পথে পথে পর্যটক, হয়রানি-জরিমানা

সেন্টমার্টিনগামী জাহাজে ধারণক্ষমতার চেয়ে ৫ গুন যাত্রী, ২০০ টাকার হোটেল ২০০০ হাজার টাকা, স্থানীয়রা পরিবহন সংকটের কবলে

কক্সবাজার প্রতিনিধি:

টানা ৩ দিনের সরকারি ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। ইতোমধ্যে শহর ও সাগরপাড়ের সকল আবাসিক হোটেল ও রেস্ট হাউসের সকল কক্ষ পূর্ণ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এবারের সাপ্তাহিক ছুটির সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা শহীদ দিবসের ছুটি যুক্ত হয়ে টানা ৩ দিনের ছুটি পড়ায় এই সুযোগে ভ্রমণ পিপাসু লোকজন দল বেঁধে কক্সবাজারে বেড়াতে আসে।

এসব মানুষের ভীড়ে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কক্সবাজার শহর ও আশেপাশের সকল আবাসিক হোটেল ও রেস্ট হাউসসমূহের সকল কক্ষ পূর্ণ হয়ে যায়। অনেকেই রাত কাটায় গাড়ি কিংবা রাস্তাঘাটে। আবার কেউ কেউ সমুদ্র সৈকতে আগুন জ্বালিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। অনেকেই আবাসনের ব্যবস্থা করতে না পেরে রাতেই কক্সবাজার থেকে ফিরে যায়। বৃহস্পতিবার একদিনেই চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক আসেন বলে জানান কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার একদিনেই সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক আসায় রাস্তাঘাটে নজিরবিহীন ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়। অনেকেই আগের রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় কক্সবাজারে পৌঁছান। তিনি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কক্সবাজারের হোটেলসমূহের কোন কক্ষ খালি ছিল না উল্লেখ করে বলেন, তবে শনিবার শতকরা ৮০ ভাগ পর্যটক কক্সবাজার ত্যাগ করবেন। ফলে কক্সবাজার অনেকটা পর্যটক শূন্য হয়ে পড়বে।

এদিকে পর্যটকদের অভিযোগ-কক্সবাজারে হোটেল ব্যবসায়ীরা ছুটির ফাঁদে ফেলে পর্যটকদের কাছ থেকে ৪ গুন বেশি হোটেলের দাম আদায় করে। অনেক জীম্মি ও অসহায় হয়ে থাকতে হয়। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পর্যটকদের ভীড়ে কক্সবাজারে বৃহস্পতিবার – যানজট দেখা দেয়। রাস্তাঘাট এবং বিপণীকেন্দ্রসমূহেও প্রচণ্ড ভীড় জমে। বৃহস্পতিবার আসা পর্যটকরা পরদিন শুক্রবার অন্যান্য পর্যটন স্পট যথা সেন্টমার্টিন, ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, মহেশখালীর আদিনাথ, বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কসহ দর্শনীয় অন্যান্য স্থানসমূহ ভ্রমণ করেন বলে জানান, ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অফ কক্সবাজার (টোয়াক) সভাপতি রেজাউল করিম রেজা। এদিকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে চলাচলকৃত জাহাজে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। জাহাজের ধারন ক্ষমতার ৪/৫ গুন যাত্রী নিয়েছে কোন আইন না মেনে। যার ফলে চলাচলকারী এলসিটি আটলান্টিক কে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে প্রশাসন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে টেকনাফ উপজেলা (ভূমি) অফিসার প্রণয় চাকমা এ জরিমানা করেন।

অপর জাহাজ এলসিটি কাজল জাহাজটি সাগরের মাঝখানে বিকল হয়ে যায় অতিরিক্ত যাত্রী নেয়ার কারণে। সেই জাহাজ কুলে ফিরে রাত ৯টায় দমদমিয়া জাহাজ ঘাটে আসে। যার ফলে বুকিং করা ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেক যাত্রী চলে যেতে পারেনি।

সরেজমিন দেখা গেছে- ২১ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় সরকারি ছুটির দিন। ২২ ও  ২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্র-শনিবার হওয়ায় সরকারি ছুটি। ফলে এই তিনদিন এদেশের প্রায় সব দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকবে। এই সুযোগে পরিবার-পরিজন নিয়ে পর্যটন শহরের দিকে ধেয়ে আসে পর্যটকের দল। এ কারণে কক্সবাজারে হোটেল পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। এরিমধ্যে প্রতিটি হোটেলের ভাড়া (নরমাল) সর্বনিম্ন সাড়ে তিন হাজারে ঠেকেছে। কিছু হোটেলে ভাড়া ৭ থেকে ৮ হাজার পর্যন্তও চাওয়া হচ্ছে। তাই পর্যটকদের থেকে গলাকাটা ভাড়া আদায় ও পর্যটক হয়রানি বেড়ে গেছে। হোটেল-মোটেল জোনে ঘুরে এ নৈরাজ্যকর অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমণ ঘটতে চললেও কক্সবাজার শহরে তাদের থাকার মতো পর্যাপ্ত আবাসিক হোটেল নেই।

ফলে বেশ কয়েক বছরের মতো রাস্তায়-রাস্তায় পর্যটকদের রাতযাপন করতে হচ্ছে। এ কারণেও দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে কক্সবাজারের মান ক্ষুন্ন হওয়ার পাশাপাশি পর্যটক আগমণ যেন কক্সবাজারবাসীর জন্য ‘অভিশাপ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যটকদের আগমণের আগেই প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারেও। এমনিতেই রোহিঙ্গাদের চাপের কারণে পর্যটন শহরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য দেশের অন্য জেলা শহরের তুলনায় বেশি। বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমণ ঘটায় তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। মাংস, মাছ থেকে শুরু করে শাক-সবজির মূল্য পর্যন্ত এখন সাধারণ ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।

কলাতলীর পর্যটন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর শীত ও সরকারি ছুটিসহ নানা ছুটিতে ব্যাপক সংখ্যক পর্যটকের ভীড় হয় কক্সবাজারে। কিন্তু এবার শীতের শেষ আমেজ আর ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটির কারণে হোটেলগুলো বুকিং হয়ে যায়। এ কারণে কক্সবাজারে এবার কয়েক শত কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে হোটেল-রেঁস্তোরাসহ পর্যটন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আশা করছেন।

কক্সবাজারে প্রায় ৫’শ হোটেল ও রেস্তোঁরা রয়েছে। আর প্রতিটি হোটেল-মোটেলে নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট রাখার নিয়ম থাকলেও কোন হোটেলেই তা দেখা যায়নি।

রাজধানী ঢাকা থেকে আসা পর্যটক আলমগীর, রানা ও নিপু অভিযোগ করে বলেন, কক্সবাজার এসে মহা বিপদে পড়ে গেছি। এখন কোন রুমই পাওয়া যাচ্ছেনা। যে কয়েকটি পাওয়া যাচ্ছে তার দাম ৭ হাজার চাওয়া হচ্ছে। তারা আরও অভিযোগ করেন, পর্যটন মৌসুমে হোটেল মোটেল অতিরিক্ত অর্থ আদায় প্রকাশ্যে চলছে। আর যেসব হোটেল সাধারণত ৬’শ থেকে ৮শ টাকা রুম ভাড়া নেয়া হয় সে সব তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বলেও পাওয়া যাচ্ছেনা। অধিকাংশ রুম হোটেল মালিকরা ধরে রেখেছে আর কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর হতে চলে গেছে। তবে এ জন্য তারা প্রশাসনের দূর্বলতাকে দায়ী করছেন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন জানান, পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে কক্সবাজার উপভোগ করতে পারেন, তার জন্য কক্সবাজার ছাড়াও অন্যান্য জেলা থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

সমুদ্র সৈকতে পর্যটন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম জয় বলেন-রেকর্ডসংখ্যাক পর্যটক এবার কক্সবাজারে এসেছেন। তাদের সার্বিক নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসনের ৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছে। এ পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। পর্যটকদের হয়রানি বন্ধে হোটেল-মোটেল ও রেস্তরায় মূল্য তালিকা টাঙ্গানোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। এসব তদারকিতে মাঠে রয়েছে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তার পরেও ব্যবসায়ীরা অনেক সময় এগুলো মানতে চায় না। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন