এরশাদের আমলে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের চেষ্টা

Untitled-110

(পাঁচ)
১৯৮৪ সালে ১৯ জানুয়ারি রাঙ্গামাটির মারিশ্যা এলাকায় শেলওয়েল কোম্পানীর ৫ জন বিশেষজ্ঞকে শান্তিবাহিনী অপহরণ করে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ২৯ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে মুক্তি দেয়। ১৯৮৪ সালের ১০ মে পার্বত্য এলাকার জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ ও ভয়াবহ হত্যাকান্ডটি হচ্ছে ভূষণছড়া হত্যাকান্ড। রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার ভূষণছড়া এবং তার পাশ্ববর্তী এলাকার বাঙ্গালিরা এই নির্মম ঘটনার শিকার। ১৯৮৪ সালের ৩০ মে রাত আনুমানিক ৪টা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সংঘটিত ভূষণছাড়া গণহত্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়।

Bangladesh Economist, 1 July 1984: Vol-2 এ প্রকাশিত Ali Murtaza লিখিত Message at dawn শীর্ষক নিবন্ধ লিখেছেন- The beheaded body of young woman Rizia Kahatun was found lying at Porabari Para of Bhushanchara settlement with her dead body in the position of suckling her bosom. Both hands of yet another baby were found severed. Yet another infant was wee cut by half. A seven day old boys was bayoneted to death in front his parents.

Bangladesh Today, 16-30 June 1984- এ প্রকাশিত Moinuddin Nasser- এর Message at Bhushanchara শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, A group of about 150 members of the Shanti Bahinis headed by one Major Moni Shwapan Dewan, Launched the attack on the BDR camn and Bangali Settler at the Bhushanchara Union of Barkal Upozila in the early hours of May 31.

The insurgents, including their female cadres, in two groups launched the armed attack at 4 a.m. which continued till 8.30 a.m. They abruptly opened fire and killed the youth, women, children, elderly people and even the livestock. From three rehabilitation zones at Bhushanchara Union under Barkal Upozila about 186 dead bodies of men, women, youth and babies were recovered till the writing of the report. It is learnt that a large number of cropses which could not be recovered were geting decomposed in the area. It is recorded that a total of about 500 people including BDR personel, were injured in the raid. According to a reliable source, several BDR personel were also killed.

আতিকুর রহমান লিখেছেন- কলাবন্যা, গোরস্থান, ভূষণছড়া, হরিণা হয়ে ঠেকামুখ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিরাট এলাকাজুড়ে সন্ধ্যা থেকে আপতিত হয় ভয়াল নিস্তব্ধতা। কুকুর-শিয়ালেরও সাড়া-শব্দ নেই। আর্মি, বিডিআর, ভিডিপি সদস্যরাও ক্যাম্পে বন্দী। অতর্কিতে পূর্ব দিক থেকে প্রথম ধ্বনিত হয়ে উঠল একটি গুলির শব্দ। তৎপরই ঘটনাবলির শুরু। চতুর্দিকে ঘর-বাড়িতে আগুন লেলিহান হয়ে উঠতে লাগল। উত্থিত হতে লাগল আহত-নিহত অনেক লোকের ভয়াল চিৎকার এবং তৎসঙ্গে গুলির আওয়াজ, জ্বলন্ত গৃহের বাঁশ ফাটার শব্দ, আর আক্রমণকারীদের উল্লাসমুখর হ্রেসা ধ্বনি। এভাবে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, আর্তচিৎকার ও উল্লাসের ভেতর এক দীর্ঘ গজবি রাতের আগমন ও যাপনের শুরু। চিৎকার, আহাজারি ও মাতমের ভেতর সূর্যোদয়ে জেগে উঠল পর্যদস্ত জনপদ। হতভাগা জীবিতরা আর্তনাদে ভরে তুলল গোটা পরিবেশ। অসংখ্য আহত ঘরে ও বাইরে লাশে লাশে ভরে আছে পোড়া ভিটা। এতো লাশ, এতো রক্ত আর এতো ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ-এক অর্ধরাতের ভেতর এলাকাটি বিরান। অদৃষ্টপূর্ব নৃশংসতা। অভাবিত নিষ্ঠুরতা। ওয়ারলেসের মাধ্যমে এই ধ্বংসাত্মক দুর্ঘটনার কথা স্থানীয় বিডিআর ও আর্মি কর্তৃপক্ষ ঊর্ধ্বমহলে অবহিত করে। শুরু হয় কর্তৃপক্ষীয় দৌড়ঝাপ, আগমন ও পরিদর্শন। চলল লাশ কবরস্থ করার পালা ও ঘটনা লুকানোর প্রক্রিয়া। ঘটনাটি যে কত ভয়াবহ, মর্মন্তুুদ আর অমানবিক এবং শান্তিবাহিনী যে কত হিংস্র পাশবিক চরিত্রসম্পন্ন মানবতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক সংগঠন, তা প্রচারের সুযোগটাও পরিহার করা হলো। খবর প্রচারের ওপর জারি করা হলো নিষেধাজ্ঞা।

ভাবা হলো: জাতীয়ভাবে ঘটনাটি বিক্ষোভ ও উৎপাতের সূচনা ঘটাবে। দেশজুড়ে উপজাতীয়রা হবে বিপন্ন।
ঘটনার ভয়াবহতা আর সরকারি নিষ্ক্রিয়তায় ভীত সন্ত্রস্ত অনেক সেটেলারই স্থান ত্যাগ করে পালাল। পলাতকদের ঠেকাতে পথে-ঘাটে, লঞ্চে-গাড়িতে, নৌকা ও সাম্পানে চলল তল্লাশি ও আটকের প্রক্রিয়া। তবু নিহত আর পলাতক মিলে সংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হলো ওই জনপদ থেকে লাপাত্তা। শুরু হলো জীবিতদের মাধ্যমে লাশ টানা ও কবরস্থ করার তোড়জোড়। খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। চারিদিকে কেবল পঁচা লাশের দুর্গন্ধ, পালানোরও পথ নেই। নিরূপায় জীবীতরা লাশ গোছানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। দয়া পরবশ কর্তৃপক্ষ কিছু আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে এলো। এটাকে দয়া বলা ছাড়া উপায় কি? পেটে খেলে পিঠে সয়, এ যেন তাই।’
বরকল গণহত্যায় পাহাড়িদের অনেকে ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করে। বাংলাদেশ-ভারত দুই সরকারের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তারা দেশে ফিরতে বাধ্য হয়। দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপক্রম হলে আবারও তারা ভারতে আশ্রয় নেয়। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার সেনা ও পুলিশের সহায়তায় তাদেরকে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে প্রথম আলোচনা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে। ১৯ এপ্রিল প্রীতি গ্রুপ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২১ অক্টোবর খাগড়াছড়িতে পুজগাং-এ সর্বপ্রথম সরকার ও জনসংহতির বৈঠক বসে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের ‘সঠিক পথে আনয়নে’ সরকার সর্বপ্রথম এক মাসের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। ১৯৮৭ সালের ৫ জুন যোগাযোগের কারণে শরণার্থী প্রত্যাবাসন পন্ড হয়ে যায়। ১৭ আগষ্ট পার্বত্য সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নরসীমা রাও বাংলাদেশে আসেন। ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জেলা পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে সরকার ও জনসংহতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দফা বৈঠক। ১৯৮৮ সালের ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জনসংহতি সমিতি সরকারের কাছে তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পুনরুল্লেখ করে।

১৯৮৮ সালের ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ বৈঠক হয়। এপ্রিল মাসে খুন হয় ৪২ জন বাঙ্গালি। ১৪ ও ১৫ মে সরকার ও জনসংহতি সমিতির ষষ্ঠ বৈঠক বসে। ১০ জুন দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ঈশ্বরী গুপ্তের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। ১৯ জুন জনসংহতির সাথে সরকারের পঞ্চম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৯ জুলাই রাষ্ট্রদূত ফারুক আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি দল ত্রিপুরার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে শরণার্থীদের ফিরে আসার আহবান জানান। ২৮ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের দু’জন সদস্যকে শান্তিবাহিনী অপহরণ করে। ২৭ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান শান্তিময় দেওয়ান নিহত হন।
১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে পার্বত্য স্থানীয় সরকার বিল পাস হয়। জাতীয় সংসদে বিলটি উত্থাপন করেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জুর। ১৬ ফেব্রুয়ারি উপজাতি ও অ-উপজাতিদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় শান্তি চুক্তি। ১৪ মার্চ সর্বপ্রথম পার্বত্য সমস্যা নিয়ে বঙ্গভবনে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক বসে। ১৬ মার্চ সামরিক বাহিনী উপজাতীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে। ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মে পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমার সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়। ২৪ এপ্রিল তিন পার্বত্য এলাকায় নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। ৪ মে লঙ্গদুতে হামলায় নিহত হয় ২৫ জন। ৩১ মে উপেন্দ্রলাল চাকমা শরণার্থী হিসেবে ত্রিপুরায় চলে যান। ২৫ জুন স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৯০ সালের ২৫ জুলাই শান্তিবাহিনী রাঙ্গামাটি রেডিও স্টেশন দখল করে। একই সালে রাঙ্গামাটিতে ধর্ষিত হয় ১৪ জন কিশোরী। ২৩ মার্চ শান্তি বাহিনীর হামলায় লঙ্গদুতে ৩ জন হতাহত হয়। ১৯৯০ সালের ২ থেকে ১৭ মে ১৫ দিনব্যাপী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জাতীয় কংগ্রেস ও কর্মী সম্মেলন উলুঝড়ি (বটতলি), ভেওরতন নগর ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত হয়। এটাই জনসংহতি সমিতির সর্বশেষ কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। কংগ্রেস চলাকালে ১৪ মে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নিন্মোক্ত ২৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল।

১. সভাপতি- সন্তু লারমা (কমান্ডার), ২. সাধারণ সম্পাদক- গৌতম চাকমা অশোক (পরিচালক-পররাষ্ট্র), ৩. সামরিক উপ-প্রধান (উত্তর)- উষাতন তালুকদার (মেজর মলয়), ৪. পররাষ্ট্র (সহকারী পরিচালক)- কালী মাধব চাকমা (মেজর মিহির), ৫. তথ্য ও প্রচার বিভাগ- রূপায়ন দেওয়ান (মেজর রিপ), ৬. শিক্ষা ও গ্রাম পঞ্চায়েত- মেজর শংকর, ৭. সামরিক উপ-প্রধান (দক্ষিণ)- অংজয়, ৮. জে.বি. ফোর্স কমান্ডার  মেজর দেবাশীষ, ৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন- মেজর উত্তরণ, ১০. রাজনৈতিক উপদেষ্টা- মেজর যদুনাথ, ১১. মারমা বিষয়ক উপদেষ্টা- মেজর কংহাট, ১২. ত্রিপুরা বিষয়ক উপদেষ্টা- প্রণব, ১৩. যুগ্ম-পরিচালক (মুখ্য)- মেজর সপ্তর্ষি, ১৪. খাদ্য ও সরবরাহ পরিচালক- মেজর সমেশ, ১৫. সদস্য- লোকভার, ১৬. সদস্য- রবি,১৭. সদস্য- মনোজ, ১৮. সদস্য- মন্টু, ১৯. সদস্য- কান্ত, ২০. সদস্য- ঈশ্বর, ২১. সদস্য- দেবাংশু, ২২. সদস্য- মর্কেশু, ২৩. সদস্য- পাইলট, ২৪. সদস্য- প্রতিম, ২৫. সদস্য- উপেন।
(চলবে..)

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

2 Replies to “এরশাদের আমলে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের চেষ্টা”

  1. Hi there i am kavin, its my first occasion to commenting anyplace, when i read this article i thought i could also create comment due to this brilliant paragraph.

  2. I am not sure where you are getting your info, but great topic. I needs to spend some time learning more or understanding more. Thanks for fantastic information I was looking for this info for my mission.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন