জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে পোস্টিং করেন

আ ল ম ফজলুর রহমান

(দুই)

ফারুয়া ব্যাটালিয়ান সদরে আমাকে সাদরে গ্রহণ করা হলো। বিদায়ী ব্যাটালিয়ান সিও আমার সিনিয়র। আর্মিতে সিনিয়র এবং জুনিয়রের বিষয়টি স্পর্শকাতর । সিনিয়র জুনিয়রের মধ্যকার ডিলিং এর বিষয়গুলো একটি সেট রুল/কনভেনশনের দ্বারা পরিচালিত। যেমন সিনিয়রের সামনে ক্রস লেগ বসা নিষেধ। ধুমপান নিষেধ। তবে রেঙ্কের ব্যাবধান বেশী নাহলে অনুমতি নিয়ে ধুমপান করা যেতে পারে। জুনিয়রদের মধ্যে কোনো সিনিয়র উপস্থিত হলে তাঁকে দাঁড়িয়ে সামরিক কায়দায় সম্মান প্রদর্শন করবে। যদি সেখানে টেলিভিশন চলে তবে কার্টসি হলো জুনিয়ররা সিনিয়র অফিসারকে জিজ্ঞেস করবে, তাঁর পছন্দের কোনো চ্যানেল তিনি দেখতে চান কিনা বা টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেবে কিনা?

অর্থাৎ অফিসার মেসে যেমন মেস ম্যানার সম্বন্ধে সেট রুল আছে তেমনি সিরিমনিয়াল এবং ক্যাজুয়াল উভয় পরিবেশে সিনিয়র, জুনিয়র এবং সামরিক জীবনে পরিবারের রোল সম্পর্কেও সেট রুল ও কনভেনশন আছে। যা সামরিক বাহিনীর সবাই মেনে চলেন।


এই সিরিজের আগের লেখা পড়ুন:

পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার অভিজ্ঞতা – ১


আমি বিদায়ী সিও এবং ব্যাটালিয়ান অফিসারদের সাথে দুপুরের খাবার খেলাম। অনেক পরিচিত মুখ দেখলাম যাদের সাথে পুর্বে একসাথে চাকরি করেছি। মজার ব্যপার হলো আমার সেকেন্ড ইন কমান্ড ( টুআইসি) আমার কোর্সমেট। এমন সাধারণত হয় না। সেকেন্ড ইন কমান্ড ( টুআইসি ) কে বলা হয় আন্ডার স্টাডি সিও।

অর্থাৎ অল্প কিছু দিনের মধ্যে সে ব্যাটালিয়নের আধিনায়ক ( কমান্ডিং অফিসার বা সংক্ষেপে সিও ) হবেন । তাই ব্যাটালিয়ানের ভবিষ্যত আধিনায়ক বা কমান্ডিং অফিসার বা সংক্ষেপে সিও হিসাবে হাতেকলমে কমান্ডের কাজ শেখার জন্য তাকে মেজর রেঙ্কে একজন লে: কর্নেল পদবীর সিও’র অধীনে নিয়োগ দেয়া হয়। এখান থেকে ভালো এন্যুয়াল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট ( এসিআর ) নিয়ে যেতে পারলে পরবর্তীতে সে পদোন্নতি পেয়ে ব্যাটালিয়ানের সিও হয়।

আর্মিতে ব্যাটালিয়ান কমান্ডকে বলা হয় চ্যালেঞ্জিং কমান্ড এবং পারসোনাল কমান্ড। এই কমান্ড শেয়ার করা যায় না। তাই সেকেন্ড ইন কমান্ডের পদটি একটি থ্যাঙ্কলেস এবং স্পর্শকাতর পদ হিসেবে পরিচিত। থ্যাঙ্কলেস এজন্য বললাম যা ভালো কাজ টুআইসি করেন তার ক্রেডিট পান সিও সাহেব। আর খারাপ কিছু করলে তার দায়ভার টুআইসির । তার পরেও টুআইসিকে তার আর সিও’র মধ্যে একটি সুন্দর ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করতে হয়। আমার মনে হয় উচ্চতর কমান্ডের এই ভারসাম্য রক্ষার কৌশল শিখবার জন্যই টুআইসি হিসাবে একজন মেজরকে ব্যাটালিয়ানের সেকেন্ড ইন কমান্ডের ( টুআইসি ) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এখানে একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে সবার অবহিত হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি। উনিশ শত একাশি সালে জেনারেল জিয়া নিহত হবার পরে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসীন হন। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দলে দলে চাকরী চ্যুত করেন এবং বাকীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে পোস্টিং দিয়ে শান্তিবাহিনীর কেনন ফোডার হিসাবে পাঠিয়ে দেন। এদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম।

যাহোক ফিল্ড অফিসার মেসে দুপুরে খাবার সময় বিদায়ী সিও’র সাথে সৌজন্যমুলক কিছু আলোচনা হলো। পরের দিন কি কি প্রোগ্রামের শেষে আমি ব্যাটালিয়ানের সিও হিসাবে কমান্ড গ্রহণ করবো এবং বিদায়ী সিওকে কখন কিভাবে বিদায় দেবো সে বিষয়ে সেকেন্ড ইন কমান্ড ( টুআইসি ) আমাকে অবহিত করবেন বলে বিদায়ী সিও সাহেব আমাকে অবহিত করলেন। এর পরে আমাকে আমার রুমে ব্যটালিয়ান এডজ্যুটেন্ড নিয়ে গেলেন।

প্রথমেই যে খাটে ঘুমাবো তার সাইজ দেখে আমার চোখ কপালে ! খাটটি লম্বায় প্রায় আট ফুট হবে। আমি এডজ্যুটেন্ডকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার খাট এতো লম্বা কেন? এডজ্যুটেন্ড জবাবে বললো, স্যার সব আপনার কোর্সমেট টুআইসির কাজ। উনি আমাকে ডেকে বলেছেন “ম্যান মাউন্টেন” ইজ কামিং( আমি লম্বায় ছয়ফুট তিন ইঞ্চি )। খাটের লম্বা বাড়াতে হবে। বুঝলাম এটা আমার কোর্সমেট টুআইসির কাজ।

কারন সে খুব জলি মাইন্ডের আমুদে লোক। বানর নিয়ে একজন যেমন সারাদিন আমোদে কাটাতে পারে তেমনি আমার কোর্সমেটকে একবার সামনে পেলে কিভাবে যে সময় চলে যায় টের পাওয়া যায় না।

-চলবে

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন