের স্ত্রী রজিয়া বেগম ((২০)। আবদুস শুক্কুরের স্ত্রী মুহসেনা (২০) ধর্ষনের শিকার হন। এই দুই পরিবারে রয়েছে ১১ জন শিশু। এরা হচ্ছে জন্নাত আরা (১৫), হাসিনা (১১), রশিদা বেগম (৯), মোঃ আয়ুব (৭), জাহেদুর রহমান (৪), ইয়াসমিন (২), সুফাইরা (১১), সুহাইদ (৯), রিদুয়ান (৭), মোঃ আনস (৫), আবদুর রহমান (২)।

ছৈয়দ আহমদের অপর পুত্র খাইর মোহাম্মদ (২৭) সৌভাগ্যক্রমে সেনা অভিযান চলাকালে পাশ্ববর্তী গ্রামে থাকায় হামলার শিকার হয়নি। এই খাইর মোহাম্মদই মা-বাবা হারা ১১ জন এতিম শিশু এবং স্বামী হারা ধর্ষিতা বোন মুহসেনা এবং নিজ স্ত্রী রেহানা বেগম (২৫) এবং ৪ শিশু সন্তান যথাক্রমে শহীদ নুর (৮), আনেসা বিবি (৬), মোঃ এহসান (৪), মিনা আক্তারকে (২) নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে অর্ধাহারে-অনাহারে বনে-জঙ্গলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং তুলাতলী ঘাট দিয়ে গভীর রাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের সাথে রয়েছে স্বজন হারা আরেক নির্যাতিত পরিবার। এরা হচ্ছে হাবিসুনা (৫০), বেগম বাহার (৪৫), জমিলা বেগম (২৫), দিলদার বেগম (১৮), মরিয়ম বাহার (১৬), নুর ফাতেমা (১৪)।

খাইর মোহাম্মদ জানান মা-বাবা হারালেও অসহায় ১১ জন শিশুর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এবং নিজেদের বাঁচার তাগিদে এখানে চলে এসেছি। বাংলাদেশে এসে খাবার, থাকা, পোষাক ও শীতবস্ত্রের অভাব থাকলেও স্বস্তি বোধ করছি। এখানে অন্ততঃ জীবনটা বাঁচাতে পারব।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ মোঃ আয়ুব জানান, মিয়ানমার সেনার বর্বরতায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এমনিতেই লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রেশন ব্যবস্থা নেই। উপরন্ত গত প্রায় দুই মাস ধরে রাত-দিন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু ঢুকছে। এরা আত্মীয়-স্বজনসহ বিভিন্ন বাসায় আশ্রয় নিলেও খাদ্য এবং শীতবস্ত্রের চরম সংকট চলছে। তারা ফেলতেও পারছেনা, আবার রাখতেও পারছেনা। উভয় সংকটে রয়েছে বস্তির রোহিঙ্গারা। শুধু টেকনাফের লেদা নয়, প্রত্যেক রোহিঙ্গা পল্লীতেই একই সমস্যা বিরাজ করছে। সরকারী-বেসরকারী বা কোন আর্ন্তজাতিক সংস্থা এখনও কোন সাহায্য করেনি।

উল্লেখ্য, শীত ও অনাহারে অসহায় মায়ের কোলেই বিনা চিকিৎসায় ২৬ নভেম্বর মারা গিয়েছিল অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা শিশু জানে আলম। এ ঘটনা দেশে-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে (স্থানীয় ভাষায় টাল) ঘটেছিল এঘটনা।

অসহায় মা নুর বেগম জানান, মিয়ানমার আরকান রাজ্যের উত্তর জামবইন্যা জামাল হোসেন ও নুর বেগমের সাড়ে ৫ মাস বয়সী শিশু পুত্র জানে আলম। মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে প্রাণ বাঁচাতে একমাত্র শিশুপুত্র জানে আলম ও অবিবাহিত এক বোনকে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে বনে-জঙ্গলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২০ জনের দলটি টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উঞ্চিপ্রাং ঘাট দিয়ে গভীর রাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে সময় লেগেছে ১৫ দিন। স্বামী জামাল হোসেনকে মিয়ানমার বাহিনী ২০ দিন আগে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। অপর ২ শিশুপুত্র মোঃ হাশিম (৫) এবং জাফর আলমতে (৩) মায়ের চোখের সামনে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছে মিয়ানমার বাহিনী। বাংলাদেশে ঢুকে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে (স্থানীয় ভাষায় টাল) আশ্রয় নিয়েছে ৩০নভেম্বর সন্ধ্যায়। গভীর রাতে শীত ও অনাহারে মায়ের কোলেই বিনা চিকিৎসায় মারা যায় জানে আলম।

রোহিঙ্গা নারী অসহায় মা নুর বেগম আরও জানান, অর্ধাহারে-অনাহারে বনে-জঙ্গলে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। অনাহারে শিশুটি কংকালসার হয়ে যায়। উপরন্ত ছিল তীব্র শীত। সাথে কোন গরম কাপড়ও ছিলনা। চিকিৎসা করারও সুযোগ হয়নি। কোলেই বিনা চিকিৎসায় শিশুটি মারা যায়। একাধারে ৩ দিন অনাহারে থাকার পর এখানে এসে ভাত খাওয়ার পর বুকে সামান্য দুধ আসলে শিশুটি মৃত্যুর আগে যৎসামান্য দুধ পান করেছিল। নুর বেগম বর্তমানে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (অনিবন্ধিত) ‘এ’ ব্লকের একটি বাসায় আশ্রয়ে রয়েছেন।

বাসার মালিক জুলেখা বেগম বলেন, ‘ক্যাম্পের বাইরে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্রীক ফিল্ডের পাশে কঙ্কালসার শিশুসহ এক মহিলাকে দেখে দয়াপরবশঃ হয়ে মানবিক কারণে এনে আশ্রয় দিয়েছি’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন