খাগড়াছড়িতে আইনের শর্ত লঙ্ঘন করে গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ ও লাইসেন্স ছাড়াই যত্রতত্র বিক্রি, ঝুঁকিতে জননিরাপত্তা 

নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি:

খাগড়াছড়িতে বিস্ফোরক আইনের শর্ত লংঘন করে গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ ও লাইসেন্স ছাড়াই যত্রতত্র অবাধে বিক্রি হচ্ছে। পেট্রোলিয়াম জাতীয় দোকান থেকে  ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকানেও মিলছে গ্যাস সিলিন্ডার। কোথাও কোথাও জ্বালানি তেল ও গ্যাস সিলিন্ডার এক সাথে বিক্রি হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না আবাসিক এলাকাও।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দক্ষিণ খবংপুড়িয়া এলাকায় গোডাউনে অবৈধ ভাবে বিকল্প পদ্ধতিতে গ্যাস স্থান্তারিত করার সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শ্রমিকসহ ৭ জন দগ্ধ হলেও স্থানীয় প্রশাসনের টনক নড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, গোডাউনে অবৈধভাবে বিকল্প পদ্ধতিতে গ্যাস স্থানান্তরিত করার কারণে এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। ফলে খাগড়াছড়িতে আরো বিস্ফোরনে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সচেতন মহল।

খাগড়াছড়িতে শহর থেকে হাট-বাজার ও গ্রামের বিভিন্ন দোকনে আইনের তোয়াক্কা না করে বিক্রি হচ্ছে সিলিন্ডার গ্যাস।বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনাপত্তি পত্র ছাড়াই স্থানীয় পেট্রোলিয়াম জাতীয় জ্বালানি তেলের দোকান, মুদি দোকান, ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান, চায়ের দোকান, পানের দোকান, রড সিমেন্টের দোকান, জুতার দোকান, হার্ডওয়্যারের দোকান, মুরগির দোকান ও ওয়ার্কশপসহ আবাসিক এলাকার বিভিন্ন দোকানের সামনের ফুটপাতে, জনাকীর্ণ এলাকায় যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন। জেলার শহরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত সাড়ে তিন শতাধিক হাট-বাজারে প্রশাসনের নাকের ডগায় লাইসেন্স ছাড়াই এলপি গ্যাস বিক্রি করছে। আইনের তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীরা দোকানে ও গুদামে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত রেখে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।আবার যাদের লাইসেন্স রয়েছে তারাও আইনের শর্ত লংঘন করছে।

বোতলজাত গ্যাস বিপনন ও বাজারজাত করতে হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান  ও ব্যবসায়ীকে বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্সের পাশাপাশি এ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার ও বালু রাখার বাধ্যতামূলক বিধিান  থাকলেও বেশ কয়েকটি গ্যাস সিলেন্ডার গোডাউন সরেজমিন ঘুরে কোথাও চোখে পড়েনি। অথচ এসব ব্যবসায়ীরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সাধারণ ব্যবসার মতোই চালিয়ে যাচ্ছে   সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা। কেউ কেউ শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার।

গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে হলে নির্দিষ্ট পরিমান জায়গা, তাপমাত্রা, অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার, বালু, পানি ও নিরাপত্তা রক্ষাসহ যে সকল নিয়ম মেনে ব্যবসা করা প্রয়োজন তার একটিও মানছে না ব্যবসায়ীরা এমন অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে কোন অদৃশ্য ক্ষমতার বলে খাগড়াছড়ি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা।

খাগড়াছড়ি শহরের ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল, রাস্তার পাশে ও ফুটপাতে যত্রতত্র গ্যাস সিলেন্ডার বিক্রির জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। গ্যাস ডিলার সজল কুমার দে অভিযোগ করেন, অধিক মুনাফা লোভী কিছু অসাদু ব্যবসায়ীর কারণে বৈধ ব্যবসায়ীরা প্রশাসনিক হয়রানীসহ ব্যবসায়ীকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে। অপর গ্যাস সিলেন্ডার ডিলার মো. শাহ আলম চৌধুরী অকপটে স্বীকার করে বলেন, তার গ্যাস সিলেন্ডার গুদামে বালি ও পানিসহ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। কেন নেই এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা গুদাম পরিদর্শন করে সব ঠিক আছে বলে গেছেন।

স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ছাড়পত্রের প্রেক্ষিতে বিস্ফোর অধিদপ্তর লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, খাগড়াছড়িতে গ্যাস সিলেন্ডার বিক্রির লাইসেন্স প্রাপ্তরা স্থানীয় ব্যক্তি গ্যাস সিলেন্ডার বিক্রির লাইসেন্স পেয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের যোগসাজসের মাধ্যমে। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন মজুমদার। তিনি বলেন, তার এক বছর খাগড়াছড়ি দায়িত্বকালে কোন ছাড় পত্র দেওয়া হয়নি। তিনি খাগড়াছড়িতে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন স্বীকার করলেও কোন অভিযান চালাচ্ছেন না এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান।

খাগড়াছড়ি ক্যাবের সাধারন সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ এনে জননিরাপত্তার স্বার্থে যত্রতত্র গ্যাস সিলেন্ডার বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে বলেন, রাস্তার ফুটপাত, অলিগলি ও আবাসিক এলাকায় যত্রতত্র বিপদ জনক অবস্থায় গ্যাস সিলেন্ডার বিক্রি হচ্ছে। যে কয়জনের লাইসেন্স আছে, তারাও গ্যাস সিলিন্ডার মজুদে আইনের শর্ত লংঘন করছে।  প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে খাগড়াছড়িতে পুরান ঢাকার চকবাজার ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, লাইসেন্স ছাড়া কেউ বিস্ফোরক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থের ব্যবসা করছে কিনা প্রশাসন খতিয়ে দেখছে। বিধি ভঙ্গকারী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত চলছে।

জননিরাপত্তার স্বার্থে খাগড়াছড়িতে লাইসেন্স বিহীন গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির সাথে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিবে এমনি প্রত্যাশা সচেতন মহলের।

প্রসঙ্গত, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি  ভোর রাতে খাগড়াছড়ির দক্ষিণ খবংপুড়িয়া এলাকায় ক্যান্টন এন্টারপ্রাইজের এ গোডাউনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায়  শ্রমিকসহ ৭ জন দগ্ধ হয়। তাদের মধ্যে ৪ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে  চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও ঢাকা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।

এঘটনায় গঠিত বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ২ সদস্যের তদন্ত কমিটির বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন ও সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক মেহেদী ইসলাম খান সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আলামত সংগ্রহ ও ঘটনাস্থল দেখে ধারণা করা হচ্ছে এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, গোডাউনে অবৈধ ভাবে বিকল্প পদ্ধতিতে গ্যাস স্থান্তারিত করার ফলে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন