বাংলাদেশে তথাকথিত ‘আদিবাসী’ প্রচারণা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ

trib

ড. খুরশীদা বেগম

বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের শিরোনামে ‘আদিবাসী’ পদ (Term)-এর আগে ‘তথাকথিত’ শব্দটি দ্বারা সুস্পষ্টরূপে নির্দেশ করা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত নিখাদ (তাদের একটি ক্ষুদ্রাংশ বাদে) নাগরিকদের রক্তধারা-উপধারাগত সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোত্রীয় পরিচয় এবং এই ভূখণ্ডে বসবাসের অতীত সময়কালকে অযৌক্তিকভাবে একীভূত করে সম্প্রতি যত্রতত্র ব্যবহৃত ‘আদিবাসী’ পদটি সত্য নয় এবং কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে এসব জনমানুষের নৃগোষ্ঠীগত নিজস্ব পরিচয় বিশাল বাঙালি নৃগোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকদের চেয়ে এতটুকুও তুচ্ছ এবং তাদের যাবতীয় নাগরিক অধিকার-দায়িত্ব-কর্তব্য একবিন্দু কম। সবাই বাংলাদেশের সম্মানীয় নাগরিক। এখানে একটি অসত্য পারিভাষিক শব্দের (Terminological inexactitude) চিন্তাশূন্য প্রয়োগ ও ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে মাত্র। ১৯৪০-৪৭ সালের শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমসহ রাজনীতিকদের একাংশের ‘দ্বি-জাতি’ পদ ব্যবহারের ভুলের খেসারত এখনো এই বাংলাদেশেরই অর্ধশতাধিক ক্যাম্পে ধুঁকে ধুঁকে দিচ্ছে লাখ লাখ অবাঙালি অভিবাসনকারী। এ প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত সামনে রেখে নির্দেশ করা অত্যাবশ্যক যে তথাকথিত আদিবাসী প্রচারণা দেশের ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকদের কল্যাণঘাতী, বাঙালি নৃগোষ্ঠীর সব রাজনৈতিক সংগ্রাম ও স্বপ্নঘাতী এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থঘাতী।
বাংলাদেশের বিদাহী রাজনীতির পরিমণ্ডলে নাভিশ্বাস ওঠা প্রাত্যহিক জনজীবনে এটি আরেকটি অশুভ সংযোজন, যার প্রবল ধাক্কা অতি নিকট ভবিষ্যতে এ দেশের জনগণকেই সামলাতে হবে। এই অশনিসংকেতের মুখোমুখি ব্যথিত প্রশ্ন, অথবা দাহিত হতাশা, আর কত?
১. বাংলাদেশে আদিবাসী-ভুল প্রচারণার চারিত্র্য
বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ পদটি একাধারে একটি সাম্প্রতিক আরোপণ, একটি ভুল পারিভাষিক পদ প্রচারণা, একটি ক্রমশ বিস্তৃত বিভ্রান্তি, একটি খাপছাড়া ভাবাবেগ, পূর্বাপর সংগতিবিহীন ‘উদারতাবাদী’ অভিধা লাভের অভিলাষ এবং দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে নানা মারাত্মক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
রাজনীতির সূক্ষ্ম-জটিল, কখনো ক্রুর-কঠিন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান অমনস্ক যেকোনো আবেগপ্রবণতার চড়া মূল্য অবধারিত। বাংলাদেশে ‘আদিবাসী ভুল প্রচারণায় যাঁরা নির্বিকার অংশগ্রহণ করছেন তাঁরা হয়তো বা তাঁদের অজান্তেই জাতীয় স্বার্থবিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।’
আদিবাসী প্রচারণা আরেকটি মারাত্মক ইতিহাস বিকৃতি। বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কবলে নিপতিত। শুদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা আজ বহুদিন ‘চিৎকার’ করছেন, কিন্তু জনজীবন উৎসজাত ‘প্রকৃত’ রাজনীতিকদের দুর্বলতা বা অদূরদর্শিতা অথবা ব্যর্থতা-অপারগতায় আজও তাদের প্রতিহত করা যায়নি। অবাধে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ বিচরণ করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধীরা। নানা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে, আগুনে, মৃত্যুতে, নির্যাতনে পতিত এখন জনজীবন।
২. ‘আদিবাসী বললে কী হয়?
নিবন্ধের এই উপশিরোনামটি লেখিকার কাছে উত্থাপিত অনেকের সরল প্রশ্ন এবং মৌখিক ভাষার এই সংক্রমণ থেকে তিনি নিজেও রেহাই পাননি। অল্প সময়ে এই সংক্রমণ কাটিয়ে ওঠা গেছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শাস্ত্রের পারিভাষিক শব্দ বিশ্লেষণের আবশ্যকতায়। নিজ অভিজ্ঞতা সূত্রে দুটি বিষয় স্পষ্ট যে প্রথমত, দেশে শব্দটি প্রচলিত হচ্ছে; দ্বিতীয়ত, এর পেছনের উদ্দেশ্য ছোট-বড় নৃগোষ্ঠীভুক্ত সাধারণ জনগণের কাছে অজানা। এর প্রচলন এমন সরল আদলে ঘটছে, যেন বাঙালি ছাড়া অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর, প্রধানত মঙ্গোলীয় আদলের চেহারার জনগণের জন্য ঢালাওভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটিই প্রযোজ্য এবং তা বাংলা ভাষার একটি আধুনিক রূপ! সেই সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ‘অনগ্রসর’ শব্দটি; যদিও বাংলাদেশের কয়েক লাখ গরিব-দুঃখী ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত জনগণের বৃহদাংশ শুধু নয়, বিশাল বাঙালি নৃগোষ্ঠীর কয়েক কোটি গরিব-দুঃখী জনগণও একই ধরনের অনগ্রসর। খাদ্য-পুষ্টি-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা এবং শোষণ, অপশাসন ইত্যাদি বিচারে কার চেয়ে কে অনগ্রসর, কে ‘বেশি’ দুঃখী, কে ‘বেশি’ নিপীড়িত-নিষ্পেষিত বলা কঠিন বৈ নয়।
নৃগোষ্ঠীগত বিভাজন পারস্পরিক দূরত্ব, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও প্রীতিহীনতার জন্ম দেয়। রাষ্ট্রের অর্থ-সম্পদ-সুবিধাদির বরাদ্দ নৃগোষ্ঠী বিভাজনপূর্বক নয়, মানুষের প্রয়োজন ও এলাকাভিত্তিক বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে অকুণ্ঠ হওয়া আবশ্যক। ছোট ও বড় নৃগোষ্ঠীর যে একটি ক্ষুদ্র অংশ ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে যাচ্ছে অথবা হয়ে আছে, ভূমি, সম্পদ ও সুবিধা বণ্টনের বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি সেদিকে নিবদ্ধ করে কিছু করা গেলে সব নৃগোষ্ঠীর দুঃখী মানুষদের অগ্রসর জীবন নিশ্চিত করা অনেক সহজ হতো। সেটাই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
বর্তমান নিবন্ধে তথাকথিত আদিবাসী প্রচারণা বিষয়ে জনগণের হাতে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় স্বার্থগত সংগত প্রশ্ন তুলে দেওয়া হলো।
এক. ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য ‘আদিবাসী’ পদটি কি বাংলাদেশের ইতিহাস সমর্থিত?
দুই. এই ‘পদ’টির প্রতি, অতিসম্প্রতি ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর (প্রধানত: পার্বত্য চট্টগ্রামের) নেতৃত্বের এত আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন?
তিন. ‘আদিবাসী’ পদ ও জাতিসংঘের ঘোষণা কি বাংলাদেশের জন্য আদৌ প্রযোজ্য?
চার. ‘আদিবাসী’ পদ প্রতিষ্ঠা দ্বারা বাংলাদেশের ভূমির অখণ্ডতার (Territorial integrity) ওপর কি কোনো আঘাত আসতে পারে? দেশের প্রতি ইঞ্চির ভূমির ওপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের স্বরূপ কী হবে?
পাঁচ. ‘আদিবাসী’ পদকেন্দ্রিক নৃগোষ্ঠীগত রাজনীতি কি বাংলার জনজীবনের শান্তি বিঘি্নত করতে পারে?
ছয়. ইতিহাস অসমর্থিত ‘আদিবাসী’ শব্দের পক্ষে পুস্তক-পুস্তিকা, মুদ্রণ মাধ্যম, ‘ইলেকট্রনিক’ মাধ্যম ইত্যাদিতে এখন যাঁরা ভাবাবেগে অংশ নিচ্ছেন, সারা দেশে যদি এই কৃত্রিমতার প্রায়োগিক বাস্তবতায় নৃগোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সৃষ্টি হয়, তাঁরা তখন কিভাবে সামাল দেবেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দৃষ্টান্ত সামনেই আছে।
সাত. এই নৃগোষ্ঠীগত রাজনীতি (Ethnic-politics) কি জাতীয় সংহতি (National integration) অর্জন সাপেক্ষে জাতীয় শক্তি (National power) বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে?
আট. এই পদ বাংলাদেশে কি নিরাপত্তার কোনো হুমকি সৃষ্টি করতে পারে?
৩. জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশে ‘আদিবাসিত্বের’ কৃত্রিম পুঁজি
ওপরে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো সূত্রে এ মর্মে কৌতূহল স্বাভাবিক যে এই একটিমাত্র ছোট শব্দ এত বহুমাত্রিক সমস্যার সম্ভাব্য উৎস কেন ও কিভাবে হয়?
সংক্ষিপ্ত উত্তর, ২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনের United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples, বাংলায় যা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্র, যা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তবতায় ঘোষণাপত্রটি পাঠপূর্বক প্রতীয়মান হয় যে এর উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এটি অনেক ক্ষেত্রে সংগতিপূর্ণ নয় এবং রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ। সর্বোপরি এই ঘোষণাপত্রটি একপেশে বক্তব্যে আকীর্ণ এবং নির্বিঘ্ন শান্তির সংকেত দেয় না।
ইতিহাসের বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য অপ্রযোজ্য এই ঘোষণাপত্রটি পার্বত্য ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর ক্ষুদ্র একটি অংশের আদিবাসী পদের প্রতি আকর্ষণের মূল কারণ। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বাংলাদেশের কোনো কোনো ভূখণ্ড, অরণ্য, নদী, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ছোট গোত্রজ নৃগোষ্ঠীর মালিকানা প্রতিষ্ঠা। ভূমি প্রসঙ্গে জাতিসংঘের ঘোষণার অনুচ্ছেদ ২৭-এর নির্দেশনা দৃষ্টিগ্রাহ্য- ‘আদিবাসীদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা এর অন্যথায় ভোগ দখলে থাকা বা ব্যবহার্য ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদসহ তাদের ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের ওপর তাদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া বা বৈধতা দানের লক্ষ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এর আইন, ঐতিহ্য, প্রথা ও ভূমিস্বত্ব ব্যবহারের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানপূর্বক রাষ্ট্র আদিবাসীদের সঙ্গে যৌথভাবে একটি অবাধ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ, উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন করবে।’
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রধানত চাকমাদের একটি ক্ষুদ্র স্বার্থগোষ্ঠীর (সব চাকমা নয়) দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি, ভূখণ্ড, অরণ্য, নদী, পাহাড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, প্রশাসন ইত্যাদিও তাদের হাতে থাকতে হবে। অন্য কথায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম তাদের ও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিক বাঙালিরা সেখানে তাদের অনুমোদন ছাড়া জমি ক্রয় বা বসবাস করতে পারবে না। বিগত তিন-চার দশকে যেসব বাঙালি, প্রধানত গরিব-দুঃখী-ভূমিহীন বসতি স্থাপন করেছে, কিংবা বাংলাদেশ সরকার বসতি স্থাপনের সুযোগ দিয়েছে, সেসব বাঙালিকে ওই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নিতে হবে। প্রশ্ন, যে গরিব বাঙালি ৩০-৪০ বছর আগে ৩০ বছর বয়সে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছে, আজ তার বয়স ৬০ বা ৭০ বছর। বাংলাদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশেরই একটি ভূ-অঞ্চল থেকে উচ্ছেদ করার সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অমানবিক দাবিকে জোরদার করতে জাতিসংঘের ঘোষণায় আশ্রয় খুঁজছে এই ক্ষুদ্র স্বার্থগোষ্ঠীটি। এ দাবি একজন নাগরিকের চরম মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত।
পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, ইতিমধ্যেই দু-একজন করে বাঙালি প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট নৃগোষ্ঠীদের জমি ক্রয়-বিক্রয় ও বাসা-ফ্ল্যাটে বসতি, রাষ্ট্রের প্রশাসনে চাকরি ইত্যাদির আগ্রহ ও অধিকার নিয়ে। বাঙালির এই উষ্মার দু-একটি ফুলকি ভবিষ্যতে যদি দাবানলের মতো কোটি কোটিতে ছড়ায় তার দাহ কি ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকরা সহ্য করতে পারবে? তখন কি জাতিসংঘ থেকে ‘শান্তি মিশন’ পাঠানো হবে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাইরের স্বার্থবাদীদের সে ধরনের কথাবার্তাও নজরে এসেছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, শান্তি মিশন ও সার্বভৌমত্ব যেহেতু দ্বান্দ্বিক যখন, তখন এর প্রস্তাব উত্থাপন প্রশ্নাতীত হতে পারে না। পার্বত্যের দাবিদাওয়া তাই প্রশ্নসাপেক্ষ।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য দরদি বহির্বিশ্বের সাহায্য-সহযোগিতার ৯৮ শতাংশ ব্যয় হয় ছোট নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং ২ শতাংশ বড় নৃগোষ্ঠীভুক্ত বাঙালিদের জন্য। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ছোট ছোট নৃগোষ্ঠী ও বাঙালি নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় সমান-সমান। সুতরাং প্রথম প্রশ্ন, নৃগোষ্ঠী বিভাজন করে এভাবে ‘দুঃখী’ খুঁজে বের করার রহস্য কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গারো, কোচ, সাঁওতাল, মণিপুরি, হাজং ইত্যাদি আরো যে ৩৫-৪০টি ছোট নৃগোষ্ঠী রয়েছে, বহির্বিশ্বের দুঃখমোচন তৎপরতা কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন? তাহলে ছোট নৃগোষ্ঠী নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডটিই কি মূল উদ্দেশ্য? এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে, বর্হিবিশ্ব ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগ যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং প্রধানত চাকমা সুবিধাভোগীদের (সাধারণ গরিব-দুঃখী চাকমা নয়) ভাগে। এমনকি পার্বত্যের তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মারমা ও অন্যরা এত সুযোগ পাচ্ছে না। এ ধরনের সুবিধাভোগিতা বিষয়ে ভবিষ্যতে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে কি? অতি বিস্ময়কর ও সন্দেহ উদ্রেককর তথ্য এই যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোট নৃগোষ্ঠীর নেতৃত্বের সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের আলোচনার মধ্যে বিদেশিরা বাঙালি সরকারি অফিসারকে থাকতে দেয় না। বাংলাদেশ সরকার এই ঔদ্ধত্যের কোনো জবাব চেয়েছিল কি? প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বহির্বিশ্বের কাদের দৃষ্টি ও স্বার্থ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এবং কেন? বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডটি বহির্বিশ্বের কাদের সামরিক পরিকল্পনার জন্য উপযোগী? আরো প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত সাধারণ সরল, বাংলাদেশের নাগরিকরা আন্তর্জাতিক কূটিল রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না তো?
৪. আদিবাসী তত্ত্ব ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্ন
জাতিসংঘের ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৩০ জানুয়ারি ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি কিংবা ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না উপযুক্ত জনস্বার্থের প্রয়োজনে যুক্তিগ্রাহ্য হবে, অন্যথায় যদি সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ করে।…রাষ্ট্র সামরিক কার্যক্রমের জন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি বা ভূখণ্ড ব্যবহারের আগে যথাযথ পদ্ধতি ও বিশেষ করে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কার্যকর আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।’
এর আগে উলি্লখিত জাতিসংঘ ঘোষণার অসংগতির সূত্রগুলো এখানে দৃশ্যমান। যেমন ‘উপযুক্ত জনস্বার্থের’ সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা কী? ‘যুক্তিগ্রাহ্য’-এর মাপকগুলো কী? ‘স্বেচ্ছায় যদি সম্মতি জ্ঞাপন’ না করে তারা? যদি কোনো নৃগোষ্ঠী বহির্বিশ্বের কারো সঙ্গে কোনো অশুভ আঁতাত করে? যদি বহির্বিশ্বে থেকে ওই অঞ্চল আক্রান্ত হয়, সরকার কি সামরিক কার্যক্রম গ্রহণে নৃগোষ্ঠী কারো সম্মতির অপেক্ষায় নিষ্ক্রিয় থাকবে? যদি নৃগোষ্ঠী নেতৃত্ব সম্মতি না দেয়?
আবার প্রশ্ন, বাংলাদেশে কম-বেশি ৫০টি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ‘মালিকানাধীন’ ভূমি থাকলে এবং সেই ভূমি-ভূখণ্ড ব্যবহারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর এত বিধি-নিষেধ থাকলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কী হবে? প্রশ্ন, ১৯৭১ সালে দেশবাসী স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিল কি তথাকথিত আদিবাসী তত্ত্বে বিভাজিত অর্থহীন ‘ঝাঝড়া-সার্বভৌমত্বের’ জন্য? এর বিষক্রিয়া অনুধাবন করা কি খুবই কঠিন? সর্বোপরি, সার্বভৌমত্ব কখনো বিভাজিত হতে পারে না। যদি হয়, সেটিকে রাষ্ট্র বলা যায় না। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঘোষণায় এ ধরনের আরো নির্দেশনা আছে, যা বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য প্রযোজ্য নয়।
৫. বাংলাদেশের ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকরা ‘আদিবাসী’ নন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নৃগোষ্ঠীগত রাজনীতি প্রবৃষ্টকরণের যে প্রয়াস চলছে, তারই আঙ্গিক নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘আদিবাসী’ পদটি। অথচ এটি সত্যাশ্রিত নয়।
প্রথিতযশা সর্বজনশ্রদ্ধেয় ঐতিহাসিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে তিনি বলেন যে বাংলাদেশের ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকরা ‘আদিবাসী’ বা ‘ভূমিজ’ নয়। তাঁর এই সত্যনির্দেশ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য জাতীয় স্বার্থে এক্ষণে অপরিহার্য।
ইতিহাসের আলোয় মানব প্রজাতির বহুধা জীবনবৈচিত্র্য নৃবৈজ্ঞানিক অন্বিষ্ট হলেও জীবনের পরম মাঙ্গলিক পরিণতি রাজনৈতিক প্রয়াসসিদ্ধ বটে। এই প্রয়াস অবিকৃত ঐতিহাসিক সত্যের শক্তি দ্বারা নিষিক্ত যদি না হয়, যদি বিকৃত-ইতিহাসনির্ভর হয়, মহামতি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ভাষায়, সেসব রাজনীতি ‘অন্তর্বর্তীকালীন নাটিকা’ সময়ে যা শেষ হয়ে যায়। তবে এর ক্ষতির ভার শোষিত-নিঃশেষিত জীবনকেই টানতে হয়।
বাংলাদেশে নৃগোষ্ঠীগত রাজনীতি উসকে দেওয়ার প্রবণতা অনুধাবনে নৃবিজ্ঞানের বেশ কিছু দেশি-বিদেশি গ্রন্থ পাঠ ও পর্যালোচনায় মনে হয়েছে, বেশির ভাগ আলোচনায় পারিভাষিক যে দুটি শব্দ প্রায় জড়িয়ে গেছে, তা আদিম বা আদি মানুষ ও আদিবাসী। প্রথমটি রক্ত-উৎসভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রাচীন পরিচিতি, দ্বিতীয়টি কোনো অঞ্চলে অধিবাসকালিক পরিচিতি। খুব সংক্ষেপে, পৃথিবীর ভূ-প্রকৃতির বহুরূপ ওলটপালট ও মানব প্রজাতির নানা আবর্তন-পরিবর্তন-বিবর্তনের ধারায় মানুষের মধ্যে রক্তমিলন বা মিশ্রণ যেমন ঘটেছে, তেমনি বসবাসের স্থানও পরিবর্তন হয়েছে। তবে নিয়ত রূপান্তরিত সময়ের মধ্যেও যে ছোট ছোট নৃগোষ্ঠী আজতক যতটুকু যা রক্ত-স্বাতন্ত্র্য আদিকালের ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য দ্বারা নিজস্ব গোত্রজ সীমানা (Boundary) বজায় রেখেছে, তাদের গোত্রজ নৃগোষ্ঠী বলা যেতে পারে। কিন্তু তাদের আদিম বা আদিমানুষ বলার কোনো সংগত কারণ নেই। আদিকালের মানুষের মতো আজকের পৃথিবীতে উলঙ্গ বা নরমুণ্ডু শিকারি, বা কাঁচা মাছ-মাংসভুক নরগোষ্ঠী অপসৃয়মাণ। আজ বিশ্বায়নের তোড়ে মানুষে মানুষে সদৃশীকরণের অবিরুদ্ধ প্রবহমানবতায় ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর গোত্রজ সীমানা আপনি সংকুচিত (Boundary reduction) হচ্ছে।
বাংলাদেশের সাঁওতাল, হাজং, গারো, কোচ, মাহালি, চাকমা, তঞ্চঙ্গা ইত্যাদি প্রায় অর্ধশত নৃগোষ্ঠীর জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। তাদের ছেলেদের পরনে লেংটির পরিবর্তে ইউরোপীয় প্যান্ট-শার্ট, মেয়েদের মধ্যে ক্রমবিস্তৃত শাড়ি-সালোয়ার-কামিজ, ঘরের আসবাব, প্রয়োজন অনুযায়ী গোত্রবহির্ভূত ভাষা শিক্ষা, শিশু পরিচর্যার উপকরণ, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, নন্দনকলায় আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব ইত্যাদি গোত্রজ সীমানা সংকোচনের দৃষ্টান্ত। একদিকে আধুনিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-স্বাস্থ্যসেবা, প্রশাসনিক চাকরি-বাকরি ইত্যাদির প্রতি দুর্নিবার আগ্রহ ও দাবি, অপরদিকে গোত্রজ সীমানা রক্ষার পিছুটান- এই দুয়ের টানাপড়েনে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্যাপী সব ছোট নৃগোষ্ঠীর গোত্রজ জীবনে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই দোলাচলের মধ্যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মরণপণ সংগ্রামে ইতিহাস-মথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচণ্ড আবির্ভাব ও নির্ধারক ভূমিকা ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক মানস কাঠামোতে গোত্রজ সীমানা অতিক্রান্ত ভূ-রাজনৈতিক (Geo-political realities) বাস্তবমুখিনতা অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এখানে উল্লেখ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিশাল বাঙালি নৃগোষ্ঠীর যে একটি রাজনৈতিক ‘দর্শন’ তা কেবল বাঙালির স্বার্থগত নয় এ অঞ্চলের অধিবাসী সব নৃগোষ্ঠীর স্বার্থে নিবেদিত। এক কথায়, এটি সংকীর্ণ নয়, মানবমুক্তির অভীপ্সাগত একটি সর্বজনীন রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মকৌশল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করে নেওয়ার কালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তাই ‘বাঙালি-নন বাঙালি’ ভ্রাতৃত্ববন্ধনের নির্দেশনা ছিল এবং যুদ্ধচলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত উর্দুতে প্রচারিত অনুষ্ঠানে এ অঞ্চলের উর্দুভাষী অভিবাসনকারীদের যুদ্ধে যোগদানের জন্য আহ্বান থাকত। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালি জীবন ও মানস উৎসগত হলেও বাঙালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় মৌলবাদিতার অনুরূপ সংকীর্ণ বলে মনে করেন তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ মেনে নেওয়া কঠিন।
বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতিবাদী বাঙালির রাজনৈতিক ডাকে (Political Declaration/Political Clarionet) সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধা জনগণ দ্বিধাহীন যুদ্ধ করেছেন, অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, শহীদ হয়েছেন। অর্থাৎ এর আগে উলি্লখিত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাবোধে ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীগুলো নিজ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়নের অভীপ্সাসহ জন্মভূমি ও মানবতার মুক্তির জন্য বিশাল বাঙালির শক্তি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। এখানেই পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশের (সব চাকমা নয়) সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়, যা পরে আলোচনা করা হয়েছে। জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকে চাকমা ও বাঙালি শিক্ষার্থীরা এক সঙ্গে দেশের মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলেছিলেন।
ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে গড়ে ওঠা এই সম্প্রীতিঘন নাগরিকতার মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করে আদিবাসিত্ব প্রচারসূত্রে এ ‘টার্ম’-এর ব্যাখ্যা আবশ্যক।
আদিবাসী পদটি একটি স্থানিক ও কালিক যোগসূত্রগত ভাষ্য। যে জনগোষ্ঠী আদিকাল থেকে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করে আসছে, তারা সেই অঞ্চলের আদিবাসী (Indigenous people)। স্পষ্টত আদিম বা আদিমানুষ ও আদিবাসী সমার্থক নয়। কোনো অঞ্চলের বিশেষ নৃগোষ্ঠীভুক্ত আদিমানুষ ওই অঞ্চলের ‘আদিবাসী’ না-ও হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার আদি মানুষ বা গোত্রজ ব্যক্তি আমেরিকায় বসবাস শুরু করতে পারেন; কিন্তু তিনি আমেরিকার আদিবাসী নন। তা ছাড়া একটি দেশে একের অধিক নৃগোষ্ঠীর কার কতকালের অধিবাস, সেই ঐতিহাসিক তথ্য-রেকর্ডসূত্রেও প্রাচীনতম অধিবাসীই ‘আদিবাসী’। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে চাকমাসহ অন্য ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকদের আগমন ও অধিবাস কয়েক শ বছরের মাত্র। এই ঐতিহাসিক সত্য নির্দেশ করছে ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর ‘আদিবাসী’ পদ লাভের জন্য অসত্যে আসক্তি ও তাদের নেতৃত্বের অসততা বা অসচেতনতা।
৬. বাংলা ও বাঙালি
ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর আগমনের হাজার হাজার বছর আগেও বাংলা ভূখণ্ডে বাঙালির আদিজীবন-বসতি প্রসঙ্গে জানা যায় তাদের অস্ত্রপাতি, কৃষি উপকরণ, ব্যবহার্য পাত্র, অলঙ্কার ইত্যাদি আবিষ্কারের মাধ্যমে। ইতিহাসের তথ্যসূত্রে ‘বাংলাদেশে প্রত্নপ্রস্তর যুগের যে কয়েকটি শিলা নির্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার সবগুলিই দেশের ভিন্ন ভিন্ন সীমান্তে পাওয়া গিয়াছে। বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ। ভারতবর্ষের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইহা বয়সে নবীন। কিন্তু এই নবীন দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অতি প্রাচীন ভূমি আছে। এই সকল প্রদেশেই বাঙালাদেশের প্রত্নপ্রস্তর যুগের পাষাণ নির্মিত আয়ুধ আবিষ্কৃত হইয়াছে। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে চট্টগ্রামের পার্বত্য প্রদেশের যে সমস্ত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা আকারে প্রত্নপ্রস্তর যুগের ন্যায় হইলেও ভূতত্ত্ববিদ পণ্ডিতগণের মতানুসারে অপেক্ষাকৃত আধুনিক।… বাঙ্গালাদেশের যে প্রদেশে প্রত্নপ্রস্তর যুগের অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, সেই প্রদেশেই নব্যপ্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়াছে।…উত্তর-প্রস্তর যুগের দান বাঙালির সভ্যতা-সংস্কৃতিতে অপরিমেয়।…তাম্রস্মর যুগের বাঙালি শ্বেতবর্ণে চিত্রিত কৃষ্ণ লোহিত বর্ণের মৃৎপাত্রসমূহ, ক্ষুদ্রাস্মর আয়ুধ, কৃষ্ণবর্ণে চিত্রিত রক্তবর্ণের পাত্র এবং বাদামী রংয়ের পাত্র ব্যবহার করিত। একটি পালিশযুক্ত পাষাণ কুঠারও পাওয়া গিয়াছে।…’ (রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, ১ম খণ্ড)
বাংলা ভূ-অঞ্চলের সঙ্গে বাঙালি নৃগোষ্ঠীর-অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নির্দেশ করে বলা প্রয়োজন যে মিশ্র রক্তজাত বাঙালির উৎপত্তি এই বাংলা ভূখণ্ডেই এবং তা হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার ইতিহাস (প্রথম খণ্ড) থেকে ছোট্ট আর একটি উদ্ধৃতি, ‘ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ শব্দের সর্বপ্রাচীন উল্লেখ পাওয়া গিয়াছে।… যে সময়ে ঐতরের ব্রাহ্মণে বা আরণ্যকে আমরা বঙ্গ অথবা পুণ্ড্রজাতির উল্লেখ দেখিতে পাই সে সময়ে অঙ্গে, বঙ্গে অথবা মগধে আর্য্য জাতির বাস ছিল না।’ পবিত্র ঋদ্বেদে একইভাবে এই অঞ্চলে বঙ্গ নামে জাতির উল্লেখ আছে এবং এইসব কম-বেশি তিন হাজার বছর আগের কথা।’ মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত ‘Bengal, Bengalies, Their manners, customs and Literature’ নামক অপ্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যায়- ‘বাংলার ইতিহাস এখনও এত পরিষ্কার হয় নাই যে কেহ নিশ্চয় বলিতে পারেন বাংলা Egypt হইতে প্রাচীন অথবা নূতন। বাঙ্গালা Ninevah ও Babylon হইতেও প্রাচীন অথবা নূতন। বাঙ্গালা চীন হইতেও প্রাচীন অথবা নতুন।…যখন আর্য্যগণ মধ্য এশিয়া হইতে পাঞ্জাবে আসিয়া উপনীত হন, তখনও বাংলা সভ্য ছিল। আর্য্যগণ আপনাদের বসতি বিস্তার করিয়া যখন এলাহাবাদ পর্যন্ত উপস্থিত হন, বাংলার সভ্যতায় ঈর্ষাপরবশ হইয়া তাহারা বাঙালিকে ধর্মজ্ঞানশূন্য পক্ষী বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন।’
সত্য এই যে বাংলা ভূ-অঞ্চলের নদী-নালা, অরণ্য-পাহাড়, সাগর-আকাশ, তৃণভূমি-শস্যক্ষেতের মিলনভূমিতে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-তুফান-বন্যা-খরার বর্ষা-বসন্তে নানা রক্তধারার মোহনায় যে জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও উদ্ভাস, তার নাম বাঙালি, বাংলা তার জন্ম-জন্মান্তরের অথবা আজন্মের ঠিকানা। সত্যশুদ্ধ বাঙালির অনিঃশেষ প্রেম এই বাংলাভূমি। ‘আবার আসিব ফিরে… এই বাংলায়’- এ বোধ করি কবিতার চরণমাত্র নয়, এ তার নিয়ত অনির্বাণ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উপার্থন। সুতরাং বাঙালির আদিবাস-অধিবাস আর ব্যাখ্যা করার আবশ্যকতা নেই।

তবে পর্যবেক্ষণের অবকাশ আছে যে মিশ্র রক্তের ঐতিহ্যে খোলা একটি মুক্ত হাওয়ার ‘দখিন দুয়ারে’ দাঁড়িয়ে বাঙালি কালো-সাদা-বাদামি (নিগ্রো-ককেশাস-মঙ্গোল-সিমেটিক, আবার আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রাবিড়, কোল, মুণ্ডা, অস্ট্রিক ইত্যাদি রক্তউৎসজাত বিধায়) সব মানুষের প্রতিই মুক্ত হৃদয়। প্রতি ব্যক্তি বাঙালির নিজ ঘরেই তো সাদা-কালো-বাদামি অথবা নাক চ্যাপ্টা-নাক খাড়া অথবা কোঁকড়া চুল-সোজা চুল মানুষের সমাহার। বাংলাদেশের ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর জন্য বাঙালির মনখোলা মনোভঙ্গি প্রযোজ্য। সম্প্রতি জমিজমা নিয়ে সাঁওতাল ও বাঙালির যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খবর পত্রিকায় এসেছে, তা কতটা বস্তুস্বার্থগত ও কতটা নৃগোষ্ঠীগত নির্ণয়ের অপেক্ষা আছে। কেননা রোগ চিহ্নিত না করে ভুল চিকিৎসাপত্র প্রয়োগে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হিতে বিপরীত ঘটা অবধারিত। পরিষ্কার বক্তব্য এই যে জমি ‘দখল’ ইত্যাদি নিয়ে বাঙালির সঙ্গে বাঙালির মারামারি, লাঠালাঠিও নৈমিত্তিক ঘটনা এবং নিংসন্দেহে ‘দখল’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুতরাং প্রশ্ন, সাঁওতালদের সঙ্গে জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব কতটা নৃগোষ্ঠীগত উন্নাসিকতা এবং কতটা সুযোগসন্ধানীর বস্তুগত স্বার্থ হাসিলের ‘উসিলা’? বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারির মামলাগুলোর (খুনোখুনিসহ) বেশির ভাগই জমিজমাকেন্দ্রিক।
নৃগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে বাঙালি জনগণ নৃগোষ্ঠীগত বিদ্বেষ ধারণ করে না। পাশাপাশি ইতিহাসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে বাঙালি তার ভাষা ও ভূখণ্ডটির প্রতি প্রচণ্ড স্পর্শকাতর এবং আপসহীন, লড়াকু। গেল শতকেই ১৯০৫-১৯১১ থেকে ১৯৭০-৭১ পর্যন্ত মাত্র ৬০-৬৫ বছরের মধ্যেই দুইবার এই বাংলা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক বাঙালির প্রলয়ঙ্করী রাজনৈতিক অভিব্যক্তি অবিস্মরণীয় বৈ নয়। এবং আরো লক্ষণীয় ১৯০৫-১৯১১ ও ১৯৪৮-১৯৭১ এই দুবারের রাজনৈতিক প্রলয়ের মধ্যেই জনজীবনে বিভাজনের উপাদান হিসেবে ধর্ম প্রবেশ করার প্রয়াস পেয়েছে, কিন্তু ঠাঁই পায়নি, রাজনৈতিক দর্শনে প্রাধান্য পেয়েছে মাটি ও মানুষ; সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব নৃগোষ্ঠীর বাংলার মানুষ। ১৯৪৭ সালের ধর্মীয় পরিচিতির প্রাধান্য ১৯৭১-এ এসে এই মাটি ও মানব প্রেমের মধ্যে আরো বড় হয়ে উঠতে পারেনি। তবে এটি নিয়ে খুঁচিয়ে অপরাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে এখন সংযুক্ত হচ্ছে আদিবাসীত্ব।
‘আদিবাসী’ পদটিকে পুঁজি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ড, ভূমি, অরণ্য, নদ-নদী, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বিশেষ কোনো দাবি কয়েক শ বছর আগে আগত কোনো গোষ্ঠীর জন্যই প্রযোজ্য নয়। তবে নিঃসন্দেহে তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশের সব অঞ্চলের সব সম্পদের ওপর সবার মালিকানা ও অধিকার সমান।
আদিবাসীত্বের নানা সংজ্ঞা
বাংলাদেশে নানাভাবে আদিবাসী পদের সংজ্ঞা এসেছে। যেমন (১) আদিবাসী হচ্ছে কোনো অঞ্চলের প্রাচীনতম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বংশধর; (২) অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার শিকার জনগোষ্ঠীই আদিবাসী; (৩) ‘আলাদা সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যের (যারা) অধিকারী’ ইত্যাদি।
প্রতিটি সংজ্ঞার নানারূপ ব্যাখ্যা সম্ভব। যেমন ১ নম্বর সূত্রে ফরিদপুরের প্রাচীনতম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিষয়ে ঐতিহাসিক বা নৃবিজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলের ওপর ঐকমত্যের ভিত্তিতে বলা আবশ্যক যে কোনো প্রাচীন সংখ্যালঘুর বংশধর আদিবাসী। সুতরাং ফরিদপুরের ভূখণ্ড- পদ্মা, মধুমতি তাদের। ২ নম্বর সূত্রে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশকিতার শিকার জনগোষ্ঠী বলতে যদি শোষণ, অপশাসন বোঝায়, তাহলে বাংলাদেশের ছোট-বড় নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে কোটি কোটি জনগণের বৃহদাংশই আদিবাসী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন ভূখণ্ড কে পাবে, সেটা একটা সংঘাতঘন প্রশ্ন বটে। ৩ নম্বর সূত্রে আলাদা সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা যদি আদিবাসী হয়, তাহলে বাংলাদেশে অভিবাসনকারী অবাঙালিরা (চলিত ভাষায় বিহারি) আদিবাসী, সে ক্ষেত্রে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ দেশের ৮১টি (১৯৭২-এর হিসাবে) ক্যাম্পের ভূমি বা ভূখণ্ড তাদের। পাশাপাশি ৫০টি ছোট গোত্রজ নৃগোষ্ঠীর নাগরিকরা যদি আদিবাসী হয়, তাহলে তাদের বসবাসস্থলের ভূমি, ভূখণ্ড, সম্পদ, তাদের মালিকানা বা স্বায়ত্তশাসনে ছেড়ে দেওয়া সমীচীন(?)! পার্বত্যের অনুসরণে তারাও বাঙালি জনগণকে উচ্ছেদের দাবি তুলবে?
বড় দুঃখে জিজ্ঞাসা, অতঃপর ‘মাইক্রোসকোপিক’ দৃষ্টিতে হাজার হাজার বছরের জন্মগত অধিবাসী কোটি কোটি বাঙালির জন্য দুই-এক টুকরো জমিন খুঁজে পাওয়া যাবে তো? তখনই বোধকরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে(?)। কেননা, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের একাংশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে কথিত আদিবাসীদের ভূখণ্ড বা ভূমির ওপর অধিকারদানের বিষয় চলে এসেছে। এ অবস্থায় নির্বিঘ্নে প্রবেশ করছে বহির্বিশ্বের স্বার্থবাদীরা। তাদের কৌশল ও শক্তিকে তুচ্ছ ভাবার কোনো কারণ নেই এবং তারা অনেক দূর এগিয়েছে বলে মনে হয়।
৭. পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্ন এ বড় অদ্ভুত যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তে কাপ্তাই বাঁধ দ্বারা চাকমা নৃগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে মর্মে নিজ চাকমা জনগণের দুঃখ-ক্ষোভকে গ্রাহ্যে না নিয়ে চাকমা অঞ্চলের তৎকালীন সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় (বর্তমান সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের বাবা) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান নেন। আবার উল্লেখ্য, সব চাকমা জনগণ নয়। যুদ্ধ শেষে তিনি নিজ নৃগোষ্ঠীর গরিব-দুঃখীকে ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং মৃত্যু পর্যন্ত অতি উচ্চপদে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনপূর্বক পাকিস্তানের সেবা করেছেন।
চাকমা নেতৃত্বের একটি ক্ষুদ্রাংশে (সবাই নয়) এইরূপ স্ববিরোধিতা আরো আছে। যেমন- সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রে নয়, ধর্মনিরপেক্ষ উদারনৈতিক বাংলাদেশে তাদের নানারূপ সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু হয়। প্রশ্ন, কেন মানবিক মূল্যবোধহীন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি পরিচিতি লুপ্ত হওয়া মাত্র ক্ষুদ্র চাকমা নৃগোষ্ঠীগত পরিচিতির প্রশ্নটি ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ এত বড় হয়ে উঠল, এত উত্তেজিত যে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিল? যুদ্ধবিধ্বস্ত নিজ মাতৃভূমির অগণিত ক্লিষ্ট, আহত-নিহত-পর্যুদস্ত জনগণের প্রতি দায়িত্ব ও দরদ থাকল না কেন? বাকি ৫০টি ছোট নৃগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তো এইরূপ দাবি ও সশস্ত্র তৎপরতা ঘটেনি। অনিবার্য রাজনৈতিক প্রশ্ন, এত অস্ত্র, রাতারাতিই বলা যায়, তারা কোথায় পেল? এই পরিচিতির বিষয়টি কি পাকিস্তানের উসকে দেওয়া? বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অশান্তি সৃষ্টি করে রাখার কোন নীল নকশা? বর্তমানে (২০১৩) বাংলাদেশের যেমন পারিভাষিক শব্দ ‘গণহত্যা’ ব্যবহারপূর্বক ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশ্বনিন্দিত অতিকায় গণহত্যাকে ম্লান করার প্রচেষ্টা চলছে, সেইরূপ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে বিজয়ী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ম্লান ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার প্রচেষ্টায় কি একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয় নিয়ে খেলা শুরু হয়েছে? পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, বাংলাদেশের একটি মহল বাঙালি পরিচিতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বড় কুণ্ঠায় রয়েছে। এটি ইতিহাস বিস্মৃতি, ইতিহাস অস্বীকৃতি, নাকি ইতিহাস বিকৃতি? পাকিস্তানে বসবাসকারী ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তান কি ব্যবহার করেছে? সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান সরকার সুদূর পূর্ব বাংলার এবং অমুসলমান ও ছোট একটি নৃগোষ্ঠীর নেতাকে সারা জীবন অতি উচ্চপদে আসীন রাখে কেন? প্রশ্ন, অতি ধীশক্তিসম্পন্ন দূরদর্শী ও অতীব উচ্চমান রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু কোনো সন্দেহ পোষণ করেছিলেন কি? এই উদারতাবাদী মানুষটি বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে চিরকাল ছিলেন আপসহীন এবং ইতিহাসের এই পর্বে তাঁকে অনড় দেখা যায়। লক্ষণীয়, পাকিস্তানি সৈনিক শাসকরা বলেছিল যে তাদের বাঙালি জনগণকে প্রয়োজন নেই, ‘মিট্টি’ (ভূমি/ভূখণ্ড/মাটি) চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অতি ক্ষুদ্র কায়েমি স্বার্থবাদী অংশ বলছে, পার্বত্যের ভূমি বা ভূখণ্ড তাদের, বাঙালি সেখানে থাকতে পারবে না। প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে পাকিস্তানি দখলদারদের সঙ্গে যে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন তা কি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বাঙালি মুক্ত’ করার জন্য? তারা মরেছেন কি পার্বত্যের ভূখণ্ড ওই ক্ষুদ্রাংশকে দিয়ে দেওয়ার জন্য?
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রের ভূখণ্ড অতিশয় স্পর্শকাতর বিষয় এবং বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস আলোকিত প্রেম বিষয়ে এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক দাবি-দাওয়া প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষাবিদরা যখন দেশের জন্য উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, যখন নানারূপ তথ্য-উপাত্ত হাতে শ্রেণীকক্ষে উত্তেজিত এমএস পর্বের শিক্ষার্থী বলেন যে, ‘…দেশের এক ইঞ্চি মাটি দেব না।’ যখন অন্য একজন শিক্ষার্থী সাংবাদিক বলেন, ‘ঘেন্না (ঘৃণা) করি ওইসব বিদেশি টাকানির্ভর এনজিও করা বুদ্ধিজীবী ও অপরিণামদর্শী রাজনীতিকগণকে, যাঁরা দেশের ও মানুষের স্বার্থ নিয়ে খেলা করেন’ অথবা ‘গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে’ বলে ওঠে দাঁড়ায় কেউ, তখন অনুমান করা যায়, বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার হলে কী ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মনে পড়ে, প্রায় ১০ বছর আগে বর্তমান লেখিকার তত্ত্বাবধানে “Nation Building Problems in Bangladesh” বিষয়ে পিএইচডি গবেষণাকালে সরকারি কলেজের একজন সাবেক প্রবীণ অধ্যক্ষ শান্তি চুক্তির জন্য পার্বত্যের দাবি-দাওয়াগুলোর ‘অস্বাভাবিকতা’ নির্দেশ করে সেসবের কী ব্যাখ্যা করবেন নির্দেশনা চেয়েছিলেন। এই সূত্রে তিনটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ :
* শান্তি চুক্তি ১৯৯৭ ওই সব অস্বাভাবিক দাবি-দাওয়ার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের কতটা সমন্বয় সাধন করতে পেরেছে?
* শান্তি চুক্তির সফলতা ও সীমাবদ্ধতা কী?
* শান্তি চুক্তি মূল্যায়নে (১৯৯৭-২০১৩) কোনো গবেষণা বা সমীক্ষা কি হয়েছে?
উল্লেখ্য, পার্বত্যের ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর সমসংখ্যক বাঙালি নাগরিকদের মধ্যে শান্তি চুক্তি সত্ত্বেও নিচের মৌলিক কয়েকটি বিষয়কেন্দ্রিক ব্যাপক রাগ-ক্ষোভ-অসন্তোষ লক্ষ করা গেছে- (এক) ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর একাংশের পার্বত্যের ভূখণ্ডকেন্দ্রিক তৎপরতা, (দুই) জনজীবন থেকে ত্রাসের মাধ্যমে ওই ক্ষুদ্রাংশ কর্তৃক নির্বিচারে চাঁদা তোলা, (তিন) বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ‘অদ্ভুত’ মনোভাব ও আচরণ, যা চাকমা (প্রধানত) পক্ষে বাঙালির প্রতি বৈষম্যমূলক, (চার) বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ভবিষ্যৎ, (পাঁচ) পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের দেশ কল্যাণমূলক কাজে নানা বিঘ্ন ও সংকুচিত অবস্থা, (ছয়) বাঙালি জীবনের দুঃখ, বঞ্চনা ইত্যাদি।
পার্বত্যের সমাজসেবী ও দেশপ্রেমী সচেতন ‘এলিট’ বাঙালি নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে শান্তি চুক্তিটিকে ব্যবহারপূর্বক সশস্ত্র সন্ত্রাসের পরিবর্তে এবার শান্তিতে সুপরিকল্পিতভাবে এমন সব কর্মকাণ্ড এখানে পরিচালিত, যা বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূল নয়। জানা যায়, এর মধ্যে সশস্ত্র ভিন্নমতাবলম্বী গ্রুপও আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি ভূমি বন্দোবস্তের পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে গত জুন, ২০১৩ বাঙালি নাগরিকদের আন্দোলন-ধর্মঘটে উপরে নির্দেশিত রাগ-ক্ষোভের তীব্র প্রতিফলন ঘটে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক ছোট-বড় সব নৃগোষ্ঠীর সব জনগণ। সুতরাং জনগণকে জানতে হবে পার্বত্যের ভূখণ্ড ও ভূমি নিয়ে কী শুরু হয়েছে? বিদেশিদেরই বা এত আগ্রহ ও একপেশে অন্তর্ভুক্তি (involvement) কেন? সন্দেহ এত দূর গড়িয়েছে যে উত্থিত প্রশ্ন, বাংলাদেশের ভূমির অখণ্ডতার ওপর আঘাত আসছে না তো? পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডের ওপর কোনো ‘কাল থাবা’ প্রসারিত হচ্ছে কি? প্রশ্ন যখন উঠেছে বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে, সত্য-মিথ্যা যাচাই করতেই হবে। এখানে ‘আদিবাসী’ পদ প্রসঙ্গে পুনরায় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের জন্মের পরপরই পার্বত্যে সহিংস-সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হলেও আগু-পিছু ২০০৮-০৯ থেকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য আদিবাসী শব্দের আশ্রয়ে এখন সব ‘অস্বাভাবিক’ দাবি-দাওয়া বৈধতা লাভের প্রয়াসে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এ দেশে ভিত্তিহীন আদিবাসী এই পদ-প্রবঞ্চনায় দ্রুত প্রভাবিত হচ্ছে সারা বাংলাদেশের অন্যান্য ছোট নৃগোষ্ঠীগুলো, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘ethnic conflict’ এর অহিতকর ভবিষ্যৎ নির্দেশ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষণায় ক্রমে স্পষ্ট হয় যে এখানকার সমস্যা মূলে ভূমি ও ভূখণ্ডকেন্দ্রিক। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত কি জনগণের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে? বাংলাদেশের ভূমি, নদী, পাহাড়, পর্বত, অরণ্য, সাগর, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে জনগণের রায় নেওয়া কর্তব্য এবং এর কোনো বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
বহু ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করলেও উপরোক্ত সব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ‘ব্ল্যাংক চেক’ (Blank Cheque) জনগণ কাউকে দেয়নি, দেয় না। এর অন্যথায় দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য।
সব কিছু স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান (২০০৮-২০১৩) ১৪ দলীয় সরকারকে এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির ব্যাপারে যেকোনোরূপ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বন্ধ করতে হবে। দুর্ভাগ্য, গত জুন, ২০১৩-এ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিবিরোধ নিরসন কমিশন আইন ২০১৩-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ যখন স্বাক্ষর দেয়, তখন একজনও কি মন্ত্রি ছিলেন না যিনি দ্বিমত পোষণ করেন?
এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছে পার্বত্যে মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘকাল কর্মরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সংবাদপত্রে তাদের ভিন্নমতের প্রতিবেদন এসেছে। সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সচেতনতাদৃষ্টে বলার কথা এই যে আজ প্রায় চার দশক ধরে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রতিরোধ এবং সব অপপ্রয়াস থেকে এই ভূখণ্ডটিকে আগলে রেখেছে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নয়, নিজেদের বুদ্ধি-মেধা-কৌশল-পরিকল্পনা-শ্রম এবং সর্বোপরি দেশের মাটির প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম দিয়ে। বর্তমান গবেষণা হাতে নিয়ে বিষয়টি ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে লেখিকার কাছে। একদিকে দেশে একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জটিলতার পর্ব এবং রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনার অভাব, অন্যদিকে পুস্তক-পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকায় পার্বত্যে সেনাবাহিনীর আচরণ বিষয়ে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে সমালোচনার অব্যাহত ঝড় এরই মধ্যে দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় অবিচল দায়িত্ব পালন করে গেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির তোয়াক্কা না করে এবং জাতীয় স্বার্থরক্ষায় তাদের নিবেদনকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন না করে প্রধানত এই ধারণাই জনগণকে দেওয়া হয়েছে যে সেনাসদস্যরা পার্বত্যে কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নারী নির্যাতন করে বেড়াচ্ছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফেব্রুয়ারি ২০১৩, রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের অফিসের অদূরে যে দরিদ্র বৃদ্ধা বাঙালি নারী ভিক্ষা করছিলেন, জানা গেল তাঁর স্বামীকে শান্তিবাহিনীর লোক গলা কেটে খুন করে রেখে যায়। সেই থেকে তিনি সংসারহীনা, ভিক্ষে করে বেড়ান। এইরূপ অসংখ্য ঘটনা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? বলার অপেক্ষ রাখে না, যেকোনো পক্ষেরই এসব অপরাধ-অপকর্মের জন্য জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠ অবদানকে ক্রমাগত অবমূল্যায়ন করে দেখা সংগত নয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যগুলো নির্দেশ করছে, পার্বত্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কিভাবে শহীদ হয়েছেন কতজন সেনাসদস্য, দুর্গম গহিন জঙ্গলে-পাহাড়ে, খাড়া-ঢালে গভীর রাতের অন্ধকারে, ঝড়-জল, সাপখোপ ইত্যাদির মধ্যে কিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও নিরলস শ্রম দিয়েছেন তাঁরা। জনগণকে তার কতটুকু জানানো হয়েছে? জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের এই প্রহরী প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বিদেশি কিছু মিশন বা কমিশনের বিরূপ ভাব চোখে পড়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, পার্বত্যে সক্রিয় দেশি-বিদেশি স্বার্থবাদীদের অপকার্যক্রমের প্রাত্যহিক প্রধান অন্তরায় সেনাবাহিনী। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানটিকে হেয় করার প্রবণতা তাদের জন্য কৌশলগত। অন্যথায় ‘শান্তি-মিশন’ ইত্যাদি ভাবনা ক্ষেপণের সুযোগ হবে কিভাবে? কিন্তু সেইরূপ কোরাসে বাংলাদেশের কণ্ঠ মেলানোর আগে ভালোমন্দ আরো জেনে ও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষণে দেশের স্বার্থ রক্ষায় জনগণকে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়াতে হবে। এতে (১) গণসমর্থনে বা গণশক্তিযোগে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, (২) জনগণ পার্বত্য সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারবে, (৩) বিদেশি স্বার্থবাদীর সংহত হবে, (৪) সেনাসদস্য কারো অনৈতিক অপরাধপ্রবণতা থাকলে তা নিয়ন্ত্রিত হবে।
পারিভাষিক পদভ্রম (Terminological-inexactitude) ও পরিণাম : একটি দৃষ্টান্ত নিবন্ধের আদিবাসী পদকেন্দ্রিক আলোচ্য সূত্রে বলা প্রয়োজন যে পারিভাষিক পদ ভ্রম ঘটলে কী হতে পারে, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান স্বার্থ-দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে নির্মিত ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব।’ ব্রিটিশ-ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যাকে গ্রাহ্যে নিয়েই ‘দ্বি-ধর্মসম্প্রদায় তত্ত্ব’ নির্মাণপূর্বক সমস্যা সমাধানে অগ্রসর না হয়ে বহুধর্মী অধ্যুষিত একই অঞ্চলের দুটি বিশেষ ধর্মানুসারী জনগণকে ‘জাতি’ বলার খেসারত এই উপমহাদেশকে অনেক দিতে হয়েছে, আজও হচ্ছে। ১৫ জুলাই ২০১৩, ঠিক এই মুহূর্তেই পাকিস্তানপন্থী যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় ভাঙচুর, আগুন জ্বলছে। এক পথচারীর দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মৌলবাদী বোমার আঘাতে। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রক্তে ভেসে গেছে ইতিহাসের একেকটি পর্ব। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষাক্ত ছোবল থেকে একটি ছোট শিশু পর্যন্ত রক্ষা পায় না। বাংলাদেশেই বিগত ৪২ বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছে বিহারিরা। পাকিস্তানে সিন্ধি-মোহাজের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তপাত প্রাত্যহিক ঘটনা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সংঘটিত হত্যা, মৃত্যু-ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ উপমহাদেশকে আজও কলঙ্কিত করে রেখেছে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের নেতৃত্ব এম এ জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁর অনুসারী আন্দোলনকারী সংখ্যালঘিষ্ট মুসলমানদের ভারতের ‘অনুগত নাগরিক’ হয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মওলানা আযাদের কাছে তখন ছুটে গিয়েছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসীরা এবং জিন্নাহ সাহেবকে তাঁরা বিশ্বাসঘাতক বলেছিলেন। কিন্তু সময় তখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার আগে চাকমা জনগণ ও তাদের নেতাদের কী পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন জানা নেই। তবে চাকমা নেতা হিসেবে তাঁর অবস্থান এবং অন্য নেতাদের কর্মকাণ্ড অগণিত গরিব-দুঃখী চাকমাসহ অন্যান্য কোনো নৃগোষ্ঠীর জন্য শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনেনি। সন্ত্রাস-সংঘাত-চাঁদা ইত্যাদির মধ্যে বাংলাদেশের এই নাগরিকরা যে ভালো নেই তা বলাই বাহুল্য।
৯. সব নৃগোষ্ঠীর নাগরিকতার মূল্যবোধ আবশ্যক বাংলাদেশে সব নৃগোষ্ঠীর মঙ্গলার্থে যা প্রয়োজন, নাগরিকতার মূল্যবোধের বিকাশ, নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতি দরদ ও দায়িত্ববোধ এবং পরস্পরের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা। প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় ধারণের অধিকার রয়েছে। নরগোষ্ঠী বা নৃগোষ্ঠী পদটি মানুষের স্বতন্ত্র গোষ্ঠীবদ্ধতা নির্দেশ করে। ব্যাকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই শব্দার্থ নিয়ে কোনো মতপার্থক্যের অবকাশ নেই। কিন্তু এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে আদিবাসী পদটির অর্থ আদিম বা আদি মানুষ নয়, এটি স্থানিক ও কালিক যোগসূত্রগত বিষয়। সুতরাং বাংলাদেশের ইতিহাস অগ্রাহ্য করে ঢালাওভাবে ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী বলার অর্থ একটি অসত্য চর্চাজাতীয় স্বার্থে, যা অহিতকর। লক্ষণীয়, বাংলাদেশে সম্প্রতি জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে অসত্য ও বিভ্রান্তি বিস্তৃততর হচ্ছে। এখানে অন্য কোনো নির্ধারিত দিনে ‘গোত্রজ নৃগোষ্ঠী দিবস’ অথবা ‘ছোট নৃগোষ্ঠী দিবস’ অথবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেবল ‘নৃগোষ্ঠী দিবস’ পালন করা যেতে পারে, যেখানে বিশাল বাঙালিরও অংশগ্রহণ থাকবে এবং তা মানুষে মানুষে সম্প্রীতিকে দৃঢ়তর করতে সহায়ক হবে।
ছোট নৃগোষ্ঠীগুলোর গোত্রজ সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ইংরেজি ও বাংলার পাশাপাশি মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ ইত্যাদির অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিশেষ নৃগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ভূখণ্ড ইত্যাদির দাবি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি/অরণ্য/ পাহাড়/সাগর/নদীনালা/শস্য ক্ষেত/প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদির ওপর বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে সমতলে নৃগোষ্ঠীগুলো আলাদা ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। বাঙালি নৃগোষ্ঠী কী দাবি জানাবে? একটি ছোট্ট দেশের সামান্য ভূমি বা ভূখণ্ড নিয়ে এত সব দাবি ও কমিশনও কতটা বাস্তব ভেবে দেখার অবকাশ আছে। একটি সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট অভিন্ন আইনি শৃঙ্খলার মধ্যে এসবের ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। এ জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ ও বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন। অন্যথায় দ্বন্দ্ব ও জটিলতা অবধারিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রায়ই যে ১৯০০ সালে বিধিবিধানের কথা বলা হয়, তার কতটুকু গ্রহণযোগ্য অথবা গ্রহণযোগ্য নয়, তা গভীর গবেষণার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা আবশ্যক। মনে রাখা প্রয়োজন, বিগত ১০০ বছরের অধিক পৃথিবীর অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতি বদলে গেছে, বদলে গেছে উপমহাদেশের মানচিত্র, বদলে গেছে চাকমাসহ অন্যদের জীবনের চালচিত্র, বদলে গেছে বাংলাদেশের আইনকানুন, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি। সুতরাং ১৯০০ সালের নিয়মনীতিও বদলাতে হবে আজকের বাস্তবতায়।
বাংলাদেশে মিলেমিশে পাশাপাশি বাস করছে ছোট-বড় নৃগোষ্ঠীভুক্ত জনগণ। বাংলাদেশে অপ্রযোজ্য আদিবাসী তত্ত্ব দ্বারা এবং ইতিহাস বিকৃত করে এই শান্তিপূর্ণ মিলিত জীবনস্রোতকে বিভাজিত করার পরিণাম ভয়াবহ। এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, গণমাধ্যম প্রত্যেকের সতর্কতা আবশ্যক। পরম নাগরিক সচেতনতায় ছোট-বড় সব নৃগোষ্ঠীর সবাই নিজ মাতৃভূমির রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান এমনভাবে বিন্যস্ত করে নিতে মিলিত পদক্ষেপ রাখুক যেন ‘একদানা ভাত’ কেউ কারো চেয়ে বেশি না খায়।
এ পথটি দুর্গম ও কর্মটি দুষ্কর। তবু সেটাই সভ্যতা সমর্থিত উন্নতির পথ। বাংলাদেশের ছোট-বড় সব নৃগোষ্ঠীর যৌথ কর্মযজ্ঞের প্রণোদনায় এই রাজনৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষা প্রতিভাসিত হবে, সেটাই প্রত্যাশা এবং সেটাই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ‘বাংলাদেশ’ নামের অসাধারণ রাজনৈতিক সর্বজনীনতা। 

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

কৃতজ্ঞতা: দৈনিক কালের কণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

8 Replies to “বাংলাদেশে তথাকথিত ‘আদিবাসী’ প্রচারণা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ”

  1. Hats Off. পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত এ ধরণের তথ্য সমৃদ্ধ এবং গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনাজাত মৌলিক আর কোন লিখা অন্তত: আমার চোখে পড়ে নি। লেখিকার বিস্তারিত পরিচয় না জানলেও তিনি অত্যন্ত মনযোগ সহকারে বিষয়টির গভীরে গেছেন। যুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ,প্রাকৃতিক নিয়ম,মানবসৃষ্ট আইন, মানবিক আচরণের বিভিন্ন দিক,আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারগুলো বিভিন্ন দৃষ্টি কোণে অবলোকন ও হৃদয়ঙ্গম করেছেন। এটি একটি মাষ্টরপিস রেফারেন্স হিসাবে ভবিষ্যতে ব্যবহৃত হবে। লেখিকাকে সালাম ও ধন্যবাদ। পার্বত্য নিউজ এর মাধ্যমে এ লিখাটি পড়ার সৌভাগ্য হলো। তাদেরকে ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন