কাপ্তাই হ্রদে ১৪ বছর পর ডিম ছেড়েছে মা–মাছ

সাধন বিকাশ চাকমা:

দীর্ঘ ১৪ বছর পর রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ থেকে কার্পজাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ) মাছের ডিম সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। কাপ্তাই হ্রদ আবারও মা-মাছের প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে বলে মনে করছেন তাঁরা। দেশে হালদা নদীর পর কাপ্তাই হ্রদ হতে যাচ্ছে মাছের দ্বিতীয় প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র।

হ্রদের কাচালং চ্যানেলে গত ২ ও ৩ জুন কার্প মাছের ডিম পান গবেষকেরা। এই দুই দিনে পাঁচ কেজি ডিম সংগ্রহ করেন তাঁরা। পরে হ্যাচারিতে এসব ডিম থেকে সফলভাবে রেণু ও পোনা তৈরি করেন তাঁরা। এর মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ ও বাটা মাছের পোনা। কৃত্রিমভাবে হ্যাচারিতে ফোটানো রেণু-পোনার চেয়ে এই রেণু-পোনা অনেক দ্রুত বাড়ে।

৭০০ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ কাপ্তাই হ্রদে ৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এর মধ্যে কার্পজাতীয় মাছ রয়েছে ছয় থেকে সাত প্রজাতির। কাপ্তাই হ্রদে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন বিষয়ে সর্বশেষ গবেষণা হয় ২০০৩-০৪ সালে। ২০০৩ সালে কাপ্তাই হ্রদে সীমিত আকারে কার্পজাতীয় মাছের ডিম পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান গবেষকেরা।

গবেষকেরা বলেন, কার্পজাতীয় মাছের ডিম্বাশয়ের পরিপক্বতা আসে মে মাসের প্রথম দিকে। মে থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যেকোনো সময় বজ্রসহ ভারী বৃষ্টিপাত হলে হ্রদের প্রবল স্রোতযুক্ত স্থানে ডিম পাড়ে মা-মাছ। সে কারণে প্রতিবছর মে থেকে জুলাই পর্যন্ত তিন মাস কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাঙামাটি উপকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার বলেন, ‘কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননস্থলের বর্তমান অবস্থা নিরূপণ’ শিরোনামে তিন বছর মেয়াদি একটি গবেষণা চলছে। হ্রদের  নানিয়ারচর এলাকার চেঙ্গী চ্যানেল, বরকলের কর্ণফুলী চ্যানেল, লংগদু এলাকার কাচালং চ্যানেল ও বিলাইছড়ি এলাকার রেইংখং চ্যানেলে প্রজননক্ষেত্রের অবস্থা নিয়ে এই গবেষণা চলছে।

গবেষকেরা বলেন, অবৈধ জাগ, মা-মাছ শিকার ও কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে এক দশক ধরে কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের আকাল দেখা দেয়। যে কারণে প্রতিবছরই হ্যাচারিতে উৎপাদিত ২০ থেকে ৩০ মেট্রিক টন পোনা কাপ্তাই হ্রদে ছাড়া হয়।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার বলেন, হ্রদের চারটি প্রজননক্ষেত্রে এসব মাছ ডিম ছাড়ে। চারটি প্রজননক্ষেত্রের মধ্যে চেঙ্গী ও রেইংখং চ্যানেলে পানির প্রবাহ কমে গেছে। বাকি দুটি প্রজননক্ষেত্র কর্ণফুলী ও কাচালং চ্যানেলে প্রজননের পরিবেশ আছে। এই দুটি চ্যানেলের মধ্যে কাচালং চ্যানেলে গত মাসে ডিম পেয়েছেন তাঁরা।

কাপ্তাই হ্রদে এখন থেকে কার্প মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন সম্ভব বলে ভাবছেন গবেষকেরা। এ জন্য মা-মাছ সংরক্ষণ করতে হবে। হ্রদে মাছের সাতটি অভয়াশ্রম থাকলেও সেগুলো সুরক্ষিত নয়। কার্প মাছের প্রজনন বাড়ানোর জন্য এসব অভয়াশ্রম রক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। অবৈধ জাগ বসানো বন্ধ ও অবৈধ জাল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ বাড়বে বলে জানান গবেষকেরা।

১৯৬০ সালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর ফলে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয়। দুই দশক আগে সুপেয় পানির মাছের ভান্ডার ছিল এই হ্রদ। কিন্তু হ্রদে অপরিকল্পিতভাবে জাগ দেওয়া, অবৈধ জাল ব্যবহার ও মা-মাছ সংরক্ষণের অভাবে মাছের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

গবেষকেরা বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে চার-পাঁচ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে (মাছের প্রজনন মৌসুমও) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আগের গড়ে ৩ থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে। প্রাকৃতিক এই পরিবর্তন মা-মাছের ডিম ছাড়ার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এক যুগ আগে কার্পজাতীয় মাছের বড় প্রজননক্ষেত্র ছিল মেঘনা ও পদ্মা নদী। কিন্তু দূষণ ও অতিরিক্ত পলি জমায় ওই দুই নদীতে এখন আর মা-মাছ আগের মতো ডিম পাড়ে না। এখন হালদা নদীই দেশের কার্পজাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র।

সূত্র: প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন