ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও বর্ণমালা প্রসঙ্গে

Ferdous Quoreshi20120710125920

ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

দেশের কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা লড়াই করেছি। তাই অন্যদের মাতৃভাষার অধিকারের প্রশ্নে আমরা বরাবরই সংবেদনশীল। আমাদের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মহান স্মৃতিবিজড়িত ২১ ফেব্রুয়ারি আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা বাংলাভাষীরা যেভাবে আমাদের মাতৃভাষাকে ভালোবাসি, ছোট-বড় সব জাতিসত্তা বা নৃ-গোষ্ঠীর মানুষই তাদের মাতৃভাষাকে সেভাবে ভালোবাসবে, সেটাই স্বাভাবিক।

বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন ৭০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী চিহ্নিত হয়েছে, যাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ মাতৃভাষা রয়েছে। তবে এসব নৃ-গোষ্ঠীর তিন-চারটি ছাড়া অন্যদের জনসংখ্যা খুবই কম। অনেকের মাত্র কয়েক হাজার। এসব নৃ-গোষ্ঠীর লোক প্রয়োজনের তাগিদে বাংলা ভাষা কমবেশি রপ্ত করে নিয়েছেন। অনেকে অন্য অনেক জেলার বাঙালির চেয়ে ভালো বাংলা বলেন। বাংলা গান গেয়ে বাংলাদেশ আইডলও হচ্ছেন। এসব নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার কোনোটিরই লিখিত রূপ গড়ে না ওঠায় বা প্রচলিত না থাকায় প্রয়োজনে লেখালেখি বাংলা বর্ণমালা দিয়েই হয়ে এসেছে। সাম্প্র্রতিককালে এসব ভাষার কোনো কোনোটির জন্য আলাদা বর্ণমালা উদ্ভাবন ও বইপত্র তৈরির উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। চাকমা ভাষা লেখার জন্য একটি বর্ণমালার বর্ণনা দেখেছি ইন্টারনেটে। উদ্যোগটি পুঁথিগত বিবেচনায় সাধু উদ্যোগ। চাকমা ভাষাভাষী মানুষ নিজেদের ভাষায় নিজস্ব বর্ণমালা দেখে খুশি হবেন। এভাবে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতির ভাষার জন্যও বর্ণমালা তৈরির চেষ্টা হতে পারে। আলাদা একটি বর্ণমালা দাঁড় করানো কঠিন কাজ নয়, যদিও বাস্তবে তার কার্যকারিতা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়াই বিজ্ঞানসম্মত। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। মাত্র কয়েক হাজার (বা কয়েক লাখ) লোক তাদের মাতৃভাষাকে যতই ভালোবাসুক, সেই ভাষাকে বর্তমান বিশ্বে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ কতটা বাস্তবসম্মত, তা ভাবতে হবে। নতুন করে বর্ণমালা তৈরি করে বইপত্র ছাপিয়ে, সেই ভাষাকে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান বা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ কতটা আছে এবং সে জন্য সময়, শ্রম ও অন্যান্য বিনিয়োগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে বিষয়টিও গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।

কিছু খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থা পৃথিবীর সর্বত্র বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতির ভাষায় রোমান (ইংরেজি) বর্ণমালা প্রচলনের প্রয়াস চালিয়ে আসছে বহু শতাব্দী ধরে। বহু ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে। যেখানে রোমান বর্ণমালা চালু করা যাচ্ছে না, সেখানে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত কোনো বর্ণমালাকে পরিমার্জিত করে এসব ভাষায় বইপত্র ছাপার কাজে উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক ভাষাকে তালপাতার পাণ্ডুলিপির পর্যায় থেকে আধুনিক ছাপাখানার পর্যায়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এই খ্রিস্টান মিশনারিদের অতীত অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। আমাদের বাংলা ভাষায়ও প্রথম মুদ্রিত পুস্তক ‘হাহেডের ব্যাকরণ’ খ্রিস্টান মিশনারিদেরই অবদান। উপমহাদেশসহ এশিয়া-আফ্রিকার অধিকাংশ ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁরা অমূল্য অবদান রেখেছেন, যদিও মূলত খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও তা ছাপার তাগিদ থেকেই তাঁরা তা করেছেন। এখনো তাঁরা সেই ধারাবাহিকতায় কাজ করে যাচ্ছেন।

বর্তমান বিশ্বে যেসব ভাষায় এক লাখের বেশি মানুষ কথা বলে, তেমন ভাষার সংখ্যা হবে প্রায় এক হাজার ৩০০। এর বাইরে এক লাখের কম মানুষের ভাষা চিহ্নিত আছে কয়েক হাজার। যার অধিকাংশের কোনো লিপি নেই এবং সেসব ভাষায় লেখালেখিরও কোনো রেওয়াজ নেই। এ পর্যায়ের ভাষাগুলোকে endangered বা বিলুপ্তির ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।

অনেকে এসব ভাষাকে রক্ষা করার বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে থাকেন। একাডেমিক দৃষ্টিতে তা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, যুগে যুগে এ ধরনের বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে বা অন্য ভাষায় বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়েই কিছু ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে যুগের প্রয়োজন মেটাবার উপযোগী হয়েছে। পৃথিবীর সব বহুল প্রচলিত ভাষাই সে অর্থে সংকর ভাষা। সব জাতিও সংকর জাতি। কোনো ভাষা বা কোনো বৃহৎ জাতিসত্তাই এখন আর বিশেষ জনগোষ্ঠীর ভাষা বা জাতি নয়। একের ভেতরে সমন্বয় ঘটেছে অনেক সত্তার। বাঙালি জাতির কথাই ধরা যাক। আজ যারা বাংলায় কথা বলে এবং বাঙালি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, তারা কোনো সুনির্দিষ্ট নৃ-গোষ্ঠীর জাতক নয়। অস্ট্রালয়েড, আদি-অস্ট্রালয়েড, নিগ্রোয়েড, দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোল, চৈনিক, সেমেটিক, তুর্কিক, কোনো রক্তধারা কি তাতে মেশেনি? বাংলা ভাষায়ও কোনো ভাষার সংমিশ্রণ নেই?

যাই হোক, গত কয়েক শ বছরে পৃথিবীর সব বড় জনগোষ্ঠীর ভাষাই মোটামুটি প্রমিত রূপ নিয়েছে। প্রধান প্রধান ভাষার বর্ণমালার উন্নয়ন ও তা দিয়ে পুস্তকাদি মুদ্রণের কাজেও বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটেছে। বিশেষ করে আধুনিক ‘জাতিরাষ্ট্র’গুলো বিকশিত হওয়ার পর সব দেশেই এক বা একাধিক ভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত হয়ে সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। প্রতিটি জাতিই তার প্রধান ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে এর বিকাশ ঘটাতে এবং ব্যবহার বাড়াতে সচেষ্ট।

তা সত্ত্বেও আজকের পৃথিবীতে ইংরেজির দাপটে বাদবাকি প্রায় সব ভাষাই সংকটাপন্ন। ১৯৫২ সালে অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃৃতি আদায় করেছিলাম। কিন্তু তার পরও রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার ছিল প্রায় শূন্য। ষাটের দশকে সে জন্য আমাদের আবার লড়তে হয়েছে। বাংলায় দোকানপাট, অফিস-আদালতের সাইনবোর্ড লেখার জন্যও আন্দোলন করতে হয়েছে। আজকে অনেকে হয়তো শুনে অবাক হবেন, এই বাংলা ভাষার দেশে ভাষা আন্দোলনের ১০-১২ বছর পরে ষাটের দশকে এসেও সব সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে উর্দু ও ইংরেজিতে। এমনকি দোকানের ক্যাশমেমো থেকে শুরু করে বাসের টিকিট, রেলের টিকিট কোথায়ও বাংলার চিহ্নমাত্র ছিল না। সব কিছুতেই উর্দু ও ইংরেজি!

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও বর্ণমালা প্রসঙ্গে

এ জন্য ষাটের দশকে আমাদের ‘বাংলা প্রচলন আন্দোলন’ করতে হয়েছিল। এই আন্দোলনের সূচনা হয় চট্টগ্রামে, ১৯৬৩ সালে। আমি তখন চট্টগ্রাম আইন কলেজের ছাত্র। আমরা বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে ‘বাংলা প্রচলন আন্দোলন’ শুরু করি। দলবেঁধে বিভিন্ন অফিসে এবং দোকানপাটে পিকেটিং করে বাংলা ব্যবহারের দাবি জানিয়েছি। তাতে কিছু ফল পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখ্য যে রেলের টিকিটে এবং রেলস্টেশনের নামফলকে বাংলা সংযোজন। চট্টগ্রামে বাসের টিকিটও তখন থেকে বাংলায় হয়েছে। আমাদের পিকেটিং ও পথসভার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই তাঁদের দোকানের কাগজপত্র বাংলায় ছাপতে সম্মত হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সেই আন্দোলন হয়েছে ঢাকায়। একদিন আমরা শহীদ মিনারে জমায়েত হয়ে মশাল মিছিল নিয়ে বকশীবাজার হয়ে সদরঘাট দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করেছি। সবাইকে তাদের সাইনবোর্ড ও দোকানপাটের কাজকর্মে বাংলা ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছি। দুয়েকটি সাইনবোর্ড ভাঙাও হয়েছে। এর ফল হয়েছিল আশাতীত। জনগণ আমাদের ডাকে বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে। সবাই যাঁর যাঁর সাইনবোর্ড নামিয়ে নতুনভাবে লিখেছেন। এবারে শুধুই বাংলায়। সেই সঙ্গে সব গাড়ির নম্বর প্লেট বাংলায় বদলে গেল। এক সপ্তাহে ঢাকার চেহারাই পাল্টে যায়। সে এক অভূতপূর্ব আনন্দ!

স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে এই শহরে বাংলার ব্যবহার হয়েছে সব কিছুতেই। কেবল দোকানপাটের সাইনবোর্ডই নয়, নামকরণেও তার ছাপ পড়েছে। কিন্তু আজ? ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশ ভাষাপ্রেমে গদ গদ হলেও খোদ ঢাকা শহর থেকেই বাংলা ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। প্রায় সব সাইনবোর্ডই এখন ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। দীনহীন কিছু দোকানে কিছু বাংলা দেখা গেলেও কোনো কোনো এলাকায় শতভাগই শুধু ইংরেজি।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আমি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। মনে পড়ে তখন মিছিলে স্লোগান দিয়েছি, ‘রোমান হরফে বাংলা লেখা চলবে না।’ কারণ রোমান হরফে বাংলা লেখার একটা প্রস্তাব উঠেছিল। এখন বিনা প্রস্তাবেই মানুষ কম্পিউটার ও মুঠোফোনে বাংলা লেখে রোমান হরফেই, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম। ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ দুঃখিনীই থেকে গেছে।

১৬ কোটি মানুষের বাংলারই যখন এই দশা, তখন দুই-দশ হাজার কিংবা দুই-চার লাখ মানুষের ভাষার জন্য নতুন বর্ণমালার উদ্ভাবন ও এর প্রচলনের প্রয়াস বাস্তবে কতটা কাজে আসবে তা সংশ্লিষ্টদের হিসাব কষে দেখতে হবে। মাতৃভাষার প্রতি মমতা বা একাডেমিক উৎসাহ থেকে এটা করা হলে কাউকে বাধা দেওয়া যায় না। কোনো ভাষায় যদি আগে থেকেই বর্ণমালা এবং এর কিছু ব্যবহার থেকে থাকে, তাহলে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে তার একটা মূল্য থাকবে। কিন্তু অব্যবহৃত বা অজ্ঞাত একটি বর্ণমালাকে নতুন করে জীবন্ত করার জন্য যে তেল-খড় পোড়াতে হবে তার যৌক্তিকতা বিচার্য।

আশির দশকে বাংলা ইলেকট্রনিক টাইপরাইটার বা ওয়ার্ড প্রসেসর উদ্ভাবনের কাজ করার সময় আমি প্রায় ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছিলাম কয়েক বছর। তখন পৃথিবীর নতুন-পুরনো সব ধরনের লিপি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। লক্ষ করেছি, বাংলা বর্ণমালা অন্য অনেক বর্ণমালার চেয়ে তুলনামূলক অধিক ধ্বনি-বিজ্ঞানসম্মত। ণত্ববিধি-ষত্ববিধি ছাড়া বাংলা লিপি সম্পূর্ণরূপেই উচ্চারণানুগ। ইংরেজির মতো নয়। অপরদিকে ‘গভীর কণ্ঠ্য ধ্বনি’ ছাড়া সব ধ্বনি এতে যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায়। (লেখকের ‘বাংলা বর্ণমালার এনাটমি’ দ্রষ্টব্য)।

বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক ইলেকট্রনিক টাইপরাইটার বা ওয়ার্ড প্রসেসর ‘ক্যানন-দেশবাংলা’ বাজারে আসার পর একজন উৎসাহী চাকমা ভাষাপ্রেমী চাকমা ভাষার জন্য অনুরূপ একটি যন্ত্র বানিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের প্রযুক্তি অনেক জটিল ছিল। আজকের কম্পিউটার প্রিন্টিংয়ের মতো কেবল সফটওয়্যার পরিবর্তন করেই যেকোনো ভাষায় যাওয়া সম্ভব ছিল না। হার্ডওয়্যারেরও অনেক কাজ ছিল। বিশেষ করে ভিন্ন ভাষার জন্য সেই ভাষার বর্ণমালায় ‘ডেইজি হুইল’ বানাতে হতো। এই কাজটি ছিল খুবই দুরূহ ও ব্যয়সাপেক্ষ। সেটা তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি।

এ ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় বিচার্য। একটি অজ্ঞাত, বিলুপ্ত বা নতুন উদ্ভাবিত বর্ণমালায় নতুন করে বইপত্র ছাপার পর তা দিয়ে ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা সমাপ্ত করার পর কোথায় যাবে? তারা তখন কোন ভাষায় বা কোন বর্ণমালায় লেখাপড়া করবে? বাংলাদেশে আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ভাষায় লেখালেখি বাংলা বর্ণমালায় হতে পারে খুব সহজেই। বাংলা যেহেতু রাষ্ট্রভাষা, সেহেতু বাস্তব প্রয়োজনেই তাদের এই ভাষা শিখতে হবে। বাংলা বর্ণমালা দিয়েই আমাদের চাকমা, মারমা, সাঁওতালি ভাষার কিছু কবিতা বা গান দেখা যায়। যদি কথিত ৭০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৭০টি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণমালা উদ্ভাবন করতে হয়, তাহলে অবস্থা কেমন দাঁড়াবে? এসব বর্ণমালায় প্রাথমিক শিক্ষার পর ছেলেমেয়েদের আবার বাংলা স্কুলেই যেতে হবে, নয়তো ইংরেজি স্কুলে। তারা কি তিন বর্ণমালাই শিখবে?

চাকমা ভাষার জন্য একটা আলাদা বর্ণমালা প্রস্তাব করে এর জন্য একটা কম্পিউটার কি-বোর্ডের প্রস্তাবনা দেখলাম ইন্টারনেটে। দাবি করা হয় এটি আদি চাকমা ভাষার বর্ণমালা। কি-বোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি এই নতুন লিপির অক্ষর সাজানো হয়েছে। অতীতে যদি এসব ভাষার কোনো উৎসাহী পণ্ডিত ব্যক্তি কোনো একটি বর্ণমালা রপ্ত করে তা দিয়ে নিজ ভাষায় কিছু লেখালেখি করে থাকেন, কিন্তু সাধারণ্যে তা ব্যবহৃত না হয়ে থাকে, তাহলে ওই বর্ণমালাকে এখন জীবন্ত করে এর জন্য টাইপরাইটার বা কম্পিউটার তৈরি করা বাস্তবে কাজে আসবে বলে মনে হয় না।

আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা কি-বোর্ডেই হাত দিচ্ছে না। তারা ‘ফোনেটিক’ কি-বোর্ড দিয়ে ইংরেজি কি-বোর্ডে বাংলা লেখার চেষ্টা করে, যা দুই-চারটা শব্দের মধ্যেই সীমিত থাকে। আমাদের চাকমা ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি ভিন্ন বর্ণমালা ব্যবহার করে, তাদের মাতৃভাষায় লেখাপড়া করে অতঃপর বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজি বিদ্যালয়ে চলে যেতে হবে? সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিমণ্ডল থেকে তাদের একেবারেই দূরে সরিয়ে নেওয়া হবে না? তাতে কি তারা লাভবান হবে?

আমরা আগেই বলেছি, প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু একেবারেই ক্ষুদ্র কোনো নৃ-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া বাস্তবানুগ কি না তা সংশ্লিষ্টদের ভালো করে ভেবে দেখতে হবে। বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করলেই কেউ বাঙালি হয়ে যাবে না। যেমন ইংরেজি পড়লে কেউ ইংরেজ হয়ে যায় না। তবে নতুন প্রজন্ম একই ভাষায় লেখাপড়া করলে বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে সব নৃ-গোষ্ঠীর একটা অভিন্ন অবস্থান তৈরি হবে।

আবার সব লেখালেখি অভিন্ন বর্ণমালায় হলে বিভিন্ন জাতিসত্তার পারস্পরিক দূরত্ব কমে আসবে। আমাদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় বাংলা বর্ণমালা ব্যবহারে কারিগরি বা ভাষার ধ্বনিগত দিক থেকে কোনো সমস্যা লক্ষ করা যায় না। অতএব নতুন বর্ণমালা উদ্ভাবন বা অপ্রচলিত বর্ণমালা পুনরুজ্জীবনে শক্তি ক্ষয় না করে সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা সুবিধাজনক হওয়ার কথা। বিষয়টি সরকারকে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি আমাদের দেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয়দেরও ভাবতে হবে।

লেখক: রাজনীতিক, ভূরাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন