কাউখালী থেকে মানিকছড়ি : একের পর এক থানায় অগ্নিকাণ্ড: বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট নাকি নাশকতা

1511436_497372200376574_1003350326_n

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট :

রাঙ্গামাটির কাউখালী থেকে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি। দিনের পর দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে পাহাড়ের থানা গুলো। পরপর দুটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা পাহাড়ের সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট নাকি পরিকল্পিত কোন নাশকতার ঘটনা। এভাবে একের পর এক থানা পোড়ার ঘটনা পাহাড়ে ইতোপূর্বে আর দেখা যায় নি। সচেতন পার্বত্যবাসীর মনে প্রশ্ন, কী এমন পরিবর্তন ঘটেছে পাহাড়ে যে জন্য একেরপর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে?

রাঙামাটির কাউখালী থানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মাত্র এক মাস ১২ দিনের মাথায় গত বুধবার (১৮ নভেম্বর) খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থানায় অগ্নিকান্ডের পর এমন অভিযোগ জোরালো হচ্ছে। গত ৫ নভেম্বর মঙ্গলকার বিকালে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় রাঙ্গামাটির কাউখালী থানা ভবন। আর ১৮ ডিসেম্বর বুধবার সকালে একই নিয়মে পুড়েছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থানা ভবন। কিছুই রক্ষা করা যায়নি। এতে দুই থানায় সরকারী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকারও বেশী। আর কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা হয়েছে নি:স্ব। কেউ বাঁচাতে পারেনি তাদের বেতন-ভাতাদির টাকা-পয়সা কিংবা নিত্য ব্যাবহার্য্য জিনিস-পত্র। পুড়ে গেছে সরকারী-বেসরকারী অস্ত্র-শস্ত্র ও থানার মুল্যবান কাগজপত্রও।

খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়েছে অন্তত ৬৩টি অস্ত্র ও ৪৮৪০টি বুলেট। আর রাঙ্গামাটির কাউখালীতে পুড়েছে ১২টি অস্ত্র আর ২০০ বুলেট। খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে পুড়ে যাওয়া সরকারী অস্ত্রের মধ্যে এলএমজি ২টি, এসএমজি ৫টি, চাইনিজ রাইফেল ২৮টি, শর্টগান ৫টি, স্থানীয় জনগনের জমা দেয়া অস্ত্রের মধ্যে একনলা বন্ধুক ১৮টি, দুইনলা বন্ধুক ১টি ও রিভলবার ১টি এবং সেনাবাহিনীর উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে এলজি ২টি ও কাটাবন্ধুক ১টি রয়েছে বলে পার্বত্যনিউজকে জানিয়েছেন সহকারী পুলিশ সুপার (রামগড় সার্কেল) মো: শাহজাহান হোসেন।

অন্যদিকে রাঙ্গামাটির কাউখালীতে পুড়ে যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১০টি রাইফেল, ১টি শর্টগান ও ১টি গ্যাস গান। ১ মাস ১২ দিনের ব্যবধানে পুড়ে গেছে পার্বত্য জনপদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত দুই থানা ভবন। গেল মাসের ৫ তারিখ বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে কাউখালী থানা ভবনে অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত হয়। সেদিন কাউখালী থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যের মধ্যে বেশীর ভাগই ১৮ দলীয় জোটের ডাকে হরতালের ডিউটিতে থাকায় ঘটনার সময় থানার নিরাপত্তা চৌকিতে ডিউটিরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছাড়া পুরো থানাই ছিল ফাঁকা।

ঠিক এমনই ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঘটেছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থানার বেলায়ও। গত ১৮ ডিসেম্বর সকাল পৌনে সাতটার দিকে অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত হয়। আর তখনও বিরোধী জোটের ডাকে অবরোধের ডিউটিতে থাকায় ঘটনার সময় থানার নিরাপত্তা চৌকিতে ডিউটিরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছাড়া পুরো থানাই ছিল শুণ্য। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির দুই থানা ভবনে আগুন লাগার ঘটনার জন্য পুলিশ বিভাগ থেকে বৈদ্যুতি শর্টসাকিটকে দায়ী করা হলেও এর পেছনে অন্যকোন রহস্য লুকিয়ে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে বলে মনে করছেন পাহাড়রে সচেতন মহল। তাদের অনেকের মতে অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে ‘বৈদ্যুতিক শর্টসাকিট’ থেকে সুত্রপাত হয়েছে বলে চালিয়ে না দিয়ে বরং খতিয়ে দেখা উচিত এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কারো স্বার্থের যোগসুত্র আছে কিনা। দুই জেলার দুই থানায় সংগঠিত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ‘একই সুত্রে গাঁথা কোন পরিকল্পিত নাশকতার ঘটনা’ নাকি ‘স্রেফ বৈদ্যুতিক শর্টসাকিট’ তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। আর তা করা না হলে ভবিষ্যতে বারবার এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পরে। এভাবে পাহাড়ের থানাগুলো ও সেখানে কর্মরত পুলিশের অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। আর তখন সেসব ঘটনা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে এমন কথাও মনে করছে বিভিন্ন সচেতন মহল।

এ ক্ষেত্রে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সচেতন পার্বত্যবাসী পার্বত্যনিউজকে বলেন, সম্প্রতি পুলিশ প্রশাসন থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন থানায় উপজাতীয় পুলিশ বদলী করা হয়েছে- যা অতীতে কখনো ছিল না। এরপর থেকে একের পর এক এই থানা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। কাজেই বিষয়টি কাকতালীয় না এর সাথে কোন নাশকতা পরিকল্পনা রয়েছে তা খতিয়ে দেখা জরুরী। তাদের মতে, শান্তিচুক্তির আওতায় প্রায় ৭ শতাধিক শান্তিবাহিনীর অস্ত্র সমর্পনকারী সদস্যকে পুলিশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালেও যেসব উপজাতীয় তরুণ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে তাদের একটা বড় অংশ ছাত্রজীবনে শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্রশাখার সাথে জড়িত ছিল। কাজেই সেসকল পুলিশ সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিংএ গিয়ে তাদের পুরাতন সহযোদ্ধাদের সাথে হাত মিলিয়ে এ ধরণের নাশকতার সাথে জড়িত হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরী। পুলিশ প্রশাসনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অকার্যকর করে দেয়া, এর পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে।

এদিকে দুটি ঘটনায় খতিয়ে দেখলে প্রকৃতিগত মিল পাওয়া যায়। কারণ দুটি ঘটনায় ঘটেছে রাতে এবং যখন বেশিরভাগ পুলিশসদস্য থানার বাইরে অবস্থান করছিল। ফলে আগুন নেভাতে না পারায় বেশিরভাগ অস্ত্র ও গোলাবারুদ পুড়ে গেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সকল গোলাবারুদ ও অস্ত্রই কি পুড়ে গেছে নাকি কিছু পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারণ পুড়ে গেলে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংখ্যা মেলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে অতীতে চাকমা পুলিশ কর্তৃক পুলিশের অস্ত্র ও গুলি শান্তিবাহিনীর কাছে পাচার ও বিক্রির অনেক অভিযোগ রয়েছে। বছর দুয়েক আগে ঢাকারে রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের মালখানা থেকে অস্ত্র ও গুলি শান্তিবাহিনীল সদস্যদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে দুই চাকমা পুলিশ হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। ফলে এসব ঘটনা বিশ্লেষণে সচেতন পার্বত্যবাসী ধারাবাহিকভাবে থানা পোড়ার ঘটনাকে জোরালো তদন্ত করে দেখার দাবী জানিয়েছে। একইসাথে উপজাতীয় পুলিশ সদস্যদের পার্বত্য এলাকায় মোতায়েনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “কাউখালী থেকে মানিকছড়ি : একের পর এক থানায় অগ্নিকাণ্ড: বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট নাকি নাশকতা”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন