কাউন্টার টেরোরিজম

মেহেদী হাসান পলাশ 

বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বলতে আজকে যা বোঝায় তার শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদিচীর অনুষ্ঠানে বোমা হমলার মধ্যদিয়ে। এই হামলায় ১০ জন নিহত হয়। এরপর একে একে খুলনার কাদিয়ানী উপাসনালয়ে বোমা হামলা, পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে বোমা হমলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গির্জায় বোমা হামলা, কোটালী পাড়ায় বোমা হামলা, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা, বাগেরহাটের খলিলুর রহমান মাঠে বোমা হামলা উল্লেখযোগ্য। এসব বোমা হামলায় অসংখ্য লোক হতাহত হয়। এর সাথেই শুরু হয়ে যায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গীবাদী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রচারণা।
এরই এক পর্যায়ে ২০০০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন এক দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। সে সময় বাংলাদেশ সরকারের তথ্য, পররাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহায়তায় দুইটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন ও তার সহযোগী সফর সঙ্গী কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এ দুইটি বইয়ের নাম ছিল যথাক্রমে ‘Politices of Bangladesh: Democracy vs religious fundamentalism’ Ges ‘Fang of fantices’. ‘Politices of Bangladesh: Democracy vs religious fundamentalism’  নামক ২০ পৃষ্ঠার বইয়ের ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়  ‘The opposition poorly BNP and its fundamentalist alies have close contacts with Islamic radicals in clouding ‘Talibans’ of the Afganistan the reliant religious fanatics of Pakistan’.
বাংলাদেশ সরকার থেকে এ জাতীয় প্রচারণার পর প্রেসিডেন্ট কিনটন তার বাংলাদেশ সফর সংক্ষিপ্ত করেন ও সাভার স্মৃতিসৌধে যাওয়া বাতিল করেন। এরপর পর বিশ্বের নামকরা পত্রিকায় বিশেষ করে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় হিরন্ময় কার্লেকার, অরবিন্দু আদিগা, বার্টিল লিন্টনার বাংলাদেশকে নিয়ে শুরু করে ‘কুকুন অব টেরর’ , ‘নেক্সট আফগানিস্তান’, বি অয়্যার অব বাংলাদেশ’ জাতীয় প্রচারণা।

চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পরও এই ধারাবাহিক বোমা হামলা অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে সিলেটে এএসএম কিবরিয়ার উপর বোমা হামলা, আনোয়ার চৌধুরীর উপর বোমা হামলা, ময়মনসিংহের অজান্তা সিনেমা হলে বোমা হামলা, গাজীপুরের এমপি আহসান উল্লাহ মাস্টারের উপর বোমা হামলা উল্লেখযোগ্য। তবে সব ছাড়িয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি কর্তৃক সারা দেশে একযোগে ৬৪টি জেলায় বোমা হামলা দেশবাসীকে হতবাক করে দেয়। এর মধ্যে অনেকগুলো বোমা হামলার তদন্তে স্কর্টল্যান্ড ইয়ার্ড, এফবিআই ও  ইন্টারপোল টিম এসেছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশী মিডিয়াকে কিছু না বলেই তারা ফিরে যায়। চারদলীয় জোট সরকার শেষ দিকে জেএমবির প্রায় সকল শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার ও বিচার করে ফাঁসি দিতে সক্ষম হয় এবং ২০০৭ সালের ২৯ মে জেএমবির ৭ শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হলে বাংলাদেশ বোমা হামলা তথা জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের একটি অধ্যায় শেষ হয়ে যায়।

সে সময় বিশ্বের প্রায় সকল দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে। এরপর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের নাম জড়িয়ে বাংলাদেশ থেকে বেশকিছু পাকিস্তানী নাগরিককে গ্রেফতার করা হলেও প্রমাণের অভাবে তাদের প্রায় সকলেই আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। মহাজোট সরকার কঠোর জঙ্গীবাদ বিরোধী অবস্থান নেয়ায় এ সময় দেশে তেমন কোনো জঙ্গীবাদী কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এর মধ্যেই গত আগস্ট মাসে হঠাৎ করে দেশের তিনটি জেলা থেকে তিনটি জঙ্গী সংগঠনের নামে বেশ কয়েকজন দাড়ি-টুপিওয়ালা লোককে ভয়ানক অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। গত ১২ আগস্ট বরগুনার সদরের দক্ষিণ খাতুন তলার একটি বাড়িতে গোপন বৈঠকের সময় জঙ্গী সংগঠন আনছারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানী ও তার ৩০ জন সহযোগীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এই  গ্রেফতারের পর মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় জঙ্গীবাদের পুরুত্থানের খবর। এদিকে ১৫ আগস্ট ঝালকাঠির নলছিটি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জেহাদের (হুজি) নেতা মশিউর রহমানসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ খবরও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। অতঃপর ২২ আগস্ট বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া ইয়াছিন নগরের দেওয়ানবাড়ি থেকে জঙ্গি সংগঠন বিইএময়ের শীর্ষ কমান্ডার ছানাউল্লাহসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এই বিইএময়ের সদস্যের গ্রেফতারের সময় তাদের আস্তানা থেকে যেসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয় তা ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কোনো জঙ্গী সংগঠনের হাতে দেখা যায়নি। প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে বাংলাদেশে কেন এই জঙ্গীবাদী তৎপরতা?

অপরাধ বিজ্ঞানের সূত্র হলো কোনো অপরাধ থেকে অপরাধীকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রথমেই ভাবা হয় লাভবান বা উপকারভোগীকে। সে সূত্রে বাংলাদেশে বর্তমানে যে নতুন জঙ্গী তৎপরতা দেখা দিয়েছে তাতে কারা লাভবান হতে পারে তার বিবেচনা করাটা জরুরি।
সাদামাটাভাবে দেখলে মনে হতে পারে বর্তমান সরকারের ইসলাম বিরোধী কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ হয়ে কতিপয় ধর্মান্ধ লোক সরকার উৎখাতে এইপন্থা বেছে নিতে পারে। কিংবা যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচলের উদ্দেশ্যে, দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে জামায়াত-শিবির এই ধরনের জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িত হতে পারে। কিন্তু ঘটনার একমাস পার হলেও সরকার এমন কোনো প্রমাণ দেশবাসীর সামনে হাজির করতে পারেনি।
অন্যদিকে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী মনে করে একের পর এক ভুল কূটনৈতিক চালে একঘরে হয়ে পড়া মহাজোট সরকার পাশ্চাত্য তথা ইসলামবিরোধী শক্তির নৈকট্য তথা সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে নিজেই এই জঙ্গী নাটক বা জঙ্গী কার্ড খেলছে। বর্তমান ও অতীতের বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ ও ঘটনা বিশ্লেষণে এ যুক্তি অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। কিন্তু এখানেই কি শেষ?

ওদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দিকে তাকালে দেখা যায় ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটছে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মুসলিম দেশ সিরিয়া আক্রমণে বিপুল সমর শক্তি নিয়ে ভূমধ্য সাগরের পথে রওনা দিয়েছে। এর আগে একই শক্তি কর্তৃক ইরাক বা আফগানিস্তান আক্রমণের সময় মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিপুল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এ শক্তির অজানা নয়। কিন্তু আগস্টে বাংলাদেশে জঙ্গী আটকের পর সিরিয়ার বিরুদ্ধে পাশ্চত্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের বড় কোনো ডেমোনেস্ট্রেশন চোখে পড়েনি। এমনকি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে কমিউনিস্ট পার্টি যতটুকু প্রতিবাদ করেছে ইসলামপন্থীরা তাও করেনি। অর্থাৎ কয়েকজন জঙ্গীবাদীকে আটক করে বাংলাদেশের সাধারণ ইসলামপন্থীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে তাদের প্রতিবাদের ভাষা রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ ইতোপূর্বে বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত বিভিন্ন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে বহুবার বলা হয়েছিল বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসবাদ বা টেরোরিজম এক্টিভিটি নেই যা আছে তা হলো কাউন্টার টেরোরিজম।
বর্তমান জঙ্গীবাদী প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে অনুধাবনের আগে আমাদের টেরোরিজম ও কাউন্টার টেরোরিজম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। বিশেষ করে বাংলাদেশে যখন বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সক্রিয় উপস্থিতি বিদ্যমান তখন জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন থাকা খুবই জরুরি।

টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ
যখন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে একদল লোক বিভিন্ন সহিংস অপকৌশলের  মাধ্যমে  সাধারণ জনগণের মধ্যে আতংকের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাকে সন্ত্রাস বলা হয়। এক্ষেত্রে সহিংসতার বা সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটনের জন্য সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন  কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে। যেমন সফট টেরোরিজম, হার্ড টেরোরিজম ও সেমি হার্ড টেরোরিজম। ডান রাজনৈতিক মতবাদ  সম্বলিত  উদ্দেশ্য এবং বাম মতবাদ সম্বলিত উদ্দেশ্য- উভয় ধরনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে  রাজনৈতিক দলগুলো সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয় গ্রুপ রয়েছে তেমনি রয়েছে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনকারী গ্রুপ। এমনকি রয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রে অবস্থিত সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ বাহিনী  এবং সরকারি বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ বা সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা যারাও বিভিন্ন সময় ‘ন্যায়ের’ জন্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হচ্ছে। আবার কিছু কিছু সময় অন্যায়ভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে।

কাউন্টার টেরোরিজম
কাউন্টার সন্ত্রাস বা টেররিজম এমন এক ধরনের সন্ত্রাস যাতে রাজনৈতিক, অর্থগত, সংস্কৃতিগত, বুদ্ধিগত দিক প্রয়োগ করে উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে সশস্ত্রবাহিনী সমর্থিত কৌশল  অত্যন্ত সুশৃঙ্খল কর্মপদ্ধতি প্রয়োগ করে সন্ত্রাস নির্ভর কর্মকা- পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এভাবেই সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশের জনগণকে আতংকের মধ্যে রেখে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের কাউন্টার টেরোরিজম হার্ড, সেমি হার্ড ও সফট ধরনের হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কাউন্টার টেরোরিজমের মূলবৈশিষ্ট্য হল এই ধরনের কর্মকা-ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে আঞ্চলিক পর্যায়ে বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক যোগসাজশে বা আন্তঃ যোগাযোগ নেটওর্য়াকের মাধ্যমে কাজকর্ম করে থাকে। এছাড়া অনেক সময় কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকা-ে মাদকব্যবসায়ী বা মাফিয়া গ্রুপ ও সরকারের বিরোধী বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ গোপন আঁতাত করে যৌথভাবে তৎপরতা পরিচালনা করে থাকে।
এখানে বিভিন্ন ধরনের কাউন্টার টেরোরিজম এক্টিভিটি নিয়ে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

নৌ সন্ত্রাস
নৌ বা মেরিটাইম সন্ত্রাসী কর্মকা- মূলত সমুদ্রবক্ষে অবস্থিত সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। নৌ সন্ত্রাসের মূলবৈশিষ্ট্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিভিন্ন জলভাগও নৌ পরিবহনে আকস্মিক হামলা করে সাধারণ জনগণ বা রাষ্ট্রীয় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি ও লুটপাট করে। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও এ ধরনের সন্ত্রাস সংঘটিত হয়। এ ধরনের সন্ত্রাস বর্তমানে পূর্বের চেয়ে না কমে বরং বিস্তৃত হয়েছে।

মিডিয়া বা তথ্য সন্ত্রাস
মিডিয়া বা  তথ্য সন্ত্রাস এমন ধরনের সন্ত্রাস যে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিডিয়া তথ্য সন্ত্রাসে লিপ্ত থাকে। তারা মাঝে মাঝে সত্য-মিথ্যা তথ্য-প্রদান করে, বিকৃত তথ্য প্রদান করে, সময় মত সঠিক তথ্য প্রদান বা সম্প্রচার না করে সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে। অনেক সময় তথ্য সন্ত্রাসীরা টার্গেটকৃত লোকদের বিরুদ্ধে জনসমর্থন তৈরির লক্ষ্যে জন গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে।

গেরিলা সন্ত্রাস
গেরিলা সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সাবোটাজ, হয়রানির মত পদ্ধতি অনুসরণ করে। অনেক সময় সাধারণ মানুষ বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জিম্মি অথবা অপহরণ করে। অনেক সময় বোমা ফটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে থাকে। এভাবে কোন টার্গেটকৃত অঞ্চলের লোকদের উপর তারা গেরিলা হামলা করে থাকে। এক্ষেত্রে চোরা গোপ্তা হামলা বেশি হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশির ভাগ সন্ত্রাসীরাই গেরিলা সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য।

রাজনৈতিক সন্ত্রাস
রাজনৈতিক সন্ত্রাস ঘটার প্রধান কারণ নির্দিষ্ট টার্গেটপূর্ণ দেশের বিদ্যমান সরকারি অবকাঠামো পরিবর্তনের জন্য সন্ত্রাসীরা আতংকের পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে। রাজনীতির ভাষায় জন জীবনে রাজনৈতিক আতংকের পাশাপাশি  ক্ষমতাসীন সরকার এবং ক্ষমতার রক্ষক শাসকশ্রেণী যাতে শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে না পারে সেজন্য রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালানো হয়ে থাকে।

রাসায়নিক বা কেমিক্যাল সন্ত্রাস
রাসায়নিক সন্ত্রাস এমন এক সন্ত্রাস যে সন্ত্রাস সংঘটনের সময় রাসায়নিক অস্ত্র বা প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি সাধনে, মানুষকে আহত বা হত্যা করতে ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক অস্ত্রের মধ্যে বোমা আর্টিলারি শেল, বিমান থেকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোন কিছু স্প্রে’র মত ছিটিয়ে দেয়া, বিমান  হতে মিসাইলভিত্তিক শত শত বোমা ফেলা। এসব যুদ্ধাস্ত্র  প্রয়োগ মানবজাতির উপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এতে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু মানুষ অকালে মারা যেতে পারে।

নিউকিয়ার সন্ত্রাস
নিউকিয়ার সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য কিছু সন্ত্রাসী ভাড়ায় খেটে ভয়াবহ নিউকিয়ার বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। যা ব্যাপক মাত্রায় মানুষের শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস সাধন করতে পারে। বিশ্বের জনবহুল স্থানগুলোতে নিউকিয়ার যুদ্ধাস্ত্রের বিস্ফোরণ লক্ষাধিক লোকের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে  এবং গুরুতরভাবে নিরীহ মানুষ নিউকিয়ার সন্ত্রাসের কারণে আহত বা নিহত হতে পারে। নিউকিয়ার ডিভাইস দ্বারা জনবহুল অঞ্চলগুলোতে নিউকিয়ার বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। নিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য সন্ত্রাসের হুমকি থেকে সাধারণ মানুষের জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা বিধান খুবই কঠিন কাজ। অনেক সময় সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ‘খারাপ বা শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের’ মদদে নিউকিয়ার সন্ত্রাসের মত ভয়াবহ সন্ত্রাস করার সম্ভাবনা থাকে।

সাইবার সন্ত্রাস
সাইবার সন্ত্রাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সাইবার সন্ত্রাসীরা পারস্পরিক গোপন আঁতাতের মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর সাইবার হামলা করে থাকে। এক্ষেত্রে সাইবার সন্ত্রাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এক জায়গায় মিলিত হওয়ার  অশুভ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে। ১৯৯০ সাল থেকে সাইবার সন্ত্রাসীরা তথ্য প্রযুক্তি খাতে হামলা চালিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় তথ্য, আন্তর্জাতিক তথ্য এমনকি ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাকিং করে  গুরুত্বপূর্ণ তথ্য  নষ্ট করে দিচ্ছে, তথ্য  সংরক্ষণ ব্যবস্থারও ক্ষতি সাধন করছে। আবার অনেক সময় খুব খারাপ ভাইরাস কম্পিউটারে ছড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নষ্ট করে ফেলার পাশাপাশি কম্পিউটারের অভ্যন্তরীণ ডিস্ক বা উপাদানের ও  চরম ক্ষতি  বা  ধ্বংস সাধন করছে। যার ফলে পরবর্তীতে কম্পিউটারটি দীর্ঘদিনের জন্য ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

কৃষি সন্ত্রাস
সন্ত্রাস জগতে কৃষি সন্ত্রাস অভিনব এক আধুনিক সন্ত্রাস পদ্ধতি। ইংরেজিতে এগ্রো টেররিজমের আরেক নাম এগ্রি টেররিজম। মানুষ খাদ্য ছাড়া বাঁচে না। আর এ খাদ্যের যোগানদার কৃষি খাত। কৃষি সন্ত্রাসীরা কৃষি খাতের মাধ্যমে মানুষরা যাতে ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয় সেজন্য শস্যতে মানব ধ্বংসকারী রোগ ছড়ানোর অসুখের বীজ গোপনে শস্যের মধ্যে সুকৌশলে রেখে যায়। আবার পশুপাখির শরীর হতে নির্গত মারাত্মক রোগের জীবাণুযুক্ত বীজ  তারা সুকৌশলে কৃষি খাতে প্রবেশ করাতে চেষ্টা করে। এসব কৃষি সন্ত্রাস পদ্ধতি প্রয়োগ করে তারা সাধারণ মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করে যাতে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে, প্রতারণা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে।

ইকো টেরোরিজম
ইকো টেররিজমের আরো বহু নাম রয়েছে। ইকো টেররিজমকে পরিবেশগত সন্ত্রাস বলা যায়। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সরকার অথবা কোন সভ্য মানবসম্প্রদায়ের কাছ থেকে জোর করে কোন কুস্বার্থ হাসিলের জন্য একদল লোক কোন একক ব্যক্তি অথবা বিভিন্ন সন্ত্রাসী রাষ্ট্র চেষ্টা করে না পেয়ে মানবজগতের সবকিছু ধ্বংস করতে নিয়োজিত থাকে। এক্ষেত্রে পরিবেশ সন্ত্রাসীরা সরকারি বিভিন্ন সংস্থা অথবা কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস চালাতে এবং ক্ষতি করতে চেষ্টা করে। অনেক সময় সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বা কোম্পানি যাদের মূলত পরিবেশ রক্ষায় কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে, পরিবেশ সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন অপকৌশলে তাদের কাজে বাধা দেয়, কাজে হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে অনেক সময় সরকারি সংস্থাগুলো ঠিকমত কাজ করতে পারে না। ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

সাইকো বা মানসিক সন্ত্রাস
সাইকো বা মানসিক সন্ত্রাস চালানোর সময় বহুমাত্রিক, বিধি ও প্রথাগত বিভিন্ন কৌশলের প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে একক বিশিষ্ট ব্যক্তি, সমাজ অথবা রাষ্ট্রের মানসিক জীবন এবং স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। সাইকো সন্ত্রাসীরা মানসিকভাবে সন্ত্রাসী অপারেশন চালানোর জন্য মানসিক বিজ্ঞানের সকল কৌশল প্রয়োগ করে।

জীবাণু সন্ত্রাস
জীবাণু সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে এই সন্ত্রাসে নিয়োজিত সন্ত্রাসীরা  আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে মারাত্মক মানববিধ্বংসী রোগ জীবাণু ছড়িয়ে মানুষের ক্ষতি করতে চেষ্টা করে। এসবের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা টক্সিন ছড়িয়ে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী মানব সমাজের স্বাভাবিক সুখী  জীবনের ব্যঘাত ঘটিয়ে চরম ক্ষতি করতে পারে।

অর্থনৈতিক সন্ত্রাস
রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অনেক দেশের রাজনৈতিক নেতারা আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর যোগসাজশে মানি লন্ডারিংয়ের  মাধ্যমে অর্থপাচার করে আর্থিক সন্ত্রাস করে থাকে।  অর্থনৈতিক সন্ত্রাস সাধারণত সরকারি-বেসরকারী  প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। কোন টার্গেটপূর্ণ সমাজ বা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মাধ্যমে ক্ষতি করার জন্য এবং মানুষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসীরা অর্থনৈতিক সন্ত্রাস চালিয়ে থাকে। এই ধরনের অবস্থাই অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের মূল  বৈশিষ্ট্য।
এছাড়াও সন্ত্রাসের আরো অনেক পন্থা রয়েছে যা স্থানাভাবে এখানে আলোচনা সম্ভব নয়। কাউন্টার টেরোরিজমের একটি জলন্ত দৃষ্টান্ত হতে পারে বাংলাদেশী ছাত্র কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিস। পেন্টাগনের স্ক্রিনিং ও মার্কিন এমবেডেড সাংবাদিকতার বেড়া ডিঙিয়ে নাফিসের যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংকে বোমা হামলা চেষ্টার কারণ সম্পর্কে যে ভাষ্য পাওয়া গেছে তা হলো নাফিস প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথ খুঁজছিল। সে সময় মার্কিন স্টিং অপারেশনের অপারেটরদের খপ্পড়ে পড়ে যায়। অপারেশন স্টিংয়ের অপারেটররা নাফিসকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকে আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে আত্মহন্তারক হতে উৎসাহিত করে। তারাই তাকে ওঝা হয়ে অর্থ, প্রযুক্তি, লজিস্টিক সাপোর্ট ও নকল বিস্ফোরক সরবরাহ করে এবং সঠিক সময়ে সর্প হয়ে দংশন বা গ্রেফতার করে। প্রশ্ন হচ্ছে নাফিস যদি স্টিং অপারেশনের খপ্পড়ে না পড়তো তাহলে আত্মহত্যার জন্য যে কীটনাশক পান, গলায় দড়ি, গাড়ির নীচে ঝাঁপিয়ে পড়া, ছাদ থেকে লাফ দেয়া বা এই জাতীয় পন্থা বেছে নিত। সন্ত্রাসী হতো না। তাকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে মার্কিন সরকার, গ্রেফতার করেছে মার্কিন সরকার, বিচারও করছে মার্কিন সরকার। এ জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরাই বলছেন, ‘দ্য কান্ট্রি মেড হিম অ্যা টেরোরিস্ট অর্থাৎ রাষ্ট্রই তাকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে। স্টিং অপারেশন কাউন্টার টেরোরিজমের একটি পন্থা।

বাংলাদেশ ইতোপূর্বে যত সন্ত্রাসী ঘটনা ধরা পড়েছে তার প্রত্যেকটির সাথে কোনো না কোনোভাবে বিদেশী সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সকল সরকার শুধু নিজ দেশের নাগরিকদেরই বিচার করেছে বিদেশী শক্তিগুলোর দিকে আঙুল তুলতে সাহস পায়নি। ভারত প্রতিনিয়তই বলে থাকে তার দেশের উত্তরপূর্বাংশের বিদ্রোহীরা বাংলাদেশের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কখনোই বলতে পারেনি যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী ইউপিডিএফ, জেএসএস’র সন্ত্রাসীদের, জেএমবি’র জঙ্গীরা ভারত থেকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ ও আশ্রয় দিয়েছে ও দিচ্ছে।
কাজেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদ বা সন্ত্রাসীরা যে কাউন্টার টেরোরিজমের প্রডাক্ট কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখতে হবে।
Email:[email protected]

সৌজন্যে: দৈনিক ইনকিলাব

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

2 Replies to “কাউন্টার টেরোরিজম”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন