জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে ধুপশীলপাড়া বাঙ্কারে একরাত যাপন করেছিলেন

আ ল ম ফজলুর রহমান

(১৭)

ফারুয়া ব্যাটালিয়ান সদরে মেসেজ আসলো আমাকে ধুপশীলপাড়া বিডিআর ক্যাম্পে একটা আত্মহত্যা/ মার্ডার কেসের তদন্ত করতে হবে। প্রোগ্রাম ছিল আমি সম্ভবত স্হানটির নাম তিনকোনিয়া হেলিপেডে গেলে সেখান থেকে হেলিকপ্টার আমাকে ধুপশীলপাড়া নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিবে।

ধুপশীলপাড়া ফারুয়া থেকে উত্তরে বিলাইছড়ি এবং ফারুয়ার মধ্যস্থলে । ধুপশীলপাড়া তিনকোনিয়া থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘন্টা তিনেক হেঁটে যেখানে পাহাড় এবং মেঘমালার সম্মিলন ঘটেছে সেটাই ধুপশীলপাড়া।

জরুরী তলব তাই বেলা এগারোটার দিকে স্কটসহ স্পিডবোটে ধুপশীলপাড়ার উদ্দেশ্য যাত্রা করলাম। কড়া রোদ মেঘশুন্য আকাশ। আমি ধুপশীলপাড়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে থাকতেই দেখলাম একটি হেলিকপ্টার তিনকোনিয়াতে একটি চক্কর দিয়ে উড়ে চলে গেল। ভাবলাম কপালে দুঃখ আছে। তিনকোনিয়াতে পৌছে সেটে জানতে পারলাম হেলিকপ্টার আসবে না। আমাকে হেঁটে ধুপশীলপাড়া যেতে হবে। প্রমাদ গুনলাম কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। আমার অবস্থা ঠিক উরির মতো। মুখ খুব শক্ত কিন্তু শরীর দুর্বল।

কাঠফাটা রোদে প্রথমে একঘন্টা কোনো বিশ্রাম ছাড়া হাঁটার পরে শরীর প্রায় অচল হয়ে গেলো। রাস্তায় কোনো গাছ নাই যে ছায়ায় বসে জিরোনো যাবে। ঠিক মরুভূমির মতো অবস্থা। দ্বিতীয় ঘন্টা পনেরো কুড়ি কদম যাবার পরে বসতে শুরু করলাম। শেষ ঘন্টার পথচলা ছিলো আমার জীবনে পাহাড়ে চলার সব চেয়ে কঠিন পথচলা। শেষে অবস্থা এমন হলো যে তিন থেকে পাঁচ কদম যাবার পরে বসতে আরম্ভ করলাম।

ধুপশীলপাড়ায় পৌছে মনে হলো শরীরে শক্তি বলে অবশিষ্ট কিছু নেই। বিডিআর ব্যাটালায়ান সি ও মেজর আলম ( কর্ণেল অবসরপ্রাপ্ত, জীবিত ) আমাকে স্বাগত জানালেন এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। দীর্ঘ ঘুম দিয়ে সন্ধ্যার কিছু পুর্বে মেজর আলমের সাথে চা পান করলাম। ঐ সময় মেজর আলমের কাছ থেকে একজন বিডিআর সৈনিকের আত্মহত্যা/ মার্ডারের বিস্তারিত ঘটনা অবহিত হলাম। ঘটনাটা ছিল এরকম:

এক। ধুপশীলপাড়া বিডিআর ক্যাম্পের উওর পশ্চিমে একটি ওয়াচ টাওয়র আছে যেখানে দিনে এবং রাতে একজন প্রহরী পাহারায় থাকে। ওয়াচ টাওয়রে দুজন সৈনিকের বসার জায়গা আছে।

দুই। একদিন বিকেলে একজন আনসার সদস্য ঐ ওয়াচ টাওয়রে ডিউটিতে ছিলো। ঐ সময় একজন বিডিআর সৈনিক ঐ ওয়াচ টাওয়রে উঠে আনসার সৈনিকের থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করে। এনিয়ে তিনটি তদন্ত হয়েছে কিন্তু কোনো কূলকিনারা করা সম্ভব হয় নাই। কোনো তদন্তে বলা হয়েছে, আত্মহত্যা আবার কারো তদন্তে ভার্ডিক্ট এসেছে মার্ডার বলে । শেষে আমাকে ডাকা হয়েছে তদন্ত করার জন্য। আমি মেজর আলমকে বললাম আগামীকাল আমি স্পট পরিদর্শন করে তদন্তের প্রাথমিক কাজ শুরু করবো।

ঐ ওয়াচ টাওয়ারে যেন একই আনসার সৈনিক একই থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে ডিউটিতে থাকে। রাতের ডিনার শেষে আরলি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে আমি মেজর আলমসহ ঐ ওয়া চটাওয়ারে উঠলাম। দেখলাম একই আনসার সৈনিক ওখানে ডিউটিতে আছে। ঐ আনসার সৈনিকের হাতে ঐ থ্রি নট থ্রি রাইফেল যার থেকে গুলি ফায়ারের ফলে একজন বিডিআর সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে ।

তিন। আমি ঐ আনসার সৈনিককে ঘটনার বর্ণনা করতে বললাম। আনসার সৈনিকের ঘটনার বর্ণনা ছিলো এরূপ:

ক। বেলা এগারোটা থেকে বেলা বারোটার মধ্যে একজন বিডিআর সৈনিক তার ওয়াচ টাওয়ারে আসে। বিডিআর সৈনিক তার কাছ থেকে তার রাইফেল নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় হঠাৎ রাইফেল থেকে গুলি বের হয়ে বিডিআর সৈনিকের ডান বুক ছেদ করে চলে যায় যার ফলে তার মৃত্যু হয়। অনেক প্রশ্ন করার পরেও ঐ আনসার সৈনিকের কাছ থেকে আর বেশী কিছু জানা সম্ভব হলো না।

খ। পরে কয়েকজন সৈনিক যারা তার প্লাটুনের তাদের কাছে মৃত সৈনিকের সম্বন্ধে জানতে চাইলে সবাই ঐ সৈনিকের বিষয়ে যা বললো তা হচ্ছে, সে একজন ভালো সৈনিক ছিলো। ক্যাম্প কমান্ডার জেসিওকে প্রশ্ন করে একই উত্তর পেলাম যে, সে একজন ভালো সৈনিক যার বিশেষ কোনো সমস্যা ছিলো না।

তদন্তের ধারাবাহিকতায় সৈন্যদের থাকার, খাওয়ার এবং তাদের ওয়েলফেয়ারের বিষয়ে বিশদ খোঁজ খবর নিলাম। কোথাও কোনো বড় ঘাটতি পরিলক্ষিত হলো না। সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হলো। পরে একান্তে মেজর আলমের সাথে নিহত সৈনিকের পারিবারিক সমস্যার বিষয়ে কথা বললাম। মেজর আলম জানালেন, ঐ সৈনিকের স্ত্রীর সাথে সৈনিকের বনিব না কম। তাই মেজর আলম ঐ সৈনিককে বেশ কয়েকবার ছুটি পাঠিয়ে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করেছেন। এখানেও তেমন গুরুত্বপুর্ন কোনো ক্লু পাওয়া গেল না যা নিয়ে তদন্তে অগ্রসর হওয়া যায়। দিন পার হয়ে গেলো।

রাতে এ বিষয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবো না। চিন্তা করার সময় কেবলি মনে হচ্ছিল, আমার প্রশ্নের উত্তর থ্রি নট থ্রি রাইফেল এবং ঐ ওয়াচ টাওয়ারে আছে। পরদিন সকালের ব্রেক ফাস্ট সেরে এবার একাই ওয়াচ টাওয়ারে উঠে আনসার সৈনিকের কাছ থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেলটি নিয়ে অনেকভাবে নিজেকে নিহত বিডিআর সৈনিকের অবস্থানে রেখে দেখতে চেষ্টা করলাম, কি ঘটতে পারে যার ফলে থ্রি নট থ্রি রাইফেল থেকে গুলি বের হয়ে বিডিআর সৈনিকের ডান বুক ছেদ করে গুলি বেরিয়ে যেতে পারে?

এক সময় আমি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ম্যাকানিজমের প্রতি দৃষ্টি দিলাম। নিজ হাতে রাইফেলের ট্রিগার গার্ডের ভিতরে ট্রিগারের সামনে চেটটা একটু বের হয়ে থাকা লিভার চেপে ম্যাগাজিন থেকে রাইফেলের গুলি বের করে ম্যাগাজিন খালি করার সময় হঠাৎই যেন আমার কাছে সব দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল- আসলে কি ঘটেছিল যার ফলশ্রুতিতে ওয়াচটাওয়ারে বিডিআর সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে।

ওয়াচটাওয়ার থেকে নেমে আমি মেজর আলমকে বললাম, আমার যা জানার ছিলো আমি জেনেছি। আমি ফারুয়াতে ফিরে আমার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিবো। পরে মেজর আলমসহ প্রোটেকশন এরেঞ্জমেন্ট ঘুরে দেখার সময় লক্ষ করলাম ক্যাম্পের দক্ষিণে পুর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি বড় বাঙ্কার অযত্নে পড়ে আছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতো বড় বাঙ্কার কিসের জন্য তোমরা তৈরী করেছিলে? উত্তরে মেজর আলম আমাকে জানালেন যে, জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে এই বাঙ্কারে একরাত যাপন করেছিলেন। রাতে তাঁর থাকার জন্য এই বাঙ্কার তৈরী করা হয়েছিলো । আমার বিশ্বাস প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়ার জন্য তৈরী ঐ বাঙ্কার এখনও আছে হয়তো অযত্নে এবং অবহেলায়।

আমি অাজ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বেলা ১০.৫১ মিনিটে কর্ণেল আলমের সাথে কথা বললাম ঐ বাঙ্কার সম্বন্ধে। সে আমাকে জানালো, সে ঠিক মনে করতে পারছেনা । কিন্তু আমি নিশ্চিত আমি ঐ বাঙ্কার ওখানে দেখেছি। ভূল আমারও হতে পারে । সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে আমি আর কোনো উচ্চবাচ্চ্য না করে পরদিন ফারুয়াতে ফিরবার কথা মেজর আলমকে বললাম।

সকালে ঘুম থেক উঠে নাস্তা শেষে হেলিকপ্টারের অপেক্ষা করছি। হেলিকপ্টার এলো এবং ধুপশীলপাড়ার উপরে একটি চক্কর দিয়ে উড়ে চলে গেল ল্যান্ড করলো না। আমি আজও জানিনা এটা কেন হয়েছিলো? পরে হেঁটে তিনকোনিয়া এসে স্পিডবোটে ফারুয়া ব্যাটালিয়ান সদরে ফিরলাম। তবে সকালে যখন আমরা ধুপশীলপাড়া থেকে হেঁটে তিনকোনিয়া আসছিলাম তখন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ী রাস্তার দুই ধারে বনমোরগের ডাক আমাদের পথের ক্লান্তিকে আনন্দে রূপান্তরিত করেছিলো। মনে হচ্ছিলো কোন স্বপ্নপথে যেন আমরা পথ চলছি। এই ডাক শোনার সৌভাগ্য খুব অল্প মানুষের হয়েছে বোধ করি। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। হেলিকপ্টারে উড়ে ফারুয়া এলে এই দুর্লভ আনন্দ থেকে আমি বঞ্চিত হতাম।

%e0%a6%a5%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%bf-%e0%a6%a8%e0%a6%9f-%e0%a6%a5%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%bf

ফারুয়া ফিরে আমি তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করলাম। আমার কাছে যা প্রতিভা হয়েছিলো তা এই :

এক। যেহেতু ঐ ওয়াচ টাওয়ারটি আনসার সৈনিক ম্যান করে তাই টি ব্রেক শেষে কিংবা দুপুরের লাঞ্চের পুর্বে ঐ বিডিআর সৈনিক আনসার সৈনিকের ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে আনসার সৈনিকের নিকট থেকে তার লোডেড থ্রি নট থ্রি রাইফেলটি নিয়ে আনসার সৈনিককে রাইফেল খোলা, জোড়া এবং রাইফেলের ম্যাগাজিনে গুলি লোড এবং আনলোড করা শিক্ষাচ্ছিলো ।

দুই। ছবিতে দেওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলের দিকে লক্ষ্য করলে দেখবেন ট্রিগার গার্ডের ভিতরে বাঁকা ছুরির মতো ট্রিগার এবং ট্রিগারের সামনে চেপটা সামান্য ফলার মতো ট্রিগারের দিকে বের হয়ে আছে লিভার। লিভারে চাপ দিলে ট্রিগার গার্ডের বাইরে রাইফেলের ম্যাগাজিন খুলবে এবং তাতে রাইফেলের গুলি লোড করা যাবে। মোট কথা লিভারে চাপ দিলে ম্যাগাজিন খুলবে এবং ট্রিগারে চাপ দিলে গুলি ফায়ার হবে।

তিন। থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ট্রিগার এবং লিভার পাশাপাশি এবং ট্রিগার গার্ডের ভিতরে হওয়াতে ঐ বিডিআর সৈনিক দাঁড়িয়ে রাইফেলের বাট নীচে রেখে দু’পায়ের মাঝে রাইফেলকে চেপে ধরে ডানবুক বরাবর রাইফেলের নল প্লেস করে সামনে ঝুকে রাইফেলের ম্যাগাজিন খুলতে গিয়ে ভূল করে বা অন্যমনষ্ক হয়ে লিভারের পরিবর্তে ট্রিগারে আঙুলের চাপ দেয়ার ফলে রাইফেল থেকে গুলি বের হয়ে বিডিআর সৈনিকের ডানবুক ভেদকরে গুলি বের হয়ে যায়। ফলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আমার কাছে এটাই ঐ বিডিআর সৈনিকের মৃত্যুর কারণ বলে মনে হয়েছিলো। আর্মিতে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে তাহলো ” Don’t fiddle with your weapon”. অস্ত্র যেমন বিপদের বন্ধু তেমনি মিসহ্যান্ডেল হলে সময়ে প্রাণ সংহারকও হয়।

চলবে...

মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন