আরাকানে সেনাবাহিনীর চিরুনী অভিযানে নিহত ৮৯


সংশ্লিষ্ট টাউনশিপগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, পুলিশ ফাঁড়ির এসব হামলার সঙ্গে কট্টর কোন বিদ্রোহী গোষ্ঠী জড়িত নয়। সেনাবাহিনীর নৃশংতায় অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসীরা এ কাজ করেছে।


আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুক্রবার জঙ্গি হামলার পর মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮৯ জনে দাঁড়িয়েছে বলে দেশটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। সংঘর্ষ ক্ষেত্রের আশে পাশে অনেক রোহিঙ্গার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় বলেও কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করে।

সূত্র জানায়, হামলার সময় আহত অনেক বিদ্রোহীর লাশ বিভিন্ন মাঠ ও এলাকার রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মং তাও, ভুচিদং ও রাচিদং টাউনশিপকে ঘিরে এই হামলা চালানো হয়।  গত বছর অক্টোবরে বিদ্রোহীরা যে কয়েকটি এলাকায় হামলা চালায় এবারের হামলা ছিলো তার চেয়ে অনেক বড় এলাকা ঘিরে।

হামলায় অন্তত ১১ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ১ সদস্য নিহত হয় বলে জানা যায়। স্বাধীনতাকামী একযোগে ১৯টি পুলিশ ফাঁড়ি ও ৫৫২ লাইট ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্টের একটি ঘাঁটিতে হামলা চালায়।

সেনাসূত্র জানায়, অন্তত এক হাজার বিদ্রোহী এই হামলায় অংশ নেয়। এদের সঙ্গে মং থাও, ভুচিয়াদং ও রাচিদংয়ের অনেক অধিবাসী ও সশস্ত্র গ্রামবাসী চাপাতির মতো ধারালো অস্ত্র নিয়ে যোগ দেয়। তবে সেনাক্যাম্পে হামলা প্রতিহত করা হয় বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করে।

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান তার রাখাইন কমিশন রিপোর্ট স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচি’র হাতে তুলে দেয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্য দিয়ে রাখাইন রাজ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটলো।

দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকা রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহীরা গত বছর অক্টোবরে হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দেয়। তখন রাখাইন বিদ্রোহিরা একযোগে হামলা চালিয়ে নয় পুলিশকে হত্যা করে। এর জের ধরে দেশটির সেনাবাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান শুরু করে। এসময় সেনাবাহিনী নির্বিচার হত্যা, গণধর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।

শুক্রবার হামলার দায় স্বীকার করেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)। এই গ্রুপটির আগে নাম ছিলো হারাকাহ আল-ইয়াকিন বা ফেইথ মুভমেন্ট। গত অক্টোবরের হামলার জন্যও এই গ্রুপটিকে দায়ি করা হয়।

স্থানীয় সময় রাত ১টার দিকে রাখাইনের উত্তর অংশে মং তাও উপশহরের কাছে বিভিন্ন গ্রামের ২৪টি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর একযোগে হামলা চালানো হয়। গেরিলা ও সশস্ত্র গ্রামবাসী স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে এসব হামলা চালায় বলে স্টেট কাউন্সিলরের তথ্য অফিস থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়।

তাতামাদাও সেনাবাহিনী থেকে দেয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শুক্রবার ভোররাত ৩টার দিকে খামারা এলাকায় ৫৫২ লাইট ইনফ্রেন্টি রেজিমেন্টের একটি শিবিরে বিদ্রোহীরা হামলা চালানোর চেষ্টা করে। এতে এক সেনা নিহত হয়। তবে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করা হয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

সেনাবাহিনী জানায় অন্তত ৭৭ বিদ্রোহী গুলিতে নিহত হয়, এদের অনেকে সেনাক্যাম্পে হামলার চেষ্টা করে।

তবে, সংশ্লিষ্ট টাউনশিপগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, পুলিশ ফাঁড়ির এসব হামলার সঙ্গে কট্টর কোন বিদ্রোহী গোষ্ঠী জড়িত নয়। সেনাবাহিনীর নৃশংতায় অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসীরা এ কাজ করেছে।

মংডু’র এক প্রবীণ অধিবাসী বলেন, চিরুনি অভিযানের সময় এসব গ্রামবাসীর অনেককে সৈন্যরা পরে গুলি করে হত্যা করেছে।

সেনাবাহিনীর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কিছু রোহিঙ্গা বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে,  সরকার ও সেনাবাহিনীকে বিব্রত করতে রোহিঙ্গারাই নিজেদের বাড়িঘরে আগুন লাগায় বলে সেনাবহিনী দাবি করে।

রাখাইনের পুলিশ প্রধান কর্নেল সিয়েন লইন নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, হামলায় আহতদের অনেকে রক্তক্ষরণে মারা যায়। এদের মধ্যে পুলিশ ও বিদ্রোহী উভয়ই রয়েছে। মংডু থেকে ভুচিয়াদং পর্যন্ত সড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পান্নাপিবিন্ত ওয়েবসাইটে ধান ক্ষেতে পড়ে থাকা এক দীর্ঘদেহী বিদ্রোহীর ছবি প্রকাশ করা হয়। লাশের পাশে একটি লম্বা তরবারি পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওয়েবসাইটে মারাত্মকভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে এমন পুলিশের লাশের ছবিও প্রকাশ করা হয়।

সংঘর্ষে নিহত হামলাকারিদের সবাই সশস্ত্র গেরিলা, নাকি তাদের মধ্যে গেরিলা ও গ্রামবাসী রয়েছে তা স্পষ্ট নয়।

হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে রাখাইন জঙ্গিরা ক্রমেই ভারতের মাওবাদি বা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালিবান ও ভারতীয় কাশ্মিরে মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের কৌশল গ্রহণ করছে। হামলার আগে গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে বিপুল সংখ্যক সমর্থক সমবেত করা হয়। এদেও মধ্যে লুকিয়ে থেকে গেরিলারা হামলায় অংশ নেয় বলে দাবি করা হয়। পরে এসব গ্রামবাসী নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আরো বেশি নৃশংসতার স্বীকার হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় গেরিলাযুদ্ধগুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে এবং আঞ্চলিক বিদ্রোহগুলোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ সুবীর ভৌমিক বলেন, “এটা নিরাপত্তা বাহিনীকে বিচলিত করে তুলেছে, যা ঘটনাবলীকে আরো নৃশংসতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মানে হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকতর বিচ্ছিন্নতা তৈরি হবে এবং বিদ্রোহীরা আরো বেশি সদস্য সংগ্রহ করার সুযোগ পাবে। শুধু সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়া নয় একটি ‘রিক্রুটমেন্ট বেজ’ তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে বিদ্রোহীরা এগিয়ে যাচ্ছে। এখন সেনা নেতৃত্বকে বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা অনুধাবন ও তাদের বাহিনীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

উত্তর রাখাইনের মাইয়ু পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ অভিযান শুরুর পর এটাই রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের তরফ থেকে সবচেয়ে বড় ও সংঘবদ্ধ হামলা। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আস্তানাগুলোকে ঘেরাও করে দেশটির ৩৩ লাইট ইনফেনট্রি ডিভিশন এখন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্রোহীদের বাংলাদেশে পালানোর পথগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এদিকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান রাখাইনে দীর্ঘদিন ধরে চলা সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে মানবাধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির ওপরও জোর দেন। বৃহস্পতিবার দেশটির সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হিলাংয়ের সঙ্গে বৈঠকে আনান এসব কথা বলেন।

পরে সেনাপ্রধান কফি আনান রিপোর্টের কিছু তথ্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাখাইনে চলমান সেনা অভিযান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এক টুইটার বার্তায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এধারএসএ) ওই হামলার দায় স্বীকার করে। তবে, এই ঘটনায় কতজন নিহত হয় বা গ্রুপটির কতজন সদস্য জড়িত ছিলো সে বিষয়ে কিছু বলেনি।

টুইটার পোস্টে এআরএসএ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, ধর্ষণের অভিযোগ এনে বলে তারা শুধু ২৫টি বিভিন্ন লোকেশনে ‘আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ গ্রহণ করেছে।

এতে বলা হয়, সেনাবাহিনী উত্তর রাখাইনের রোহিঙ্গা টাউনশিপ রাথেতাউং দুই সপ্তাহ ধরে অবরোধ করে রেখেছে। সেখানে রোহিঙ্গারা না খেয়ে মারা যাচ্ছে।

বার্তায় আরো বলা হয়, তারা মংডুতেও একই কাজ করতে যাচ্ছে। তাই আমাদেরকে বার্মার ঔপনিবেশিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

আগামীতে আরো হামলা চালানো হবে বলে গ্রুপটি সতর্ক করে দেয়।

সৌদি আরবে জন্মগ্রহণকারী এক রোহিঙ্গা আতাউল্লাহ আরএসএ’কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বিদেশী কোন গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা অস্বীকার করেন। তবে ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্র দাবি করছে যে এআরএসএ’র সঙ্গে বাংলাদেশের জামাত-উল-মুজাহিদিন, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন ও পাকিস্তানের লস্কর-ই-তাইবা (এলইটি)’র যোগসাজশ রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন