জুমল্যান্ড গঠনের স্বপ্ন

এবনে গোলাম সামাদ

এবনে গোলাম সামাদ
জুম চাষ বলতে বোঝায় সাধারণত টিলার গায়ে গর্ত করে বীজ বপন করে চাষ করাকে। টিলার গায়ের গাছপালাকে কেটে আগুন ধরিয়ে প্রথমে বন পরিষ্কার করা হয়। কাঠ পোড়া ছাইয়ের স্তরের মধ্যে গর্ত করে বীজ বপন করা হয়। জুম শব্দটা হতে পারে কোলভাষা পরিবার থেকে আগত। কিন্তু শব্দটা ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেন ইংরেজরা। সর্বত্র যে জুম কথাটা এই উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল, তা নয়। যেমন উত্তর ভারতে এই চাষপ্রথাকে বলা হতো ‘দাহি’। যেহেতু বন পুড়িয়ে বা দাহ করে করা হতো এরকম চাষ; তাই একে বলা হয় দাহি। কিন্তু জুম কথাটাই হতে পেরেছে বিশেষভাবে প্রচলিত।

জুম নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। কারণ চাকমা নেতা সন্তু লারমা (জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা) বলছেন, জুমল্যান্ড গড়ার কথা। কিন্তু জুম চাষ যে কেবল চাকমারাই করেন, তা নয়। ভারতে এখন জুম চাষ করা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু একসময় দক্ষিণ ভারতের উরালী উপজাতিরাও জুম চাষ করতেন। মানবধারার দিক থেকে উরালীরা চাকমাদের মতো মঙ্গলীয় মানবধারাভুক্ত নন। তাদের বলতে হয় ইন্দো-অস্ট্রালয়েড। এদের গায়ের রং সাঁওতালদের মতো কালো। চুল মসৃণ তরঙ্গাকৃতি। চোখ আয়ত। নাকের অগ্রভাগ মাংশল। কপালের মধ্যভাগ একটু চাপা। এদের চেহারার সঙ্গে কিছুটা মিল আছে আস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের। তাই নৃতাত্ত্বিকরা এদের বলতে চান ইন্দো-অস্ট্রালয়েড। পক্ষান্তরে চাকমাদের মাথার চুল খরখরে। মুখে থাকতে দেখা যায় দাড়িগোঁফের অভাব। চোখের ওপর পাতার কোণে থাকতে দেখা যায় বিশেষ রকমের ভাঁজ। যে কারণে এদের চোখ দেখে মনে হয় ছোট। এদের গণ্ডের হাড় অনেক উঁচু। তাই মুখমণ্ডল দেখে মনে হয় সমতল। কেন, কী কারণে চাকমারা জুম চাষ করেন উরালীদের মতো, তার ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। কিন্তু সন্তু লারমা বলছেন যেহেতু চাকমা, মারমা, গারো, খাসিয়ারা সবাই মঙ্গলীয় মানবধারাভুক্ত, আর তারা সবাই করেন জুম চাষ, তাই এদের সবাইকে নিয়ে গড়তে হবে একটি দেশ, জুমল্যান্ড। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, খাসিয়ারা যেমন জুম চাষ করেন, তেমনি আবার লাঙল দিয়ে চাষাবাদও করেন। কেবলই যে জুম চাষ করেন, তা কিন্তু নয়।

সন্তু লারমা ২০০১ সালের ৩১ মার্চ গড়েন ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’। এই ফোরামে তিনি গ্রহণ করেছেন সাঁওতালদের। কিন্তু সাঁওতালরা কখনো জুম চাষ করেন না। সাঁওতালরা একসময় ছোট নাগপুরের বনজঙ্গলে শিকার করে এবং ফলমূল আহরণ করে জীবনযাপন করতেন। পরে এরা আরম্ভ করেন লাঙল দিয়ে চাষাবাদ। তবে সাঁওতালদের লাঙল হয় কিছুটা ছোট। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এখন অনেক সাঁওতালের বাস। ছোট নাগপুর অঞ্চল থেকে এসব সাঁওতালকে প্রথম নিয়ে আসেন নীলকর ইংরেজ সাহেবরা, নীলচাষ করার জন্য। সেখান থেকে এরা রাজশাহী অঞ্চলে আসেন ১৯০০ সালে, তার আগে নয়। রাজশাহী জেলার মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই ভাগ হলো সাঁওতাল। এরা বাস করেন রাজশাহী জেলার তিনটি উপজেলায়- গোদাগাড়ী, তানোর ও পবা। এদের নিয়ে বিশেষ ধরনের রাজনীতি করছেন ওয়ার্কার্স পার্টি। সন্তু লারমার কথা যে সব সাঁওতাল শুনছেন, এমন নয়। সাঁওতালরা হলেন বাংলাদেশের উপজাতিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সাঁওতালরা যদি রাজশাহী ছেড়ে রাঙ্গামাটিতে যেতে চান এবং সেখানে বসতি করতে চান, সন্তু লারমা কি তাতে রাজি হবেন? অনেক অতীতে সাঁওতালরা পার্বত্য অঞ্চলে যেতে চায়নি যে, তা নয়। কিন্তু সেখানে তাদের স্থান হয়নি। বাংলাদেশের চা বাগানে শ্রীহট্ট অঞ্চলে অনেক সাঁওতাল কাজ করেন। চট্টগ্রামের চা বাগানেও তারা যেতে পারতেন; কিন্তু যাননি।

সব উপজাতি, চাকমা উপজাতি নন। চাকমাদের সাথে মানবধারাগত মিল আছে মারমাদের। কিন্তু বান্দরবানের মারমাদের সাথে চলেছে রাঙ্গামাটির চাকমাদের বিবাদ। মারমারা বান্দরবানে জুম চাষ করলেও তাদের সাথে চাকমা জুমচাষিদের কোনো আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠতে পারেনি। চাকমা এবং মারমারা উভয়ই এসেছেন আরাকান অঞ্চল থেকে। চাকমারা এসেছিলেন আগে, মারমারা এসেছিলেন পরে। কিন্তু মারমারা এসে তাদের ঠেলে দিয়েছেন রাঙ্গামাটি অঞ্চলে। চাকমারা আগে ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণ অঞ্চলে। কিন্তু সেখানে এখন চাকমাদের কোন বসতি নেই। বাংলাভাষী মানুষ চাকমাদের রাঙ্গামাটির গভীর অরণ্যে যেতে বাধ্য করেনি, তাদের রাঙ্গামাটির গভীর অরণ্যে সরে যেতে বাধ্য করেছেন মারমারা। যাদের সাধারণত বলা হয় মগ। অর্থাৎ যারা এই জুম চাষ করেন, সন্তু লারমা যে তাদেরই একমাত্র প্রতিনিধি, তাও নয়। ১৯৪৭ সালে চাকমারা রাঙ্গামাটিতে উড়িয়েছিলেন ভারতের পতাকা। রাঙ্গামাটি দখল করতে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার সরকারকে পাঠাতে হয়েছিল সৈন্য। বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা গিয়ে দখল করেন রাঙ্গামাটি, নামান ভারতীয় পতাকা এবং উড়ান পাকিস্তানের পতাকা। এটা হলো ইতিহাস।

খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান আগে ছিল একটি মাত্র জেলা। যাকে সাধারণভাবে বলা হতো চট্টগ্রামের পার্বত্য মহাল। ইতিহাস বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহাল সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। তার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহাল বলে কোনো কিছু ছিল না। কিন্তু সন্তু লারমার কথা শুনে মনে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি স্বাধীন অঞ্চল। আর পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ববাংলা সরকার জোর করে সেটা দখল করেছে। যেটা ঘটনা নয়। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ববাংলার সাথে যুক্ত হয়েছে র‌্যাডক্লিফ রয়েদাদ অনুসারে। বাংলাভাষী মুসলমান গায়ের জোরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে দখল করেননি। ইংরেজ আমলে একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে যুক্ত করার কথা হয় তখনকার আসাম প্রদেশের সাথে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এর বিরোধিতা করেন এবং থাকতে চান চট্টগ্রাম বিভাগেরই অংশ হয়ে। এটাও ইতিহাস।

পার্বত্য চট্টগ্রাম, অর্থাৎ খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানকে পৃথক করে নিয়ে সন্তু লারমা গড়তে চাচ্ছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। যেটা গড়তে দিলে বাংলাদেশ হারাবে তার দশ ভাগের এক ভাগ ভূমি। জানি না কেন আওয়ামী লীগ সরকার সন্তু লারমার সাথে একটা চুক্তি করতে গিয়েছিল। তারা কি ভেবে দেখার সুযোগ পাননি যে, এর ফলে বাংলাদেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চলে গেলে চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়বে খুবই অনিশ্চিত। চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়েও আওয়ামী লীগ সরকার কিছু ভেবেছিলেন বলে মনে হয় না। অথচ ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব রাঙ্গামাটিতে গিয়ে এক সভায় ঘোষণা করেন, ‘দেশের সকল লোক বাঙালি বলে বিবেচিত হবে।’ আওয়ামী লীগ দাবি করে যে, তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন। শেখ মুজিব হলেন বাঙালি জাতির জনক। কিন্তু শেখ মুজিবের বাঙালিত্বকে বাদ দিয়ে তারা করে বসেন সন্তু লারমার সাথে বিশেষ চুক্তি। যা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আওয়ামী লীগ অবশ্য তাদের ভুল ধরতে পারে। আর তাই চায় না পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে। সন্তু লারমা যতদূর জানা যায়, একসময় করতেন বাম রাজনীতি। তিনি ছিলেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের সাথে।

বর্তমান আওয়ামী লীগের মধ্যে বিশেষভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, দীলিপ বড়ুয়া, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আ ফ ম রুহুল হক, নুরুল ইসলাম নাহিদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, শাহজাহান খান, অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান, ইয়াফেস ওসমান, নূহ-উল আলম লেনিন। এই তালিকাটি দেয়া হয়েছিল দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ -এর ২০১৩ সালের ২৭ জুন সংখ্যায়। মনে করার কারণ আছে যে, এদের প্ররোচনায় আওয়ামী লীগকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত হতে হয়েছিল এবং গ্রহণ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল সম্পর্কে বাংলাদেশবিরোধী নীতি।

দেশের রাজনীতি এখন কোন পথে যাচ্ছে আমরা জানি না। খালেদা জিয়া শান্তিচুক্তির পক্ষে ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, শান্তিচুক্তি হলে সাঁওতালরাও দাবি করবেন স্বাধীনতা। বাংলার উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলে যেমন অনেক সাঁওতালের বাস, তেমনি ভারতের বরেন্দ্র অঞ্চলেও বহু সাঁওতালের বাস। এদের অনেকেই এখন খ্রিষ্টান হয়েছেন। যদি বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের খ্রিষ্টান সাঁওতালরা এবং ভারতের বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতালরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে চান, তবে পরিস্থিতি অবশ্যই জটিল হয়ে উঠবে। সাঁওতালরা দাবি করছেন তাদের ভাষার স্বাতন্ত্র্যকে মেনে নিতে হবে। ভারতে এখন প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে ঝাড়খ নামে একটি নতুন প্রদেশ। সেখানে সাঁওতালরা হলেন সংখ্যাগুরু। কিন্তু ঝাড়খণ্ড প্রদেশের সরকারি ভাষা সাঁওতালি করা হয়নি। ঝাড়খণ্ড প্রদেশের সরকারি ভাষা করা হয়েছে নাগরি অক্ষরে লেখা হিন্দি। অথচ বাংলাদেশে সাঁওতালরা দাবি করছেন তাদের ভাষার স্বাতন্ত্র্য। একসময় সাঁওতালি ভাষা লেখা হতো বাংলা অক্ষরে। কিন্তু এখন তা লেখা হচ্ছে রোমান অক্ষরে। এ দেশের অনেক বাম রাজনীতিক করছেন সাঁওতালদের সমর্থন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী বাম রাজনীতিকেরা অনেকে পড়েছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। কেননা, ঝাড়খণ্ডে বাংলাভাষী হিন্দুরা পড়তে চলেছেন উপজাতিদের, বিশেষ করে সাঁওতালদের কোপে। ঝাড়খণ্ডের মধ্যে পড়ে জামসেদপুর। যেটা হলো টাটা কোম্পানির ইস্পাত ও লোহা নিষ্কাশনের কারখানা। জামশেদপুরে বহু হিন্দু বাংলাভাষীর বাস। সেখানেও তারা হতে পারেন উপজাতিদের কোপের শিকার। তাদের ঝাড়খণ্ড ছেড়ে ভবিষ্যতে সরে আসতে হতে পারে পশ্চিমবঙ্গে।

উপজাতি মানেই যে অসহায় নিরীহ মানুষ, তা নয়। একদিন মগদের অত্যাচারে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে পড়েছিল জনশূন্য। মেজর জেমস রেনেলের মতে, এখন যেখানে সুন্দরবন, সেখানে একসময় ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ। মগদের অত্যাচারে পালিয়ে যাওয়ার কারণে অঞ্চলটি হয়ে পড়ে জনশূন্য। গড়ে ওঠে গভীর বন। যাকে এখন বলে সুন্দরবন। জেমস রেনেল ১৭৬৪ সালে তখনকার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল জরিপ করে প্রস্তুত করেন বাংলার নির্ভরযোগ্য মানচিত্র। তিনি সুন্দরবনের মানচিত্র অঙ্কনের জন্য সুন্দরবন অঞ্চলে যান। সুন্দরবন অঞ্চলের কাছে অবস্থিত বরিশাল জেলার অনেক প্রাচীন ব্যক্তির মুখে তিনি শুনতে পান যে, তারা তাদের প্রাচীনদের মুখ থেকে শুনেছেন, সুন্দরবন অঞ্চলে একসময় কোনো বন ছিল না। ছিল জনবসতি। মগদের অত্যাচারে মানুষ পালাবার ফলে সেখানে গড়ে ওঠে বন। ইংরেজ আমলে মণিপুর অঞ্চল থেকে কুকিরা এসে চট্টগ্রামে লুটপাট করত। খুন করত মানুষকে। ইংরেজরা কুকিদের দমন করে।

উপজাতিদের নিয়ে রাজনীতি করা তাই হয়ে উঠতে পারে যথেষ্ট বিপজ্জনক। বাংলাদেশে যাদের বলা হচ্ছে উপজাতি, তাদের সবাইকে গণনা করলে তাদের মোট জনসংখ্যা হতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগের কাছাকাছি। এই এক ভাগ লোককে নিয়ে কেন বামপন্থীরা রাজনীতি করতে চাচ্ছেন, সেটা বোঝা বেশ কঠিন। ভারতে নকশালপন্থীরা এখন উপজাতিদের নিয়ে রাজনীতি করছেন। হতে পারে আমাদের দেশের বামপন্থীরা এদের চিন্তা চেতনার দ্বারাও হতে চাচ্ছেন কিছুটা প্রভাবিত।

উপজাতিদের অনেকে বলতে চাচ্ছেন, আদিবাসী। আদিবাসী শব্দটার করা হচ্ছে অপব্যবহার। কেননা, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, এ দেশে যারা সংখ্যাগুরু তাদেরই বলতে হয় আদিবাসী। তারা বাইরে থেকে আসেননি। আমাদের জনসংখ্যার অনেকের পূর্বপুরুষই একসময় ছিলেন তাম্র-প্রস্তর যুগের মানুষ। পরে তারা হয়ে উঠেছেন আরো সভ্য। একসময় সব মানুষই ছিলেন অরণ্যবাসী। অনেকে থেকে গেছেন অরণ্যবাসী হয়েই। তাদের জোর করে কেউ অরণ্যবাসী করে তোলেননি।

সন্তু লারমা তার বক্তৃতায় এমন অনেক কথাই বলছেন যে, আমাদের ইতিহাস জ্ঞানের সাথে তা মোটেও খাপ খেতে পারছে না। সন্তু লারমা যদি মনে করেন, জোর করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে তিনি বাংলাভাষী মুসলমানদের তাড়িয়ে দিতে পারবেন, তবে তারাও যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাবেন, এমন নয়। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারাও বাধ্য হবেন পাল্টা বল প্রয়োগ করতে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখন উপজাতি ও বাংলাভাষী মুসলমানের সংখ্যা প্রায় দাঁড়িয়েছে সমান সমান। উপজাতিরা কম করে ১০-১২টি বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানেরা তা নন। শক্তির মহড়া দেখিয়ে তাই লাভ হবে না। যেমন লাভ হয়নি ১৯৪৭ সালে রাঙ্গামাটিতে ভারতের পতাকা উড়িয়ে।

চাকমাদের এখন আর কোনো নিজস্ব ভাষা নেই। তারা যে ভাষায় কথা বলেন, তা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলা ভাষারই একটি রূপ মাত্র। তাদের কোনো নিজস্ব বর্ণমালাও নেই। মারমাদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে এবং তারা সেটা লেখেন প্রাচীন বর্মী অক্ষরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি উপজাতির মধ্যে ভাষার পার্থক্য বিদ্যমান। তারা যখন একে অন্য উপজাতির মানুষের সাথে কথা বলতে চান, তখন তাদের গ্রহণ করতে হয় বাংলাভাষারই সাহায্য। কেবল জুম চাষ করেই জুমল্যান্ড গঠন করার স্বপ্ন দেখা ভুল।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “জুমল্যান্ড গঠনের স্বপ্ন”

  1. লেখাটি পড়ে মনে হলো লেখক একজন বিদগ্ধ জন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিষ্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা, মন্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া মনে হয়েছে একপাক্ষিক ও বিদ্বেষপ্রসূত। বান্দরবানের মগ বা মারমাদের সাথে চাকমাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেটা অবশ্যই বাস্তব নয়। কেননা মারমাদের সাথে চাকমাদের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক তো নয়ই বরং সৌহার্দ্যমূলক। এমন কি মারমাদের সাথে চাকমাদের বৈবাহিক সম্পর্কও রয়েছে পাকিস্তানী আমল থেকে। মং সার্কলের এক রাজকুমারীর সাথে কুমার রাজীব রায়ের (টকিবাবু) বিবাহ- শুধু এই একটা উদাহরণই যথেষ্ঠ বলে মনে হয় লেখকের আপন মনের মাধুরী মেশানো তথ্য ভুল প্রমাণ করার জন্য। চাকমাদের নিজস্ব কোন ভাষা বা বর্ণমালা নেই- এমন উদ্ভট এবং অসত্য কথা বলা তো আপনার মত বিদগ্ধ জনের একেবারেই বেমানান। তবে হ্যাঁ, কয়েকটা চাকমা বর্ণমালার সাথে মারমাদের (প্রাচীন বর্মী) বর্ণমালার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। তাই বলে চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই বলাটা অর্বাচীনের মত কথা হয়ে গেল না কি? চাকমা ভাষার সাথে চট্টগ্রামের ভাষার অনেকখানি মিল রয়েছ এবং চাকমা ভাষায় বাংলা, ইংরেজী, বর্মী ইত্যাদি অনেক শব্দও রয়েছ যেমন রয়েছে বাংলা ভাষায় ইংরেজী, ফার্সী, উর্দু, বার্মিজ ইত্যদি শব্দ। তাতে কি এটা প্রমাণ হয় যে বাংলা ভাষাও ঐ সমস্ত ভাষা থেকে উতপত্তি হয়েছে?
    আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তি করেছে বিধায় আপনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং সমালোচনামূখর হয়েছেন। এটাতে কিন্তু আপনি ক্ষমতাসীন সরকারের নীতির বিরোধীতা করছেন যা দন্ডনীয় অপরাধ। এটা থেকে বিরত থাকার জন্য আপনাকে আহবান জানাচ্ছি। তাছাড়া সন্তু লারমার আন্দোলন স্বাধীণতা বা জুম্মল্যান্ড কায়েমের আব্দোলন নয়, এটা স্পষ্টতই চুক্তির আলোকে চুক্তি বাস্তবায়ন এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। একটা বৈধ এবং গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টাকে ভিন্ন রকম রং দেবেন না অনুগ্রহ করে। আপনি না জেনে বলেছেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাওতাল নেই, সেটা যথাযথ তথ্যভিত্তিক নয় বলে আমি নিশ্চিত। খবর নিয়ে দেখুন রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়িতে এখনো অনেক সাঁওতাল বাস করেন। আর সন্তু লারমার আন্দোলন কেবল জুমচাষকে কেন্দ্র করে নয় বলে বিশ্ববাসীও জানে- জানেন না শুধু আপনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন