দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় চেতনা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে অপপ্রচার বন্ধে কোনো ছাড় নয়

মাহের ইসলাম:

বাংলাদেশের তরুণদের মতে, তথ্যপ্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে কার্যকর স্থান হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এক্ষেত্রে, ফেসবুক এদেশের তরুণদের প্রায় সকলেরই প্রথম পছন্দ। সরকারী হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৩৩ লাখ ফেসবুক ইউজার আছে। (প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০১৭)। এর মধ্যে কতজন তরুণ আমি জানি না, তবে  এর অর্ধেকও যদি তরুণ হয়, তাহলেও প্রায় এক কোটির বেশি বাংলাদেশি ফেসবুককে তথ্যপ্রাপ্তির সবচেয়ে কার্যকর উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন।

অর্থাৎ, দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী তথ্যপ্রাপ্তির জন্য ফেসবুকের তথ্যের উপর নির্ভর করছেন।  প্রশ্ন উঠতেই পারে, ফেসবুকের উপর এই নির্ভরশীলতা সবক্ষেত্রেই কী ভাল ? লুকোনোর কিছু নেই, খোলাখুলিভাবেই বলছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনাকে মাথায় রেখেই, এই প্রশ্নের অবতারণা।

নানা ধরনের বেশ কিছু ঘটনা থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র দুইটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যাক। আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখা এবং অন্য ঘটনাগুলো তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি বলেই, এখানে ইচ্ছে করে অন্য সকল ঘটনা টেনে আনা হলো না।

২ জুন ২০১৭, সকালে রাঙ্গামাটির  লংগদুতে  পাহাড়িদের প্রায় শতাধিক বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনুমান করা হচ্ছে, পাহড়ি দুই যুবকের হাতে নিহত বাঙ্গালী মটর সাইকেল চালক নয়নের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ মিছিল হতে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল তরুণ পূর্বপরিকল্পিত এই অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী। ফলে, কয়েক শত নিরীহ পাহাড়ি পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে রাতারাতি সহায় সম্বলহীন হয়ে মানবেতর দিনযাপনে বাধ্য হয়েছে। পরবর্তীতে, স্থানীয় রাজনীতির জটিলতায়, নারী ও শিশু সহ এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অনেকেই সরকারী ত্রাণ এমনকি চিকিৎসা সহায়তা পর্যন্ত নিতে বাধার সম্মুখীন হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ফেসবুকের কল্যাণে ঘটনাটি অতি দ্রুত লংগদুর বাইরে ছড়িয়ে দেয়া হয়, দেশে এবং বিদেশে; তবে একটু ভিন্ন ভাবে।  জ্ঞাতসারেই  হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক, এই ভয়াবহ সংবাদটি কয়েকটি দেশি এবং বিদেশী পত্রিকাতেও খানিকটা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

যে তিনটি ছবিকে লংগদুর অগিকান্ডের ছবি বলে চালানো হলো, দেশবাসি এবং বিশ্ববাসীর সমবেদনা প্রাপ্তি এবং বাঙ্গালীদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেগুলো আসলে এদেশেই ঘটে যাওয়া টঙ্গীতে বয়লার বিস্ফোরণ (১০/৯/১৬), গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লি (৭/২/১৭) এবং বরিশালে বিস্কুটের গোডাউন (৪/২/১৭) এর আগুনের ছবি। পরের ঘটনাটি আরো ভয়াবহ এবং জঘন্য।

৩০ জুন ২০১৭ , সমাজের এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মধ্যরাতে ফেসবুকে পোস্ট দিলেন যে, শতশত বাঙ্গালী সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা করছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীও এতে অংশ নিচ্ছে। আর, প্রানভয়ে পাহাড়িরা পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আবার প্রতিরোধেরও আহবান জানালেন, এই বলে যে, শুধু চোখের পানি ফেললে চলবে না, প্রতিরোধ করতে হবে। তার এই পোস্ট স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নারী-পুরুষ ও ব্লগাররা ফেসবুকে শেয়ার করলেন। ফলে তাদের ফলোয়ারগণ সত্য মিথ্যা যাচাই ছাড়াই লাইক কমেন্ট করে ছড়িয়ে দিলো সর্বত্র।

যার ফলে, কয়েকটি স্থানে রামগড়ের কথিত ঘটনার প্রতিবাদে কয়েক এলাকায় রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত নেমে গেল। ভাগ্য ভালো যে, নিরাপত্তা বাহিনী সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে উত্তেজনা ছড়ানোর সুযোগ ছিলো না; অন্যথায় উত্তেজিত লোকজন কি যে করতো তা আমি কল্পনাও করতে পারি না; তবে আরেকটি লংগদুর কথা ভাবতেও গা শিউরে উঠে।

স্বাভাবিকভাবেই, এই পোস্টটি শেয়ার হতে দেরি হল না। আরেকটি লংগদুর পুনরাবৃত্তির আশংকায় অনেকই আশঙ্কিত হয়ে তাদের মতামত, বাঙ্গালীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এমনকি প্রতিশোধের পন্থা পর্যন্ত উচ্চারণ করে ফেললেন।

উল্লেখ্য, ইতিপূর্বেই বলেছি, প্রথম আলোতে প্রকাশিত জরিপ অনুসারে, “ তরুণেরা মনে করে, বৈচিত্রপূর্ণ সংবাদ ও তথ্যপ্রাপ্তির জন্য জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো সামাজিক যোগাযোগ” এবং  জরিপের ৯৬ % অংশগ্রহণকারী বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই মনে করেন। অর্থাৎ, দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এই সংবাদের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হবেন না, বা সন্দিহান না হওয়ারই কথা। তাই, তারা জানলেন না যে, এটি শুধু একটি নিকৃষ্টতম নিচু মানসিকতাপ্রসুত ঘৃন্য মিথ্যেই নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং দলমত নির্বিশেষে সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিরুদ্ধে এক সুদুরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের প্রয়াসের অংশবিশেষ।

অথচ, প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। প্রকৃত সত্য জানার জন্য আমি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাই। পাহাড়ী, বাঙালী সাধারণ নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে আমি যা পেয়েছিলাম তা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখি। প্রবন্ধটি গত ২ জুলাই পার্বত্যনিউজে ‘ ইমতিয়াজ মাহমুদ- মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান(ভিডিও)’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই অনুসন্ধানে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল তা নিম্নরূপ,

“গত রাতে ( ৩০ জুন ২০১৭) আনুমানিক রাত সাড়ে দশটার দিকে কয়েকজন সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী রামগড়ের কালাডেবাতে (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) এসে কয়েকজন বাঙালীর কাছে চাঁদা দাবী করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে, কালাডেবার অন্য বাঙালীরা এবং পার্শ্ববর্তী লামকোপাড়ার (প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত) বাঙালীরা একত্রিত হয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে। সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে করতে তারা সোনাইয়াগা ( ত্রিপুরা এবং মারমা অধ্যুষিত ) এর মধ্যে দিয়ে বড় চন্দ্র কারবারিপাড়া ( ত্রিপুরা অধ্যুষিত) পর্যন্ত চলে যায়। কিন্তু কাউকে ধরতে ব্যর্থ হয়।

চাঁদাবাজরা পালানোর সময় কয়েক রাউন্ড গুলি করে, তবে কেউ হতাহত হয়নি। এই ধাওয়ার সময় ঐ এলাকার পাহাড়িরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কয়েকজন বাঙালির অভিযোগ থেকে আর ও জানা যায় যে, কয়েকদিন আগেই তাদের কাছে ইউ পি ডি এফ এর সন্ত্রাসিরা চাঁদা দাবি করে বলেছিল, চাঁদা না দিলে এলাকায় থাকতে দিবে না; এমনকি বাঙালি মেয়েদের তুলে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছিল।

ইত্যবসরে, বাঙালীদের কাছ থেকে সশস্ত্র চাঁদাবাজদের সংবাদ পেয়ে বি জি বি সদস্যরা উপস্থিত হয়। তারা উত্তেজিত সকলকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত রাখে। ফলে, ঘটনা অন্য কোন দিকে মোড় নেয়নি। রাত প্রায় ১২ টার দিকে, পুরো এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করে।

গত (১ জুলাই ২০১৭) প্রায় সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে, সোনাইয়াগা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এলাকার জনগণ এক মিটিং করে, যেখানে পাহাড়ি এবং বাঙালি সবাই ছিলো। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, চাঁদা দিবে না, চাঁদাবাজদের প্রতিরোধ করবে এবং ঐ এলাকায় একটি আর্মি অথবা বি জি বি ক্যাম্প স্থাপনের দাবিও জানিয়েছে।“ আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে, http://goo.gl/UiveVV, লিঙ্কে ঘুরে আসতে পারেন। আমার এই অনুসন্ধানের সমর্থনে স্থানীয় এক উপজাতীয় জনপ্রতিনিধির ভিডিও সাক্ষাৎকারও ওই লেখায় প্রকাশ করা হয়েছে। আগ্রহী পাঠক নীল মার্কিং করা লিংকে প্রবেশ করে সেই ভিডিও সাক্ষাৎকারটি দেখে আসতে পারেন।

এখানে মাত্র দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার নতুন নয়; বরং নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। অথচ, এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। নিরীহ পাহাড়িদেরকে মিথ্যের মাধ্যমে বাংগালি বিদ্বেষী করার চেষ্টা চলছে, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। দুটি ঘটনাতেই ফেসবুক কে ব্যবহার করা হয়েছে, মিথ্যে উপস্থাপনের জন্যে, সমাজে বিভেদ সৃষ্টির জন্যে, মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে তোলার জন্যে। এমনকি, সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ দেশের সার্বভৌমত্ব পর্যন্ত ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে, এ ধরণের পোস্ট দিয়ে। তন্মধ্যে, একটিতে সত্যের সাথে মেশানো হয়েছে মিথ্যা। অন্যটিতে, অত্যাচারিকে ভিকটিম হিসেবে আর ভিকটিমকে অত্যাচারী হিসেবে দেখিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী, ২১ জুলাই ২০১৭ তারিখে, শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি, ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ইমতিয়াজ মাহমুদ নামে সুপ্রীম কোর্টের এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদর থানায় তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করেছেন। আশা করছি, অনেক ঘটনার ভিড়ে, রামগড়ের এই ঘটনাটি হারিয়ে যাবে না; যারা আজীবন মিথ্যের বেসাতি করে বেড়ায়, তাদের অন্তত একজনের হলেও যথোপযুক্ত শাস্তি হবে।

পার্বত্যাঞ্চলে উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নবাদী উপজাতীয় সন্ত্রাসী ও তাদের দোসরা ইন্টারনেট, নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রিয় চেতনা ও দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে সব সময় ঘৃণাত্নক ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, সহাবস্থান, উন্নয়ন, বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে উষ্কানীমূলক প্রচারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এদের নিয়ন্ত্রণে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ, সঠিক ও যথাযথ ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এ কারণে যে, দেশের স্বার্থে তারা নাগরিকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে সহযোগিতা করেছেন।

এতে, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুষ্ট লোকদের দমন করাও সম্ভব হবে। সর্বোপরি, সমগ্র দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করাও সহজ হবে।

মাহের ইসলাম: পার্বত্য গবেষক ও ব্লগার

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন