আমরা বিপ্লবের পোড়া লাশ, আমাদের বাঁচান

ওমর ফারুক শামীম:

আমাদের মুক্তি দিন, আমাদের মুক্তি দিন। আমরা অসহায় বড়োই অসহায়। আমরা বিপ্লবের পোড়া লাশ, অভাবের আর্তনাদি বঞ্চিত মানুষ।

জানেন? আমাদের কিচ্ছু বলতে কিচ্ছু নেই। আমরা সমতলের নদীভাঙ্গা, উজানের খরস্রোতের তীব্রতা আর চন্দ্র-সুর্যের জোয়ারভাটা আমাদের সর্বস্ব বিলীন করেছে। আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিলো না বলেই আমরা জিয়া সরকারের ডাকে পাহাড়ে এসেছি। এতো আমাদের বাংলাদেশ। যে দেশ আপনারা আমরা সকলেই যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছি।

একসাগর রক্তের কেনা দামে অর্জন করছি। এদেশ আমাদের সকলের। আমরাতো আপনাদেরই স্বদেশি ভাই। আমরা ভুমিহীন, আমরা বিত্তহীন, আমরা অস্বচ্ছল। আমাদের দয়া করুন, আপনাদের পাশে রাখুন। আমাদের ভালোবাসুন। আমাদের ফিরে যাবার কোন পথ নেই, কোন ব্যবস্থা নেই।

বিশ্বায়নের এ যুগে দুরে-কাছে, কাছে-দুরে সবইতো একই পরিমন্ডলে। আমরা হতভাগা, অভাগা, দুর্ভাগা এ মানুষগুলো কোথায় যাবো, বলুন? দয়া করে আপনাদের পাশে রাখুন।

আমরা নিরক্ষর, খেটেখাওয়া অসহায় দিনমজুর, চরম অভাবি মানুষ। আমরা ১৯০০ সালের হিলট্রাক্ট ম্যানুয়েল জানি না, সরকারের ভালোমন্দ সিদ্ধান্ত এসব জানার কোন যোগ্যতাই আমাদের ছিলো না। আমরা নিরাপরাধ, আমাদের অপরাধী করবেন না, আমরা আপনাদেরই ভাই।

আরো কিছু কথা বলি শোনেনঃ
১৯৭৯/৮০/৮১ থেকে ৮৪ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে তৎকালীন সরকারের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলাকালেই যারা এখানে থাকার অযোগ্য ছিলো তারা পালিয়ে চলে গেছে। ম্যলেরিয়ায় মৃত্যু, অনভ্যস্ত জীবন ব্যবস্থা, চিকিৎসার অভাব, খাদ্যসংকট, ক্ষোভের আগুন- দ্বন্দ্বের আগুন, বিপ্লবের পোড়া লাশ হয়ে বারুদের গন্ধে আমরাই থেকে গেছি।

কেন জানেন? আমাদের ফিরে যাবার কোন পথ ছিলোনা। আমরা যেমন ক্ষোভের দ্বন্দ্বে পুড়েছি আপনারাও পুড়েছেন। লাভক্ষতির হিসাবে উভয়েই সমান।

আবারো বলছি যারা ফিরে যাবার তারা তখনি ফিরে গেছে। আমাদের ফিরে যাবার কোন অবলম্বন নেই। প্লিজ আমাদের পাশে রাখুন। সুখে সম্প্রীতিতে থাকতে দিন।

ক্ষোভের আগুন, বারুদের বর্ষন, খুন, অপহরণ কোন কিছুইতো আমাদের সরাতে পারেনি। কারন আমরা নিরুপায়-অসহায়। আমাদের ফিরে যাবার অবলম্বন নেই।

জানেন? আপনাদের আমাদের ক্ষোভকে পুঁজি করে এখানে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা হয়? দেশি- বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরাও তাদের স্বার্থ হাসিল করে। কয়েকটি প্রতিবেশি দেশ ভৌগলিক কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তাদের দেশের স্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে সুযোগ নেয়।

এখানে বেশকটি জাতিস্বত্তার বসবাসের সুযোগে বিদেশি ষড়যন্ত্রকারিরা অনায়াশে তাদের হীন কর্ম করতে সফল হয়। আমরা নিরীহ সহজ সরল পাহাড়ি বাঙ্গালীরা বরাবরই ঘটনার শিকার হই। সর্বস্ব হারাই, কখনো স্বজন হারাই, কখনো বসতি হারাই। কখনো বাগান হারাই, কখনো কষ্টার্জিত সম্পদ হারাই। এভাবে আর কতো?

রাষ্ট্রের ভূল সিদ্ধান্ত বা সঠিক সিদ্ধান্ত আমরা কোনটির জন্যই দায়ি নই। আমরা আর বলির পাঁঠা হতে চাই না। অধিকার বলেন আর স্বাধিকার বলেন, যে কোন আন্দোলন গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হোক। তাতে সকলের সমর্থন থাকবে।

সশস্র তৎপরতা, খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ এসবতো অনেক হয়েছে। স্বাধিকার আর অধিকার কতোটুকু অর্জিত হয়েছে বা হয়নি তার সবই এখন দৃশ্যমান। যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর যারা আন্দোলনের জন্য চাঁদা দিচ্ছেন তাদের জীবনযাপনের চিত্র এখন সাধারণ পাহাড়ি বঙ্গালি সকলের কাছেই দৃশ্যমান।

চারদশক যাবত চাঁদা প্রদানকারীরা বনের লতাপাতা খেয়েই বেঁচে আছে। আর যারা আন্দোলনের নামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর অস্রেরমুখে চাঁদা নিচ্ছেন তারা দেশে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। আবার অধিকার স্বাধীকারের তৃষ্ণা ধরে রাখতে সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দের সুবিধাগুলিও তৃণমূলের পাহাড়িদের দিচ্ছেন না। বিশেষ অধিকারে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি কিংবা নেতানেত্রিদের স্বজন পরিজনেই ভাগ বাটোয়ারায় লুটে নিচ্ছেন। এভাবে আর কতো?

চার দশকতো পার হতে চললো। চাঁদার রাজ্যের ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্বে গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হলেন। তাহলে কি স্বাধিকারের আন্দোলন বিভক্ত হয়নি? তাহলে সেটি কোন স্বাধিকার, কাদের জন্য আন্দোলন? কিসের চাঁদা? আপনাদের কয়টি গ্রুপের কয়টি আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট আছে? এমন হাজারো প্রশ্ন এখন সাধারণ চাঁদা প্রদানকারীদের মনে। কিন্তু উত্তর নাই।

এতোক্ষন আমি যা বলেছি যদি ভুল হয় আমাকে মাফ করবেন। আমারো জীবনের মায়া আছে। কারন আমার ছেলেমেয়ে সংসার সবই আমার ওপর নির্ভরশীল। আপনাদের ক্ষোভের নির্দেশ বাস্তবায়ন হতে সময় লাগে না।
১৯৭৯/৮০/৮১ থেকে ৮৪ তারপর ৮৬ সালের ভয়াবহতা নিজের চোখে দেখেছি। বারুদের গন্ধ মনে হয় এখনো ফুসফুসে আটকে আছে।

এরপর শান্তিচুক্তি, প্রত্যাবর্তন, স্বদেশে আবার পুনর্বাসন দন্দ, টাস্কফোর্স, প্রথাগত অধিকার, চুক্তি বাস্তবায়ন, আবারো কয়েক দফায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কার লাভ হয়েছে???

সব প্রশ্নের উত্তর, জানা অজানা সবই আপনারা জানেন। আলোচনায় প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করছি মাত্র।
দফায় দফায় নিরীহ পাহাড়ি- বাঙ্গালিরাই বলির পাঁঠা হয়েছে। এ মানুষগুলোকে দয়া করে এ দায় থেকে মুক্তি দিন, মুক্তি দিন।

জীবনের মায়া ত্যাগ করে এমন অপ্রিয় সত্যগুলি পাহাড়ের সাংবাদিকরা লিখতে পারেনা। আমিও ৯৫ সাল থেকে পাহাড়ে সাংবাদিকতা করি। সবসময় স্বাধিকার অধিকারের পক্ষেই লিখেছি বা সংখ্যালঘুদের পক্ষেই ছিলাম। এটা সাংবাদিকদের স্বভাবসিদ্ধ ব্যপার। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি আর পেয়েছি তাতে সময় বলে দেয় এখন কি করা উচিত।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বিশ্বায়নের এই সময়ে কোন বিপ্লবেই স্থায়িত্ব বা স্বীকৃতিলাভ সম্ভব নই। শুধু শুধু প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিভক্ত আন্দোলন, সশস্র চাঁদাবাজি, সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ এসবে কখনোই সাধারন পাহাড়ীদের অধিকার আদায় হবে না বা হচ্ছে না। শুধু বারবার বঞ্চনাই ডেকে আনছেন। দয়া করে এসব থেকে মুক্তি দিন মুক্তি দিন।

ওমর ফারুক শামীম: সিনিয়র সাংবাদিক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন