আমলারা প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না- অনশনে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ
স্টাফ রিপোর্টার:
সরকার শুধু আমাদের বগি দিয়ে বলছে পার্বত্য চুক্তির ৭০ ভাগ সম্পাদিত হয়েছে কিন্তু যেটি দিয়ে গাড়ী চালনা করা যাবে সেই ইঞ্জিন অর্থাৎ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোই অবাস্তবায়িত রয়েছে। `পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবিতে’ বুধবার এক প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে সভাপতিত্বকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি ও সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের যৌথ আয়োজনে আজ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই প্রতীকী অনশন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এসময় গৌতম দেওয়ান আরো বলেন, ‘আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসীরা আজ ঢাকায় এসে কেন এই ধরনের কর্মসূচী করছি এটা সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। আমরা মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করতে হলে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। সরকার চুক্তি বিষয়ে যেসব হিসেব দিচ্ছে তা ভুল এবং তা আমরা মানি না। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ সমন্বয় না করেই একছত্র সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলেও তিন অভিযোগ করে’। এছাড়াও সমতলের ভূমি কমিশন গঠনসহ উপজাতিদের অধিকারের প্রতিশ্রুসমূহ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
প্রতীকী অনশন চলাকালীন সময়ে কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিরুপা দেওয়ান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার চেয়ারম্যান মনি চাকমা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন, বিশিষ্ট নারী নেত্রী খুশী কবীর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমা, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, রাঙ্গামাটি বিলাইছড়ি উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শ্যামাবতী চাকমা, প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বকুল, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান ক্যায়বামং মারমা, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের সভাপতি অলীক মৃ প্রমুখ।
প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ সভাপতি শক্তিপদ ত্রিপুরা এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য রিপন চন্দ্র বানাই।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে ১৮ বছর হয়ে গেছে কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী চুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেই তিনি চুক্তি বাস্তবায়নের অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমান মহাজোট সরকার চালাচ্ছে আমলারা এবং এরাই প্রধানমন্ত্রীকে পার্বত্য চুক্তি ও আদিবাসীদের বিষয়ে ভুল বুঝিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন হতে দিচ্ছে না’।
তিনি আরো বলেন, আজকে সরকারের মধ্যেই ব্যাংক ডাকাত, ভূমিদস্যু, সাম্প্রদায়িক শক্তিরা লুকিয়ে আছে। সরকারের অনেক মন্ত্রী, এমপিরাও ভূমি দখলসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ করেন।
তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন ও সমতলের উপজাতিদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান।
এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নকে বিলম্বিত করে সরকার আদিবাসীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিচ্ছে। সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দিন বদলের সনদে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত আদিবাসীদের দিন বদল হয়নি’। সর্বোপরি চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারের টালবাহানা প্রতারণার শামিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
খুশী কবীর বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাক বাহিনী এদেশের আপামর জনসাধারণের সাথে যা করেছে তা আজ আমরা এদেশের আদিবাসী জনগণের সাথে করছি। এটি কখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশকে সাজাতে হলে এদেশের আদিবাসী মানুষদের অধিকার ও তাদের মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে’।
অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিচালিত করছে সামরিক আমলারা আর সারাদেশকে বেসামরিক আমলারা পরিচালিত করছে। যতদিন এ আমলারা দেশ পরিচালনা করবে ততদিন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হবেনা’।
তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমলাদের উপর নির্ভরতা কমিয়ে রাজনৈতিকভাবে দেশকে পরিচালনা করুন। তিনি সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের সমালোচনা করে বলেন এটি প্রত্যাহার করে এ দেশকে সকলের দেশে পরিণত করতে হবে। সমতলের উপজাতিদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশনসহ পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনেরও দাবি জানান।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘আদিবাসীদের অধিকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন সমতলের ভূমি কমিশন গঠন ইত্যাদি বিষয়ে আর সরকারের টালবাহানা করা উচিত হবে না। আজকের এই প্রতীকী কর্মসূচিকে সরকারকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে’। চুক্তি করার সময়ে যেভাবে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল ঠিক সেই রকম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আয়োজনের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন আদৌ হবে কিনা এই শঙ্কায় এখন মনে জাগে। তা না হলে একটি চুক্তি ১৮ বছরেও কেন বাস্তবায়ন হবেনা। পাহাড়ের আদিবাসী মানুষকে সংখ্যালঘু করে সেখান থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্ত চলছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরো বলেন, সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সারাদেশে আদিবাসী উচ্ছেদ চলছে। সমতলের প্রত্যেক আদিবাসী গ্রামে আজ ভূমি দস্যুরা ঢুকে পড়েছে। যে অবস্থা দাড়িয়েছে তাতে করে আগামী ২০ বছর পরে আদিবাসীদের হাতে ১ শতক করেও জমি থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। তিনি অবিলম্বে সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ সংসদে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের দাবি জানান’।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘শুধু মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে পার পাওয়া যাবেনা। ৭২ এর সংবিধানের পূর্নাঙ্গ পুনস্থাপন এবং এদেশের গরীব খেটে খাওয়া শ্রমিক আদিবাসী মানুষের অধিকার প্রদান সম্ভব হলে তবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা দাবি করা যাবে। পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে তিনি বলেন, মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত রেখে শতাংশের হিসেব দিয়ে আদিবাসী মানুষের সন্তুষ্টি আদায় করা যাবে না’।
নিরুপা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার কারনে দিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ছে। তাই দ্রুত চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করে অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়ানোর জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
রাঙ্গামাটি বিলাইছড়ি উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শ্যামাবতী চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামে বিভিন্ন উন্নয়নের নামে সরকার জুম্মদের জমি দখলে নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ী এলাকা থেকে জুম্মরা উচ্ছেদ হয়ে যাবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দাবি না মেনে পার্বত্য এলাকায় কোন উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পার্বত্য এলাকা বিষয়ে ভুল তথ্যের উপর আছে। এভাবে যদি বছরের পর বছর চলতে থাকে তা হলে আমাদের এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পরবে। তখন একটা অরাজকতার সৃষ্টি হবে।
সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ সভাপতি শক্তিপদ ত্রিপুরা বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দখলকৃত জমি ফিরিয়ে দিন। আপনার দ্রত পাবর্ত্য চুক্তি বাস্ত বায়ন করেন তা না হলে আমরা আবারো অস্ত্র হাতে নিবো। প্রয়োজনে আমরা আবার অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবো। তখন সরকারকে অনেক মূল্য দিতে হবে। সরকার অনেকটা আমাদের অগণতান্ত্রিক আন্দোলনে যেতে বাদ্ধ করতেছে।
বর্ষীয়ান রাজণীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রতীকী অনশন কর্মসূচির সভাপতি গৌতম দেওয়ানকে জল খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে অনশন শেষ করেন এবং অনশন চলাকালীন বক্তব্যের মাঝে মাঝে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট উপজাতি সঙ্গীত শিল্পী কালায়ন চাকমা ও উপজাতি কালাচারাল ফোরামের শিল্পীবৃন্দ।