৮২ হাজার উদ্বাস্তু পরিবার কোথা থেকে এলো?

সন্তোষ বড়ুয়া:
সরকারি অর্থায়নে পুনর্বাসনের আওতায় আসছে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলার প্রায় ৮২ হাজার উদ্বাস্তু পরিবার। এ জন্য এ তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরীণ ৮১ হাজার ৭৭৭ উদ্বাস্তু পরিবারের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে সরকার গঠিত টাস্কফোর্স। সভায় পুনর্বাসনের জন্য ভারত থেকে স্বেচ্ছায় প্রত্যাগত ২১ হাজার ৯০০ শরণার্থী পরিবারের তালিকা যাচাই বাছাই পূর্বক প্রস্তুত করার অনুমোদন দিয়েছে টাস্কফোর্স।

মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরের সার্কিট হাউজে আয়োজিত ‘ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণপূর্বক পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স এর ৯ম সভায় এ তালিকার অনুমোদন দেয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ির সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। সভায় পুনর্বাসনের জন্য ভারত থেকে স্বেচ্ছায় প্রত্যাগত ২১ হাজার ৯০০ শরণার্থী পরিবারের তালিকাও অনুমোদন দিয়েছে টাস্কফোর্স। এছাড়াও, উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের ঋণ মওকুফ, ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার, প্রত্যাগত শরণার্থীদের চাকরিতে জ্যেষ্ঠতা প্রদান, রেশন দেয়া এবং টাস্কফোর্স সদস্যদের সম্মানী ভাতা নিয়ে আলোচনা করেন টাস্কফোর্স সদস্যরা।

ঋণ মওকুফের বিষয়ে টাস্কফোর্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা সভায় জানান, উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের ঋণ মওকুফ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে ঋণদাতা সোনালি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক এবং বিআরডিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি অগ্রগতির পর্যায়ে রয়েছে। উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ৪৫১টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে বলে সভায় জানান, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, এসব মামলার মধ্যে ৪৪৬টি মামলা ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকি মামলাগুলোতে কিছু জটিলতা থাকলেও তা নিরসন করে দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে। প্রত্যাগত শরণার্থীরা সরকারি চাকরিতে জ্যেষ্ঠতা সুবিধা ভোগ করছেন বলে সভায় জানান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) নুরুল আলম নিজামী।

তিনি জানান, এ পর্যায়ের ২৬২ কর্মকর্তাদের মধ্যে ২৫৫ জন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠতা সুবিধা ভোগ করছেন। ৯ম সভা থেকে টাস্কফোর্স সদস্যদের সম্মানী ভাতা দেয়ার কথা জানান বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, টাস্কফোর্স সদস্যদের সভা প্রতি সম্মানী ভাতা আমরা দেবো। তবে মাসিক সম্মানী ভাতার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। অনুমতি পেলে সেটিও ব্যবস্থা করা হবে। টাস্কফোর্সের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দিতে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। এখানে পাহাড়ি বা বাঙালি কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তিন পার্বত্য জেলার উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সরকার গঠিত টাস্কফোর্স আরো কার্যকর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এ সময় উদ্বাস্তু ও শরণার্থী পরিবারের তালিকা থেকে কোনো পরিবারের নাম বাদ পড়লে তাদের দ্বিতীয় তালিকায় যোগ করা হবে বলেও জানান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মানিক লাল বণিক, স্থানীয় সরকারের বিভাগীয় পরিচালক দীপক চক্রবর্ত্তী, রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। এ ব্যাপারে পাহাড়ের বাঙালি সংগঠনগুলোর দাবি, যে তালিকা টাস্কফোর্স কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয়েছে সেই তালিকায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ২৬ হাজার বাঙালি পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। তাই ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স এর ৯ম সভায় কথিত ৮২ হাজার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত অনুমোদনকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে পাহাড়ের কয়েকটি বাঙালি সংগঠন। তবে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে যে, বাঙালি পরিবারের প্রকৃত সংখ্যা আসলে ৩৮ হাজার ১৫৬টি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শান্তি চুক্তির পর ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ইতিমধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ ২১ পরিবারকে খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালার জামতলীতে পুনর্বাসন করা হয় ফখরুদ্দিন সরকারের সময়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টেও শান্তিচুক্তির এই ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত বলে দাবি করা হয়েছে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে হঠাৎ করে ভারত থেকে স্বেচ্ছায় প্রত্যাগত এই ২১ হাজার ৯০০ শরণার্থী পরিবার কোথা থেকে এলো?

পুনর্বাসনের নামে সীমান্তের ওপার থেকে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে গোপনে বসবাসকারী লোকদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে কিনা, এই বিপুল পরিমাণ লোককে কোথায় পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে, এখানে বাঙালিদের কবুলিয়ত প্রাপ্ত জমি, সরকারি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ জমি ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, শান্তিচুক্তি পরবর্তীকালে ইউপিডিএফ, জেএসএস তাদের অধিপত্য বিস্তারের জন্য বিভিন্ন এলাকায়, সরকারি, খাস, রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় যেসমস্ত নতুন বসতি স্থাপন করেছে তাদের এই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ক্যাটাগরিতে ফেলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা পুনর্বাসন করিয়ে নিচ্ছে কিনা, চুক্তি পরবর্তী পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে বিভিন্ন সময় যেসব নিরীহ পাহাড়িরা ডিসপ্লেসড হয়ে অন্যত্র বসতি গড়েছে তাদেরও এই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের মধ্যে ফেলা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছে বাঙালি নেতৃবৃন্দ।

তারা আরো জানান যে, নিরাপত্তার জন্য যে সমস্ত বাঙালিদের তাদের বসতবাড়ি থেকে সরিয়ে গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়েছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের কেন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসাবে বিবেচনা করে সরকারি কবুলিয়ত প্রদত্ত পূর্বের জমিতে ফিরিয়ে আনা হবে না? অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে ১২,২২২টি উপজাতীয় পরিবারকে উপযুক্তভাবে পুনর্বাসন করা হয়। সর্বশেষ ২১টি পরিবারকে খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালার জামতলীতে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু জেএসএস সভাপতি ও তৎকালীন শান্তি বাহিনীর প্রধান সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন বর্তমান জেএসএসের হত্যা নির্যাতনে উদ্বাস্তু ২৬ হাজার বাঙালি পরিবারকে (প্রকৃত সংখ্যা ৩৮ হাজার ১৫৬টি) এখন পর্যন্ত পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

এদিকে ১২,২২২টি উপজাতীয় পরিবারকে পুনর্বানের পর পাহাড়ে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী উপজাতীয় কোনো উদ্বাস্তু ছিল না। সচেতন মহলের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের কাঙ্ক্ষিত জুমল্যান্ড বানাতে গোপনে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার ও ভারত থেকে উপজাতীয় পরিবারকে রাতের আধারে সীমানা পার করে অভ্যন্ত রীন উদ্বাস্তু সাজানো হচ্ছে। এর আগেও ১৮টি উপজাতীয় পরিবারকে ভারত থেকে সীমান্ত পার করে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার ছোট বেলছড়িতে নিয়ে এসে তাদের জোরপূর্বক বাঙালিদের ভূমিতে ঘর তৈরি করে দিয়ে বাংলাদেশি ভোটার করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল স্থানীয় এক উপজাতীয় ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।

এছাড়া অভিযোগ রয়েছে সামপ্রতিককালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বেশ কিছু বার্মিজ পরিবারকেও পাহাড়ে আশ্রয় দিয়েছে উপজাতীয় নেতারা। সচেতন মহল আরো মনে করেন যে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে এই শরণার্থী পুনর্বাসন উপজাতি সংগঠনগুলোর নিজেদের পক্ষে ভোট বাণিজ্য করার একটি কৌশল হতে পারে। বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পার্বত্যবাসী পাহাড়ি-বাঙালিদের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে রক্ষায় সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোসহ টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রণয়নকৃত তালিকাটি বাতিল করে নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করে তা যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে ২৬ হাজার বাঙালি পরিবারকে (প্রকৃত সংখ্যা ৩৮ হাজার ১৫৬টি) পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।

একই সঙ্গে পাহাড়ে বাঙালিদের ভূমি দখলের যে মিশন হাতে নিয়েছে আঞ্চলিক সশস্ত্র উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো তা প্রতিরোধে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে সরকার এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক ও লেখক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন