“দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যদি সরকারের সাথে থাকে তাহলে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদ টিকে না”
পার্বত্যনিউজের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় মেজর জেনারেল(অব.) অনুপ কুমার চাকমা ও মেজর জেনারেল(অব.) আবদুর রশীদ
গত ২৭ সেপ্টেম্বর পার্বত্যনিউজের ফেসবুক ফ্যান পেইজের লাইক সংখ্যা এক লাখ পুর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল(অব.)অনুপ কুমার চাকমা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল(অব.)আবদুর রশীদ। এসময় প্রবল ব্যস্ততা ও সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেও তারা পার্বত্যনিউজ সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশের সাথে এক অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নেন। পার্বত্যনিউজের পাঠকদের জন্য সেই অনির্ধারিত আলোচনা তুলে এনেছেন- সৈয়দ ইবনে রহমত
মেহেদী হাসান পলাশ: আজকের প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসার পর পার্বত্য ইস্যুতে নতুন মাত্রা এসেছে। নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট হিসাবে এ বিষয়টাকে আপনারা কীভাবে দেখছেন? বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর কি প্রভাব ফেলতে পারে বলে আপনারা মনে করেন?
মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ: এখানে আগে আমাদের দেখতে হবে যে, রোহিঙ্গারা কোথায় অবস্থান নিচ্ছে? বাস্তবতা হচ্ছে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আমরা দেখছি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়লে এর প্রভাব কী হবে সেটা সম্ভবত এ মুহূর্তের ভাবনার বিষয় নয়। এখন যেটি ভাবনার বিষয় সেটি হলো- তাদেরকে একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে যতটা সম্ভব মানবিক সহায়তা প্রদান করা। তবে তাদের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার কিছু ঝুঁকি তো রয়েছেই।
সে কারণেই ভাবতে হবে যে, কোনভাবেই যেন তারা নির্দিষ্ট এরিয়ার বাইরে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামেই হোক কিংবা চট্টগ্রামেই হোক সেখানকার জনগণের ওপর যেন তাদের প্রভাবটা না পড়তে পারে। সেটিই এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি।
মেজর জেনারেল অনুপ কুমার চাকমা: আরেকটা বিষয় শুধু আমি অ্যাড করতে চাই, এই রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের সমস্যা না। এটা পুরো অঞ্চলের সমস্যা। এর প্রভাব ভারতে পড়তে পারে, চীনে পড়তে পারে, মালয়েশিয়াতে পড়তে পারে, ইন্দোনেশিয়াতে পড়তে পারে, থাইল্যান্ডে পড়তে পারে। কারণ রোহিঙ্গারা তো চুপ করে বসে থাকতে চাইবে না, তারা কিছু একটা করার চেষ্টা করবে। আগেও যেটা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে গেছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চলে গেছে, অন্যান্য দেশেও গেছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে তো এর প্রভাব পড়বেই, কারণ তাদের অবস্থানের পার্শ্ববর্তী জায়গা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।
আরও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এমন একটি এলাকা যেখানে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ আমরা যাই বলি না কেন, তাদের বিচরণের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক জায়গা, তাদের চলাফেরার জন্য, অপারেশন চালানোর জন্য, ট্রেনিং নেয়ার জন্য। এখন যদি কোনো টেররিস্ট গ্রুপ বা সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয় তাহলে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গমতার সুযোগ নিয়ে সহজেই চলাফেরা করতে পারবে। এটাই বড় আশঙ্কার বিষয়। সেটা যেমন স্থানীয় লোকদের জন্য, আমাদের দেশের জন্য, মিয়ানমারের জন্য, এমনকি পার্শ্ববর্তী সবার জন্যই এটা আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
মেহেদী হাসান পলাশ: আপনি তো এক ধরনের টেররিজমের কথা বলেছেন, আমরা আরেক ধরণের টেররিজম সম্পর্কেও খবর পাচ্ছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে সমস্ত আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে তাদের কিছু সদস্য যারা মিয়ানমারে ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল বা নিচ্ছে তাদের একটা বড় অংশ মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে মিয়ানমার আর্মির সহায়তায় তারাও রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার করছে। আমরা এমন কিছু ভিডিও চিত্র পেয়েছি যেখানে কয়েকজন রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধি আমাদের বলেছেন যে, তারা দেখেছেন বার্মিজ আর্মির পোশাক পরা কিছু লোক তাদের ওপর অত্যাচার করছে যারা চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলছেন। বার্মিজ আর্মিতো চাঁটগাইয়া বাংলা ভাষায় কথা বলবে না। তাদের ধারণা ওরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা। এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এটা কী ধরণের প্রভাব তৈরি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মেজর জেনারেল অনুপ কুমার চাকমা: আমি জানি না, যে আপনার তথ্যের সোর্স কী? কিন্তু এরকম যদি হয়ই, তাহলে সেটা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। এটা পুরো অঞ্চলকেই অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং এটা একে অপরের মধ্যে আস্থার সংকটা তৈরি করবে। রোহিঙ্গারা যেটা বলছেন যে, চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে তাদের ওপর আক্রমণ করছে, এটা সত্য হলে এখানে যারা আছে তাদের সাথে একটা আস্থার সংকট তৈরি করবে, ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। আর এটা যদি বেড়ে যায় তাহলে তো পুরো অঞ্চলটাই অস্থিতিশীল করে তুলবে। আগেই এ অঞ্চলটা ছিল অস্থিতিশীল, নতুন এই ইস্যুটা যুক্ত হয়ে সেটা আরও জটিল করে তুলবে। এটা তো ভালো লক্ষণ না।
মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ: এটার সত্যতা কতটুকু আছে, সেটি আগে যাচাই করতে হবে। আমার কাছে যেসব তথ্য আছে, তাতে উঠে এসেছে যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে কিছু লোকাল রোহিঙ্গাও যুক্ত আছে। যাদেরকে আমরা বলতে পারি কোলাবরেটর, তথা দালাল শ্রেণির বলতে পারি। তবে সেটির সংখ্যা খুব বেশি না। আমাদের সীমানার মধ্যে যে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে তাদের মধ্যে যদি কোন কারণে জিহাদি মতবাদ অনুপ্রবেশ করে তাহলে, তারা যদি সশস্ত্র কোন বাহিনী গঠন করে বা সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তাহলে সেটিই সবার জন্য হবে বিপদজনক। কারণ টেররিজমের কোন বাউন্ডারি নেই। তাই এটি ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মিয়ানমার তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই, সেক্ষেত্রে ভারতও মুক্ত থাকবে না।
তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কিন্তু অত্যন্ত সুস্পষ্ট। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে যুক্তভাবে অভিযান পরিচালনা করতে চায়, অর্থাৎ বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের এমন কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না যে, বাংলাদেশের ভূমিকে ব্যবহার করে তারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হতে পারবে। তারপরেও যদি এমন কিছুর আশঙ্কা তৈরি হয় তাহলে উভয় দেশ মিলে আমরা একটি যৌথ বাহিনী বা টাস্কফোর্স গঠন করতে পারি। যারা জঙ্গিবাদ নির্মূলে পরস্পরকে সহায়তা করবে।
মিয়ানমারের জঙ্গি বাহিনী বাংলাদেশে লুকাবে কিংবা বাংলাদেশের জঙ্গি বাহিনী মিয়ানমারে লুকাবে বা ভারতে লুকাবে- এটা চলতে পারে না। সেটাই আগে বন্ধ করতে হবে। আপনি যেটা বললেন যে, কিছু লোক এখান থেকে গিয়ে সেখানে মিয়ানমার আর্মির সাথে মিলে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার করছে, সেটি আমার জানা নেই। তবে আমি যতটুকু জানি সেটি হচ্ছে, কিছু লোক আছে যারা ক্রস বর্ডার মুভমেন্ট করে যেমন, আরসা। তাদের আগের সংগঠন হারাকা আল ইয়াকিন, এরা বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে আবার মিয়ানমারেও লুকিয়ে থাকে। এটি একটি আঞ্চলিক ঝুঁকি। তবে বাংলাদেশ একটিকে কখনই উৎসাহিত করে না।
এটি পাকিস্তানি পলিসি, বাংলাদেশের পলিসি না। বাংলাদেশ অন্য দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়ে সে দেশকে অস্থিতিশীল করার চিন্তাধারার মধ্যে অবস্থান করছে না। আসলে হিংসা দিয়ে কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এটিই হলো মূল কথা।
মেহেদী হাসান পলাশ: বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে, এরপর ব্যাপকভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছে, এখনও করছে। কিন্তু তারপরও সেখানকার কিছু লোক এখনও সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। এর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মেজর জেনারেল অনুপ কুমার চাকমা: আমি যেহেতু দীর্ঘদিন মিয়ানমারে ছিলাম, তাই আমি সেখানকার কিছু অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চাই। মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর কিন্তু ১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের দেশের বিভিন্ন ইন্সার্জেন্সি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। শানদের সাথে, কারেনদের সাথে, কাচিনদের সাথে, চীনাদের সাথে, এমনকি আরাকানিদের সাথেও যুদ্ধ করছে। তারা বিভিন্ন গ্রুপের সাথে বিভিন্ন সময় চুক্তি করেছে, ২০১২ সালেও চুক্তি করেছে। কিন্তু দেখা যায়, যেখানেই চুক্তি করুক না কেন, সেখানে হয়তো বড় গ্রুপটি চুক্তি মেনে শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, অপর দিকে এক বা একাধিক গ্রুপ বেরিয়ে যায় বিভিন্ন কারণে। তারা হয় নিজেদের স্বার্থে বা নিজেদের ইচ্ছায় বা নিজেদের চিন্তাধারায় এটা করে। এটা আসলে সব ক্ষেত্রেই থাকে, তবে তাদের কোনো ভিত্তি নেই। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যদি সরকারের সাথে থাকে তাহলে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদ টিকে না।
মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ: সহমত
( আলোচকদ্বয়ের অন্য এপয়েন্টমেন্ট থাকায় সময়াভাবে এই মনোজ্ঞ আলোচনা সুসমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি।)