আজও কালের স্বাক্ষী ঘূর্ণিঝড়ে জীবনরক্ষাকারী সেই ভবনটি

 

????????????????????????????????????

কক্সবাজার প্রতিনিধি :
২৬ বছর আগে ১৯৯১ সালের এই দিনে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছিল কক্সবাজারের দ্বীপ এলাকা কুতুবদিয়া। রাতের আধারে পাহাড়হীন এই দ্বীপের উপর দিয়ে প্রবল শ্রোতে বয়ে গিয়েছিল বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানি। পুরো কুতুবদিয়া তলিয়ে যায় পানির নীচে। কুতুবদিয়া উপজেলার ৬ ইউনিয়নের ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। মরে পানিতে ভেসে যায় প্রায় শতভাগ গৃহপালিত পশু। গৃহহারা হয়েছে প্রায় সবাই।

গভীর রাতে চলা এই ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডবে কেউ কাউকে বাচাঁতে পারেনি। বাচঁতে পারেনি নিজেও। পানি ধাক্কায় কখন হাত থেকে ছুটে গেছে ছোট্ট শিশুটি তা বুঝতে পারেনি মা-বাবা। স্বামী হারিয়েছে স্ত্রীকে। স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে। বাবা হারিয়েছে পুত্রকে আর পুত্র হারিয়েছে বাবাকে। এমনও হয়েছে একই পরিবারের একজনও বেচে নেই। চারদিকে লাশ আর লাশ। মৃত গৃহপালিত পশু আর মানুষের লাশ হয়ে গেছে একাকার। এতলাশের মাঝে যেন সনাক্ত করতে পারছিলনা স্বজনের লাশ। পানির নিচে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ভিটে বাড়ি।

এই ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে বেচে যাওয়া মানুষদের বাচার একমাত্র মাধ্যম ছিল বাঁশঝাড়, খেজুর গাছ, বড় গাছ আর উঁচু ভবন। যেখানে তারা আশ্রয় নিয়ে কোনভাবে জীবন রক্ষা করতে পেরেছিল। আর এমনই এক ভবন হচ্ছে কুতুবদিয়া উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের দিন রাতে যেখানে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছিল অর্ধশত মানুষ। ২৬ বছর পরও এই বিধস্থ আর পরিত্যাক্ত ভবনটি আজও স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছে কুতুবদিয়া বাসী। তারা এই ভবনটি ধ্বংস করতে রাজি নন কারন এই ভবনই ছিল জীবন বাচানোর একমাত্র মাধ্যম। এই ভবনের ক্ষত চিহ্ন দেখে বুঝা যায় ওই দিন এটির উপর কি দখল গিয়েছিল।

ওই ভবনের ছাদে আশ্রয় নিযে বেচে যাওয়ার মধ্যে একজন হলেন, ওই এলাকার মৃত আবুল হোছাইনের ছেলে ছৈয়দুল আলম (৪১)। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। ভবনের ছাদে তার পরিবারের সব সদস্য আশ্রয় নিয়েছিল আর তারা সকলে বেচে ছিল। ওই ছাদে আশ্রয় নিয়ে তাদের মত জীবন রক্ষা পেয়েছিল আবু শামা মাঝি ও গোলাম রশিদ মাঝির পরিবারসহ আরো অনেকের।

স্মৃতিচারন করতে গিয়ে তিনি বলেন, সেই ভয়ংকর স্মৃতি আজও ভুলতে পারছেন না। তার চোখের সামনেই চিৎকার করতে করতে ভেসে যাচ্ছিল ছোট শিশু, নারী-পুরুষ। বাবা-মা বলে ডাক দিচ্ছিল ভেসে যাওয়া মানুষগুলো। কিন্তু তাদের কিছু করার ছিল না।

ওই সময় জীবন রক্ষাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারন ওই ছাদের কয়েক ইঞ্চি নীচেই প্রবল শ্রোতে বয়ে যাচ্ছে পানি। যার সাথে ভেসে যাচ্ছিল পশু আর মানুষ।

এই ছাদে আশ্রয় নিয়ে জীবন বেচে যাওয়া আরো একজন জানান, তারা সকাল বেলায়ও ছাদ থেকে নামতে পারেনি। কারন তখনও পানি কমেনি। চারদিকে দেখা যাচ্ছিল শুধু পানি আর পানি। সবকিছু তলিয়ে গেছে পানির নীচে। দূরে দেখা যাচ্ছিল গাছের উপরও লাশ ভেসে আসে আবার লাশের পাশেই গাছ ধরে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। বেশিরভাগ লাশই ছিল বিবস্ত্র। পানি একটু কমতে থাকলে দেখা যায়। বেচে যাওয়া লোকজন স্বজনের লাশ খুঁজছিল। এই চিত্র ছিল খুবই ভয়ংকর। যা বর্ননা দেওয়া মত নয়।

উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ফলে কুতুবদিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল সেই থেকে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে কুতুবদিয়া। স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় কুতুবদিয়ার অনেক এলাকায় জোয়ারের পানি ডুকছে আর বের হচ্ছে। এই অবস্থায় স্থায়ী কোন বেড়িবাঁধ যদি না হয় তাহলে ১৯৯১ সালেরও কম শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। যা দেখা গেছে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র সময়। বর্তমানে যেসব স্থানে বেড়িবাধের কাজ চলছে এসব লোকদেখানো ছাড়া কিছুই না। তাই আসন্ন ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা  আর কুতুবদিয়াবাসী যেন আরেকবার এই ধরনের ভয়ংকর বিপদে না পড়ে তার জন্য স্থায়ী বেড়িবাধ প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের এদিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড় দক্ষিন-পূর্ব উপকূলে আঘাত হেনেছিলো। সেই ভয়াল রাতে চট্টগ্রামের কক্সবাজার-মহেশখালী, কুতুবদিয়া এবং সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিঃ মিঃ ঘন্টা বেগে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার লোক প্রাণ হারায় এবং এক কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন