উগ্রজাতীয়তাবাদ,ইসলামী সম্প্রসারণবাদ এবং শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশিক মনমানসিকতার কারণে পার্বত্য শান্তিচুক্তি অবরুদ্ধ- সন্তু লারমা

fffffff

নিজস্ব প্রতিনিধি:

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা বলেছেন,   সরকারের একটি অংশের উগ্রজাতীয়তাবাদ ও তার সাথে উগ্র ইসলামিক সাম্প্রসারণবাদ যুক্ত হয়ে পার্বত্য চুক্তি যাতে বাস্তবায়ন হতে না পারে সেই যড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

এমএন লারমাকে যারা হত্যা করেছিল সেই উত্তরসুরিরা ও সেই পক্ষের শক্তিরা আজও পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে সক্রিয় রয়েছে। তারা আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকার আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করে পার্বত্য চুক্তিকে পদদলিত করে জুম্মজনগনের আশা-আকাংখাকে ধুলিসাৎ করার উদ্যাত রয়েছে।তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী সততার অধিকারী নয়।

ফলে ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হতে পারেনি। পাশাপাশি সকল ক্ষেত্রে উগ্রজাতীয়তাবাদ,ইসলামী সম্প্রসারণবাদের চিন্তাভাবনা এবং শাসকগোষ্ঠীর উপনেবিশক মনমানসিকতার কারণে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বুকে চলছে জুম্ম জনগণের অস্তিত্বকে চিরতরে বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র।

সন্তু লারমা বলেন, ষড়যন্ত্র আজও থামেনি। জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করতে জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীলরা মরিয়া। তারা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এমএন লারমাকে শুধু নিজেদের স্বার্থ পূরণ করতে নৃশংসভাবে হত্যা করেনি, তারা জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে চিরতরে ধংস করে দিতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে হাত মিলিয়েছিল।

যারা এমএন লারমাকে হত্যা করেছে তারাই আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বুকে জুম্মস্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সব ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে জোরদার করার আহবান জানান সন্তু লারমা।

তিনি আরও বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ ১৮টি বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু চুক্তি আজও অবাস্তবায়িত। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের কোনো সদিচ্ছাই নেই। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার অনেক কথা বলে, কিন্তু এ নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাই না।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বড় অন্তরায় হচ্ছে শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর অব্যাহত ষড়যন্ত্র, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা এবং সশস্ত্র সন্ত্রাস। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আন্দোলনের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করতে হবে সরকারকে। এজন্য জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে।

বৃহস্পতিবার রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাবেক সংসদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার(এমএন লারমা) ৩৩ তম মৃত্য বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ সভায় সন্মানিত অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।রাঙামাটি শিল্পকলা মিলায়তনে আয়োজিত স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার সভাপতি সূবর্ণ চাকমার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃাত রঞ্জন চাকমা, শিক্ষাবিদ মংসানু চৌধুরী,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক কল্পনা চাকমা, সাংস্কৃতি কর্মী শিশির চাকমা । বক্তব্যে রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি জুয়েল চাকমা। অনুষ্ঠানে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন আনন্দ জ্যোতি চাকমা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে আন্দোলনে সংগ্রামে নিহতদের উদ্দেশ্য দাড়িয়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এর আগে শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ বেদীতে পুস্পমাল্য অর্পণ করেন সন্তু লারমা,চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। জেলা শিল্পকলা একাডেমী চত্বর থেকে বনরুপা এলাকা পর্ষন্ত বের করা হয় প্রভাতফেরী। এতে সর্বস্তরের লোকজন অংশ নেন। বিকালে আয়োজন করা হয় কতিবা পাঠের আসর, হাজার বাতি প্রজ্জ্বালন ও ফানুস বাতি উড়ানো হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলেন,পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত থাকে তাহলে পার্বত্য চুক্তি যথায়ত বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বলা যাবে না। এখানে পার্বত্য চুক্তিুর মৌলিক বিষয়ের মধ্যে যতক্ষন পর্ষন্ত পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদের ভূমিকা ও যথাযথ প্রতিপালন, জুম্ম শরনার্থী এবং অভ্যন্তরীন উদ্ধাস্তুদের যথাযথ পূনর্বাসন এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনসহ এই চারটি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হতে না পারে।

যতই ১শ অথবা ৭০ শংতাংশ বা ৯০ শতাংশ বলা হয় তাহলে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন অর্থহীন। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াতে আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে। যাতে বাংলাদেশ সরকার আক্ষরিক অর্থে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করে। তিনি নারী, যুব সমাজ ও জুমিয়া সমাজকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে আসার গুরুত্বারোপ করেন।ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের ব্যাপারে নাগরিক সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে মন্তব্য তিনি আরো বলেন, পার্বত্য ভূমি কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন প্রথা রীতিনীতি আলোকে বিচারিক প্রথা ভূমিকা রাখতে পারে।

এ ব্যাপারে হেডম্যান কারবারী,আইনজীবি রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের কাছে আইন প্রথা রীতিনীতি সম্পষ্ট হতে হবে। কারণ আইনের সাথে প্রথা ও রীতি একই নয়। প্রথা ও রীতি কোন কোন সময়ে; গোত্রকে অনুসরণ করে থাকে। তবে চাকমা সার্কেলসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার কমিটি ও হেডম্যান নেটওয়ার্ক আইন প্রথা রীতিনীতি বিষয়ে জনসাধারনকে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভের ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালনের কাজ করছে।

তবে এ জন্য সকলের সহযোগিতা কাম্য এবং আশা করবো সর্বস্তরের জনগণ এগিয়ে আসবে। যাতে মানুষ সচেতন হয় এবং যথাযথভাবে লিখিতভাবে, মৌখিকভাবে প্রমাণ নিয়ে ভূমি কমিশনের কাছে আসতে পারে। যাতে ভূমি কমিশন নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সাথে তার কাজ করতে পারে।

উল্লেখ্য, এমএন লারমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, সাবেক পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর বিভেদপন্থী প্রীতি গ্রুপের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন