আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করতে জেএসএসের প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র ক্যাডার তিন পার্বত্য জেলায় কাজ করেছে

paharer-rajniti-home

আতিক রহমান পূর্ণিয়া, বান্দরবান থেকে ফিরে:

আওয়ামী লীগ জেএসএস একে অপরের টার্গেট। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিহিংসা আর সংঘাতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখা দিয়েছে। পাহাড়ে সক্রিয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী যার যার স্বার্থ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এখন মরিয়া। এর ফলে ছোট বড় অপরাধ বেড়েই চলেছে। খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি গত দেড় দশকের মধ্যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সশস্ত্র তৎপরতা। যা অশান্ত করে তুলেছে পাহাড়কে। পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির রাজনীতির এই সংকটের চিত্র নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রথম পর্ব প্রকাশিত হল :

 

পার্বত্য তিন জেলায় এখন মুখোমুখি অবস্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে কোনো না কোনো ছোট বড় সংঘাত-সংঘর্ষ। আওয়ামী লীগ ও জেএসএসের নেতাকর্মীরা বলছেন তারা একে অপরের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। এই টার্গেট সুস্থ কোনো রাজনৈতিক টার্গেট নয়। গত ছয় মাসে সরেজমিনে কয়েক দফায় প্রায় ২৫ দিন পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা সরেজমিন ঘুরে ‌‌‌’আদিবাসী’ ও বাঙালি, আওয়ামী লীগ ও জেএসএস নেতাকর্মী, দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে পাহাড়ের রাজনীতির এ ছবি পাওয়া গেছে।

পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এখন আওয়ামী লীগের হাতে। আর ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আওয়ামী লীগবিরোধী ‘তীব্র’ প্রচারণা চালাচ্ছে জেএসএস। অভিযোগ আছে, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির ভাগ ও স্থানীয় সরকারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। আর পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ও প্রশাসনিক দমন পীড়নের মুখে জেএসএস আবারও অনানুষ্ঠানিক ‘সশস্ত্র গোষ্ঠী’ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই শুরু করেছে। যদিও আওয়ামী লীগ ও জেএসএস নেতারা দখলদারিত্ব বা সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছেন।

অন্যমিডিয়া

এই প্রতিবেদকের সরেজমিন পর্যবেক্ষণে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আগস্টের শেষ দিককার ঘটনা। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় এক’শ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের দুর্গম রোয়াংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকা থেকে ফেরার পথে নিরাপত্তা পরিস্থিতি জানতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকতার শরণাপন্ন হতে হয়। পথটি একেবারেই দুর্গম। পাহাড় আর জঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। জনসমাগম নাই বললেই চলে। ঐ এলাকায় বাঙালি কোনো বসতি নেই।

ঐ কর্মকর্তা সাবধান করে দিয়ে বলেন, ‘ভাই দেখেশুনে যতটা সম্ভব নিজেকে সেফ করে আসবেন। ইদানিং রোয়াংছড়িতে জেএসএস একটা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। সদরে এরা মাঝে মধ্যেই আমাদের ধাওয়া খেয়ে পাহাড়ি ছড়া ও জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। সেখানে চাইলেও তাৎক্ষণিক আপনাকে কেউ নিরাপত্তা দিতে পারবে না।’

আইনশৃংখলা বাহিনীর ঐ কর্মকর্তার সাবধান বার্তা মাথায় রেখে নানা কৌশলে রোয়াংছড়ি বাজারে প্রবেশের মুখে কথা হয় স্থানীয় এক গাইডের সঙ্গে। সঙ্গত কারণেই তার নাম প্রকাশ করা হল না। রোয়াংছড়ি পৌঁছানোর পর ওই গাইডও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন। তিনি বললেন, তোমরা বাঙালিরা ‘আদিবাসীদের’ চোখের বিষ। তোমাদের দেখলে পাহাড়িদের গা কামড়ায়। পাওনা মজুরি হাতে বুঝে নিয়ে তিনি বলেন, আর কিছু টাকা বাড়তি দাও। তোমার এখান থেকে যাওয়ার পরই দুর্গম পাহাড় থেকে ফোন আসবে। জেএসএসসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ফোন করবে। অন্তত এক হাজার টাকা মোবাইল ফোনে লোড দিতে হবে।

আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে এযাবতকালের সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি চলছে পার্বত্য অঞ্চলে। এর কানাকড়ি ভাগ ছাড়তে নারাজ জেএসএস। আর আওয়ামী লীগ নেতারা ভাগ না নিয়ে ছাড়বেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে জেএসএস নেতৃত্ব আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়নের ধীর গতি দিন দিন দূরত্ব তৈরি করে আওয়ামী লীগ ও জেএসএসের মধ্যে।

এরপর শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। তৃণমূলে আওয়ামী লীগ থেকে জেএসএসের সমর্থন বেশি থাকায় সরকারি দল সব সময় থাকছে চাপের মুখে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যেন তৃণমূলে আধিপত্য বিস্তারের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় পার্বত্য অঞ্চলের আওয়ামী লীগ নেতাদের সামনে। ইউপিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান কমিশনারদের জিতিয়ে আনতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের এই চেষ্টা মেনে নিতে পারেনি জেএসএস। শুরু হয় বিভেদ আর সংঘাত।

আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করতে জেএসএসের প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র ক্যাডার তিন পার্বত্য জেলায় কাজ করেছে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। আর এদের মোকাবেলা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা জেএসএসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছেন।

তিন পার্বত্য জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক স্বীকার করেছেন, জেএসএসের ভয়ে তাদের নেতাকর্মীরা তটস্থ। অনেকে বাড়ি ছাড়া। আর জেএসএসের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ মামলা-গ্রেফতারের ভয়ে তাদের নেতাকর্মীরা দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে বনে জঙ্গলে দিন কাটাচ্ছেন। সম্প্রতি তিন জেলার প্রথম সারির অন্তত ২০ জন আওয়ামী লীগ ও জেএসএস নেতার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দুই দলের প্রত্যেক নেতার বক্তব্যেই প্রতিপক্ষের প্রতি স্পষ্ট ঘৃণা, ক্ষোভ আর প্রতিহিংসার ছাপ পরিষ্কার।

বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ক্যা শৈ হ্লা বলেন, আমরা আতঙ্কে আছি। এরা (জেএসএস) থেকে থেকে আমাদের লোকদের উপর হামলা করছে। ছোট মুদি দোকান, দুর্গম পাহাড়ের দিনমজুর, একছড়ি কলা, মুরগি বা ফল কিছুই জেএসএসের চাঁদাবাজি থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।

অনেক আগেই জেএসএস ভেঙে দুই টুকরো হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি অভিন্ন স্বার্থ ও উদ্দেশে জেএসএসের দুই অংশই এখন নিজেদের বিভেদ ভুলে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আওয়ামী লীগবিরোধী কর্মসূচি পালন করছে।

জেএসএসের স্থানীয় নেতারা হয়রানির ভয়ে সরাসরি কথা বলতে চান না। জেএসএসের একাংশের (সংস্কার) কেন্দ্রীয় সভাপতি সুধা সিন্দু খিসা অভিযোগ করে বলেন, ‘যা অশান্তি করার তা সরকার করছে। সরকার যা করছে তাতে আমরা পেরে উঠছি না।’ সব সন্ত্রাস আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণ করে বলেও সুধা সিন্দু খিসার অভিযোগ।

যোগাযোগ করলে, রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুসা মাতুব্বর বলেন, ‘রাঙ্গামাটিতে সব অস্ত্র আর অস্ত্র। এরা (জেএসএস) প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে। তিনি বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত জানিয়েছি। জেএসএসের বিশেষ করে টার্গেট আওয়ামী লীগ।

তিনি বলেন, আমার জেলায় এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাঁচজন নেতা জেএসএসের হাতে নিহত হয়েছেন। অনেকে জখম হয়ে আহত হয়েছেন। দুর্গম এলাকায় আরো কত যে নির্যাতন হচ্ছে তার হিসাব নাই বলে উল্লেখ করেন মুসা।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, জেএসএসের এই অস্ত্র ও সন্ত্রাসের কথা প্রশাসন জানে। কিন্তু কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না। যা অস্ত্র আছে তা উদ্ধার করা চাইলে এক ঘণ্টার ব্যাপার। মুসা রাঙ্গামাটিতে র‌্যাব মোতায়েনের দাবি জানান।

দুই পক্ষের নেতারাই জানান, বিগত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জেএসএস বিরোধ ওয়ার্ড পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। যখন যে যাকে পারে আক্রমণ বা হেনস্তার চেষ্টায় থাকে।

বিশেষ করে গত ইউপি নির্বাচনের পরে বান্দরবানের রোয়াংছড়ির আওয়ামী লীগ নেতা ও দলটির নির্বাচনী প্রচার কমিটির অন্যতম নেতা মং প্রু মারমা গত ১৩ জুন অপহৃত হবার পর বিদ্বেষ, প্রতিশোধ, পাল্টা-প্রতিশোধের প্রতিযোগিতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। মং প্রু অপহরণ মামলায় আসামি হয়ে বান্দরবান জেলা জেএসএস সভাপতি এখন জেলে আর সাধারণ সম্পাদক প্রায় তিন মাস ধরে পলাতক।

মং প্রু অপহরণ মামলার বাদি তার জামাতা আাওয়ামী লীগ নেতা লা মোং চিং। তিনি জানান, তার শ্বশুরের এখনও খোঁজ নেই। অথচ অপহরণকারী মূল হোতা এলাকায় অবস্থান করছে। মামলার বাদি হওয়ায় তাকে জেএসএস হুমকি দিচ্ছে এবং গত তিন মাস তিনি বাড়ি যেতে পারছেন না বলে জানান। লা মোং এখন সার্বক্ষণিক বান্দরবান সদরে অবস্থান করছেন।

মং প্রু অপহরণের পর তিন জেলায় প্রশাসনের সহায়তায় আওয়ামী লীগ জেএসএসবিরোধী বিশেষ অভিযানে নেমেছে বলে জেএসএসের অভিযোগ।

এদিকে সন্ত্রাস কবলিত জেলা খাগড়াছড়ির জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল আলম বলেন, জেএসএস তাদের নিজেদের বিরোধে জড়িয়ে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। জেএসএসের কাছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত এখন আর কোনো ভেদাভেদ নাই। সবাই তাদের শত্রু। নিজেদের চাঁদাবাজি হালাল করতে সবাইকে ঘায়েল করতে চায় জেএসএস।

জেএসএসের (সন্তু লারমা) কেন্দ্রীয় মুখপাত্র এবং সহতথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজিব চাকমা বলেন, ইউপি নির্বাচনে তিন জেলায় যাতে জেএসএস ঠিকমতো কাজ করতে না পারে সে জন্য আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ দমনের নামে তাদের মামলায় জড়ানো শুরু করে। একের পর এক মামলা দিতে থাকে, যা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক।

তিনি বলেন, পাড়ায় পাড়ায় জেএসএস কর্মীরা আতঙ্কে দিন রাত পার করছে। আইন শৃংখলা বাহিনী ভীতিকর হয়ে উঠেছে।

বৃহস্পতিবার পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

  • সূত্র: পরিবর্তন.কম
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন