parbattanews

পর্যটকদের ভিড় টেকনাফে


মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান:

উঁচু-নিচু ছোট-বড় পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। দুপাশে সবুজের সমারোহ। রাস্তার পূর্ব পাশে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে বিভক্তকারী নাফ নদী। নদীতে সারি-সারি নৌকায় পাল তুলে জেলেরা মাছ ধরছে। হিমেল বাতাসে উড়ছে নৌকার পাল। প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে দেশের সর্বদক্ষিণ সীমান্ত শহর টেকনাফে। এ টেকনাফের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনসহ ছেড়াদ্বীপ দেখতে পর্যটকের ঢল নেমেছে। পাহাড়, নদী আর সমুদ্রের অনন্য এক মিলনস্থল এই টেকনাফ। কক্সবাজার থেকে সড়কপথে দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার। পাহাড়ের উপর থেকে নাফ নদীর অপরূপ সৌন্দর্য বিরল দৃশ্য। টেকনাফের সমুদ্র সৈকতটিও খুবই সুন্দর। বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সৈকত বলা যায় এটিকে। এছাড়া এখানকার ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ, শাহপরীর দ্বীপ, কুদুম গুহা, নেচার পার্ক উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।

সেন্টমার্টিন:

টেকনাফ সদর থেকে ৩২ কি.মি. দক্ষিণে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন অবস্থিত। চারদিকে পাথর ও সারিসারি নারিকেল গাছ এবং কেয়াবন পুরো দ্বীপটিকে নৈসর্গিক সৌন্দর্য দান করেছে। দ্বীপের চারপাশে স্বচ্ছ নীল জলরাশির তলদেশে জীবন্ত কোরাল প্রবাল দ্বীপটিকে আলাদা বৈশিষ্ট্য ম-িত করেছে। টেকনাফ থেকে জাহাজে করে ২ ঘণ্টায় সেন্টমার্টিন যাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে দ্বীপটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত। দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার। এর তিনদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর, জোয়ার এলে তলিয়ে যায় পাথরগুলো। আবার ভাটার সময় জেগে ওঠে। প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এখানে। পাশাপাশি স্থানীয় ভাষায় পেজালা (অ্যালগি) নামে পরিচিত একধরনের সামুদ্রিক শৈবালও সেন্টমার্টিনে দেখা যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে। তবে লাল পেজালা শৈবালটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। সেন্টমাটিন দ্বীপের পূর্ব-দক্ষিণে রয়েছে ছেড়াদ্বীপ নামে আরেকটি সৌন্দর্যঘেরা পর্যটনস্পট। দ্বীপটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ কেওড়া বাগান, শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন ইত্যাদি।

সমুদ্র সৈকত ও জেলেদের মাছ শিকার:

টেকনাফ শহর ছাড়িয়ে দক্ষিণে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এ সমুদ্র সৈকত। খুবই পরিচ্ছন্ন এ সৈকতে পর্যটকের আনাগোনা সবসময়ই কম থাকে। তবে জেলেদের আনাগোনা এ সৈকতে বেশি। বিশেষ করে খুব সকাল কিংবা সন্ধ্যায় জেলেদের মাছ ধরতে দেখা যায়। দীর্ঘ এ সৈকতে বেড়াতে ভালো লাগবে সবার।
গেম রিজার্ভ: টেকনাফ গেম রিজার্ভ বাংলাদেশের একমাত্র গেম রিজার্ভ বন। এটি ১১ হাজার ৬১৫ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। দেশের হাতেগোনা যে কটি স্থানে বন্যহাতির দেখা মেলে তার মধ্যে এটি অন্যতম। বন্য হাতির অভয়ারণ্য হিসেবে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গেম রিজার্ভ। এখানে উঁচু পাহাড় আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যে রয়েছে বিশাল গর্জন বন। তৈঙ্গাচূড়া: গেম রিজার্ভের অন্যতম আকর্ষণ হল তৈঙ্গাচূড়া। এ চূড়া অত্যন্ত খাড়া প্রকৃতির। এটি এক হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। এখান থেকে বঙ্গোপসাগর, নাফ নদী, মিয়ানমার সীমানার পাহাড় শ্রেণি এবং গেম রিজার্ভের চিত্র উপভোগ করা যাবে।

কুদুমগুহা:

গেম রিজার্ভের অভ্যন্তরে রইক্ষ্যং এলাকায় কুদুমগুহার অবস্থান। এটি বাংলাদেশের একমাত্র বালু-মাটির গুহা। কুদুমগুহায় বাদুড় বাস করে। তাই এটিকে বাদুড় গুহা বলেও অভিহিত করা হয়। কুদুমগুহায় দুই প্রজাতির বাদুড় ছাড়াও ৪ প্রজাতির শামুক, তিন প্রজাতির মাকড়সাসহ বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র প্রাণিদের বসবাস রয়েছে। দুর্গম পাহাড় অতিক্রম করে এই গুহায় যেতে হয়। রোমাঞ্চকর এ ভ্রমণে পথ পাড়ি দিলে অবশ্যই বনপ্রহরী সঙ্গে নিতে হবে।

চাকমা গ্রাম:

কুদুমগুহার পাশেই একটি গ্রামে চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস। উপজাতিদের জীবনবৈচিত্র্য নিজ চোখে দেখতে যেতে পারেন গ্রামটিতে। তবে এ জন্য অবশ্যই আপনাকে কোনও গাইড কিংবা কোনও চাকমা সম্প্রদায়ের কারো সহায়তা নিতে হবে।

নেচার পার্ক:

নেচার পার্কের অবস্থান টেকনাফ শহর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার উত্তরে। এই পার্কটিতে কয়েক হাজার শতবর্ষী গর্জনগাছ রয়েছে। বিশাল এই বনের ভেতর হাঁটার জন্য রয়েছে তিনটি রাস্তা। এসব রাস্তায় পর্যটকদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মোড়ে-মোড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিশ্রামাগার। এখানে টাওয়ারে বসে হাতি, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন পশুপাখির ডাক শুনতে পারবেন। পাহাড়ের চূড়ায় তৈরি করা চৌকিতে বসে পুরো বনের চিত্র, নাফ নদী ও মিয়ানমারের আরাকান সীমান্তের দৃশ্য মনভরে উপভোগ করা যাবে।

মাথিনের কূপ:

টেকনাফ উপজেলায় ভ্রমণ করতে গেলে পর্যটকগণ মাথিনের কূপ দর্শন করতে কখনই ভুল করেন না। মাথিনের কূপ টেকনাফ থানার সম্মুখে অবস্থিত। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে কলকাতার ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা টেকনাফ থানায় বদলী হয়ে আসেন। এ সময় সেখানকার উপজাতি সম্প্রদায়ের এক রাজার কন্যা থানায় অবস্থিত পাত কুয়া থেকে পানি আনতে যেত। থানার নবাগত সুদর্শন তরুণ কর্মকর্তা ধীরাজ থানায় বসে বসে মাথিনের পানি আনা-নেয়া দেখতেন। এভাবে ধীরাজের সঙ্গে মাথিনের দৃষ্টি বিনিময় এবং পরে তা প্রেমে পরিণত হয়। চৌদ্দ বছর বয়সী মাথিন ও ধীরাজের নিখাদ প্রেমের ঐতিহাসিক নিদর্শন এ মাথিনের কূপ। গোত্র আভিজাত্যের প্রতিবন্ধকতায় ধীরাজ-মাথিনের বিয়ে হয়নি। সমধুর প্রেমের করুণ বিচ্ছেদে মাথিন তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করেন। এতে শাশ্বত অকৃত্রিম প্রেমের এক ইতিহাস বিরচিত হয়। মাথিনের অতৃপ্ত প্রেমের অমোঘ সাক্ষী এই মাথিনের কূপ দর্শনে এলে আরো অনেক অজানা কাহিনী জানা যায়।

শাহপরীর দ্বীপ:

টেকনাফ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপ। এটি মূলত সাবরাং ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম। একসময় এটি দ্বীপ থাকলেও কিছুকাল আগে এটি মূল ভূ-খ-ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। টেকনাফ উপজেলা শহর থেকে শাহপরীর দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। জনশ্রুতি আছে শাহসুজার স্ত্রী পরীবানুর ‘পরী’ ও শাহসুজার ‘শাহ’ মিলে এ দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে। আবার অন্য একটি মতে, শাহ ফরিদ আউলিয়ার নামেই এ দ্বীপের নামকরণ। শাহপরীর দ্বীপের নামকরণের এরকম আরো অনেক ইতিহাস প্রচলিত আছে স্থানীয়দের কাছে। টেকনাফ শহর থেকে সিএনজি চরে যেতে হয় জায়গাটিতে।

কীভাবে যাবেন:

ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফ যায় সেন্টমার্টিন সার্ভিসের হিনো এসি বাস। এছাড়াও ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন পরিবহন, শ্যামলি, এস আলম, সৌদিয়া, হানিফ, তুবা লাইন ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাস যায়। ঢাকা থেকে যেকোনো বাসে কক্সবাজার এসে সেখান থেকেও সহজেই আসা যায় টেকনাফ। টেকনাফে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো পর্যটন করপোরেশনের মোটেল নে টং (ফোন: ০৩৪২৬-৭৫১০৪)। এছাড়াও টেকনাফ শহরের আলো রিসোর্ট ও দ্বীপ প্লাজা, হিলটপ নামে কয়েকটি ভালো মানের হোটেল আছে।

 

সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, বর্ষ ১, সংখ্যা ২ ও ৩।

Exit mobile version