ঈশান কোণে মেঘ, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা

খলিলী

মাসুমুর রহমান খলিলী

পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদ বা অস্থিরতা দেখা যায় পাহাড়ি বা দুর্গম এলাকাগুলোতে। লাদাখ আকসাই চীন সিকিম বা অরুণাচল সবটাই দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত। বাংলাদেশের সমতল ভূখণ্ডের সাথে যে এক-দশমাংশ দুর্গম অঞ্চল রয়েছে সেটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। দুই দশককালের বেশি সময় ধরে এই এলাকা ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপারেশনাল অঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তিবাহিনীর সশস্ত্রযুদ্ধের কারণে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয় এই পাহাড়ে। স্বাধীনতার পর তদানীন্তন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের রাঙ্গামাটির এক সমাবেশে সব পাহাড়িকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ তারা মানতে পারেনি। সেখান থেকে যে ক্ষোভের শুরু হয় সেটি প্রতিবেশী দেশে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য মদদ পেয়ে পুরোপুরি বিদ্রোহে রূপ নেয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে সেই বিরোধ একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মীমাংসা করার ক্ষেত্রে সহযোগিতাও করে প্রতিবেশী ভারত। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের এই বীজকে কোনো সময় উপড়ে ফেলা হয়নি। সেটি এখন আবার নতুন করে যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আলামত দেখা যাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রধান সন্তু লারমা বেশ ক’বছর ধরে বলে আসছিলেন তাদের সাথে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। জনসংহতির মূল আপত্তিটি ছিল অলিখিত চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকার স্বীকার করে না যে লিখিত চুক্তির বাইরে অলিখিত কোনো চুক্তি সেখানে ছিল। কিন্তু শান্তিবাহিনী যে লিখিত চুক্তির কথা বলছে তা হলো মারাত্মক। এর একটি হলো স্বাধীনতার পর যেসব বাঙালি পার্বত্য এলাকায় বসতি স্থাপন করেছে তাদের ও বংশধরদের সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসা। আর দ্বিতীয়টি হলো পাহাড়িরা যেভাবে সেখানকার ভূমির মালিকানা দাবি করে সেভাবে তাদের হাতে জমির মালিকানা দিয়ে দেয়া। এ দু’টির যেকোনোটি করা হলে সে এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌম কর্তৃত্ব বজায় রাখা একপর্যায়ে আর সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।

এই আশঙ্কা যেন এখন বিপদের ঘনঘটা হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছে। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে নেদারল্যান্ডসের হেগে ইউএনপিও (আন রিপ্রেজেনটিটিভ নেশনস অ্যান্ড পিপলস অরগানাইজেশন) নামে একটি সংগঠন করা হয়েছে ১৯৯১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। যেসব অঞ্চলে স্বাধিকারের আন্দোলন চলছে অথবা যেসব রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি নেই সেসবের প্রতিনিধিত্বের জন্য এই সংগঠন করা হয়। এ সংগঠনের ৪৬টি সদস্যের একটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি। কাশ্মির আসাম মনিপুর নাগাল্যান্ড এর সদস্য না হলেও বেলুচিস্তান সিন্ধু, পার্বত্য চট্টগ্রাম বা আচেহসহ অনেক অঞ্চলকে এর সক্রিয় সদস্য করা হয়েছে। এর সদস্য হিসেবে পূর্ব তিমুর কসোভো বা দক্ষিণ সুদানকে ইতোমধ্যে স্বাধীন করে ফেলা হয়েছে।

সেই ইউএনপিওর ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর। ২ মার্চের এই খবরটি এ রকম- ‘একটি মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ২১০টি পরিবার ২০১৪ সালে রাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট সংগঠনের হুমকি ও ভূমিগ্রাসের শিকার হয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর বাইরে নারী ও মেয়েদের ওপর যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে একই সময়ে ১২২টি। ২০১৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে যদি পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তা বাস্তবায়ন না করা হয় তাহলে এই অঞ্চলে ভয়ঙ্কর অস্থিরতা দেখা দেবে এবং সহিংসতার বিস্তার ঘটবে।’

এর সাথে ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদনও যুক্ত করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। অবশ্য এর কোনো প্রমাণের কথা বলা হয়নি অথবা পত্রিকা নিজস্বভাবে উল্লিখিত ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করে দেখেছে কি না তার কথা বলেনি। এতে সন্তু লারমার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, যেখানে তিনি ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শান্তিচুক্তি পুরো বাস্তবায়ন করা না হলে সরকারকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। সন্তু বলেছেন, ১ মে থেকে তিনি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবেন। তার মতে, শান্তিচুক্তির ৭২টি অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ২৫টি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ৩৪টি একবারে অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। ১৩টি আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

সন্তু লারমা তার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার জন্য বিভিন্ন এলাকা সফর শুরু করেছেন। তা নিয়ে ইতোমধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও হানাহানি শুরু হয়েছে। বান্দরবানে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ হয়েছে সন্তুর সফরকে কেন্দ্র করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ও তার জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি যে উত্তেজনা নতুন করে দেখা দেয় তা নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে অব্যাহত রয়েছে। লর্ড এরিক অ্যাভাবুরি, সুলতানা কামাল ও এলসা এসটামাটোপাউলোর নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পুনর্বাসিত বাঙালি উচ্ছেদ এবং পাহাড়িদের দাবি অনুসারে ভূমিমালিকানা নিষ্পত্তির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। শান্তিচুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের দাবিও তারা বারবার জানিয়েছে।

সন্তু লারমার নতুন হুমকির পর লিখিত ও এই দুই অলিখিত দাবি বাস্তবায়নে নতুন করে শান্তিবাহিনীর অভিযান পার্বত্য জেলাগুলোতে শুরু হলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে সেটি অনুমান করা কঠিন। পার্বত্য জেলাগুলোতে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে থাকাকালে ব্রিগেড কমান্ডার পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন মেজর জেনারেল (অব:) মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। পার্বত্য জেলার পার্শ্ববর্তী এক থানায় জন্ম নেয়া এই প্রতিভাধর সাবেক জেনারেলের লেখা এক কলামে মনে হয়েছে তিনি পাহাড়ে অনাহূত কোনো কিছুর গন্ধ পাচ্ছেন। জেনারেল ইবরাহিম সেখানে সেনা কর্মকর্তা-জওয়ানসহ পাহাড়ি বাঙালির বিপুল রক্তক্ষয়ের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আজকের ২০১৫ সালে আমার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি কৃত্রিম শান্তি বিরাজ করছে। এই কৃত্রিম শান্তিও যদি লঙ্ঘিত হয়ে যায়, তখন শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নতুন প্রেক্ষাপটে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।’

পার্বত্য শান্তিচুক্তির শর্ত অনুসারে তিন জেলা থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকার অপারেশনাল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেনাকর্মকর্তাদের কমসংখ্যকই এখন বাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন। নতুন প্রজন্মের সৈনিক ও কর্মকর্তাদের জাতিসঙ্ঘ মিশনের ছাড়া অপারেশনাল অভিজ্ঞতা সেভাবে নেই। সৈনিকদের তিন বেলা মাছ-গোশত দিয়ে ভারী খাবার সরবরাহ করায় তাদের বেশখানিকটা আরাম-আয়েসের প্রতি অভ্যস্ত করা হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। এখন তেমন পরিস্থিতি দেখা দিলে দুর্গম এলাকার যুদ্ধ বা অপারেশন কতটা দক্ষতার সাথে তারা করতে পারবেন তা নিয়ে অনেকের উদ্বেগ রয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনীতে দৈনন্দিন সক্ষমতা বজায় রাখতে গোলাবারুদের জোগান ঠিক রাখার চেয়েও অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। এতে দৈনন্দিন সক্ষমতা বজায় রাখার বাজেটের একটি অংশ সে দিকে প্রবাহের প্রভাব থাকতে পারে। এর পাশাপাশি অস্ত্র গোলাবারুদের উৎস দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা না করার কোনো প্রভাব এ ক্ষেত্রে দেখা দেয় কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিপক্ষের তথ্য সংগ্রহের যে অপরেশনাল নেটওয়ার্ক আগে ছিল, সেটিও গত কয়েক বছরে অনেকখানি দুর্বল হয়েছে প্রতিরক্ষা দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসার কারণে। সন্তু লারমার যে হুমকির খবর ইউএনপিওর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সেটি বাস্তবায়ন হলে সত্যিকার এক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক নিরাপত্তাবাহিনী।

সাধারণত যেকোনো বহিঃশক্তির আক্রমণ অথবা অভ্যন্তরীণ সংহতির বিরুদ্ধে যেকোনো অন্তর্ঘাতী বিদ্রোহ মোকাবেলায় জনগণের মধ্যে বিশেষভাবে ঐক্যের প্রয়োজন হয়। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই ঐক্য ভেঙে চুরমার করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে হুমকিদাতাদের উৎসাহিত করেছে কি না কে-ই বা বলতে পারে। দেশের পরিস্থিতি অবলোকন করে অনেকে অনাগত বিপদের ঘনঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সেই বিপদ যেন এখন একেবারে দোরগোড়ায় চলে এসেছে। পরম করুণাময় যেন সেই বিপদ থেকে এই হতভাগা জাতিকে রক্ষা করেন।

♦ মাসুমুর রহমান খলিলী: উপ সম্পাদক, দৈনিক নয়াদিগন্ত।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন