আলীকদমে তামাক প্রক্রিয়াজতে লাকড়ি পোড়ানোর মহোৎসব
মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম (বান্দরবান):
পার্বত্য জেলা বান্দারবানের আলীকদম উপজেলাজুড়ে এখন তামাক প্রক্রিয়াজাতের (পোড়ানোর) মহোৎসব চলছে। শত শত তামাক চুল্লিতে আইন অমান্য করে গাছ কেটে পোড়ানো হচ্ছে জ্বালানী। তামাক পোড়ানোর উৎকট গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠে পাড়াপল্লী। ১৯৮৩ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ কৃষি জমি দখল করে নিয়েছে সর্বগ্রাসী তামাক চাষ। তামাকের রাহুগ্রাসে উপজেলায় খাদ্যফসল ও রবিশস্য উৎপাদনে ধস নেমেছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর আলীকদমের কৃষি জমিতে তামাক চাষের ভয়াল বিস্তৃতি ঘটলেও ক্ষতিকারক এ চাষ থামানোর কোন উদ্যোগ নেই। মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী উর্বর জমি ও নদীর বুকেও তামাকের আগ্রাসন চলছে। নদীর তীর ও বুক দখল করে তামাক চাষ হলেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। এ উপজেলায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, আবুল খায়ের টোবাকো, ঢাকা টোবাকোসহ বেশ কটি কোম্পানী তামাক চাষ বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। এসব কোম্পানীর কর্মকা-ের বিষয়ে রাজনৈতিক সংশ্রব ও প্রশাসনের রহস্যজনক নির্লিপ্ততা রয়েছে বলে সচেতন মহলের দাবি।
তামাকের উৎপত্তিস্থল
তামাকের ইংরেজি `tobacco’ (টোব্যাকো) এসেছে স্প্যানিশ “tobacco” (টাবাকো) শব্দ থেকে। ধারণা করা হয় এই শব্দটির উৎপত্তি আরাওয়াকান ভাষা থেকে। তামাক গাছের আদি নিবাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়। তামাক গাছের শুকানো পাতাকে তামাক বলা হয়। তামাক গাছ ১২-১৮ ইঞ্চি লম্বা হয়। তামাক নেশাদায়ক পদার্থ। তামাকের মূল নেশাদায়ক উপাদান নিকোটিন এক প্রকারের স্নায়ুুবিষ (নিউরোটক্সিন), যা একধরণের অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টরের (কোলিনার্গিক অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টর) উপর কাজ করে। কিন্তু তামাকের ধোঁয়াতে নিকোটিন ছাড়াও নানা ক্যান্সারপ্রদায়ী পদার্থ থাকে, যেমন বেঞ্জোপাইরিন ইত্যাদি বহুচক্রী আরোমাটিক যৌগ। তামাক অত্যন্ত বিশাক্ত পদার্থ, একখানি সিগারেটে যতখানি তামাক আছে তা চিবিয়ে খেলে পুরপুরি শরীরে যদি প্রবেশ করত, তা থেকে দ্রুত মৃত্যু অনিবার্য। তবে ধুমপানের ফলেও ধীরে ধীরে আয়ুু কমে আস্তে থাকে- শুধু ক্যান্সারের প্রবণতার জন্যেই নয়, হৃদরোগের জন্যেও বটে।
আগ্রাসন শুরু যেভাবে
জানা গেছে, পার্শ্ববতী লামা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ১৯৮৩ সালে অল্প পরিমান জমিতে তামাক চাষ শুরু হয়। এর পরের বছরই (অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে) ছড়িয়ে পড়ে লামা উৃপজেলার ৭টি ইউনিয়ন লামার পাশ্ববর্তি আলীকদম, নাইংছড়ি উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়ার বিভিন্ন এলাকায়, দীর্ঘ আড়াই যুগ ধরে স্থানীয় সংরতি এবং অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চলের মূল্যবান বৃ নিধন এবং কৃষকের বাড়ির আঙিনার মূল্যবান বনজ এবং ফলদ গাছ নিধন করে পোড়ানোর কারণে বর্তমানে পাহাড় গুলো বৃশূণ্য মুরুভূমির দ্বার প্রান্তের।
বিরান হচ্ছে বনভূমি:
স্থানীয় চাষীরা জানায়, প্রতিটি তামাক চুলিতে প্রায় ৪শ’ মন লাকড়ীর প্রয়োজন পড়ে। সে হিসাবে আলীকদমে ৫ শতাধিক তামাক চুলিতে চলতি মৌসুমে প্রায় ২ লক্ষ মণ জ্বালানী কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। প্রতিমন জ্বালানী কাঠ ৮০ টাকা মণ হিসাবে যার স্থানীয় বাজার মুল্য ১৬ লক্ষ ৪০ ল টাকা। তামাক প্রক্রিয়াজাত করণের কাজে স্থানীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করার পাশাপশি কৃষকের বাড়ির আঙিনার মূল্যবান বনজ গাছের পাশাপশি আম ও কাঁঠাল গাছগুলোও তামাক চুল্লির খোরাক হয়ে আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হচ্ছে। নির্বিচারে তামাক চাষ ও তামাক চুল্লিতে লাকড়ি পোড়ানোর ফলে এখানকার সবুজাভ প্রকৃতি চরম হুমকীর সম্মুখীন হচ্ছে। এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ, পাহাড়-মাটি, নদী-খাল ও প্রাণীবৈচিত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
প্রতিবছর মাতামুহুরী নদীর চরাঞ্চলের উর্বর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। উৎপাদিত হাজার হাজার মণ তামাক কিউরিং করতে আশেপাশের পাহাড় কেটে লাকড়ি সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে এলাকার সবুজ প্রকৃতি। তামাক চাষ পরবর্তী উতপাদিত তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে (পোড়াতে) চাষীরা হাজার হাজার টন লাকড়ি পুড়িয়ে ধ্বংস করছে বনজ সম্পদ। এতে শ্রেণী ও অশ্রেণীভুক্ত বনভূমির হাজার হাজার টন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর।
(আগামীকাল পড়ুন : আলীকদমে তামাকের কবলে রবিশস্য ও ধানি জমি)