৫০ বছরের নেছার আলী অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে পিঠে চড়িয়ে পালিয়ে এসেছেন


নিজাম উদ্দিন লাভলু, উখিয়া থেকে ফিরে

নেছার আলীর বয়সও ৫০ ছুঁই ছুঁই। রোগে শোকে নিজেও দুর্বল। স্ত্রী, দুই পুত্র, এক কন্যা আর দুভাইয়ের প্রাণ গেছে বার্মিস সেনাদের হাতে। ঘরবাড়ি আগুনে ছাঁই করে দিয়েছে তারা। বিধবা পুত্রবধূ, দুই নাতি আর অশীতিপর মাকে সঙ্গে নিয়ে মানায়মারের বনে আত্মগোপন করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। হাঁটাচলায় অক্ষম অশীতিপর বৃদ্ধা মা বলেছিলেন, আমাকে তোর পিঠে চড়িয়ে কস্ট করে বাংলাদেশে নেয়ার দরকার নেই। আমাকে এখানে রেখে তোরা পালিয়ে যা। কিন্তু নেছার আলী মাকে সেই মৃত্যুপুরীতে ফেলে আসতে পারেননি। তিনি বললেন, এ বৃদ্ধা শুধু তার মা নন, তার বেহেশত।

তাই এ অমূল্য সম্পদ মাকে পিঠে নিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে এসেছেন বাংলাদেশে। আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার বালুখালীতে। নেছার আলী জানান, তারা কৃষিজীবি পরিবার। কোন দ্বন্দ্ব, ফ্যাসাদে কখনও নিজেদের জড়াননি। মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধরা এভাবে তাদের ওপর নারকীয়তা চালাবে ভাবতেও পারেননি। বনের পশুপাখিকেও মারতে মানুষের হাত কাঁপে। কিন্তু তারা হাজার হাজার অসহায় রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে। ওরা মানুষ রুপী রক্ষস। তারা হেসে হেসে গুলি করে আমার স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে এবং দুই ভাইকে হত্যা করেছে। স্বজনদের হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। উখিয়া টেকনাফ সড়কের বালুখালী পানবাজার হতে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে দুর্গম এলাকার এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দেখা মেলে এ নেছার আলীর সাথে। তখনও তার পিঠে ঝুলছিল বৃদ্ধা মা।

জানালেন, বালুখালী পানবাজারে ত্রাণের আশায় গিয়েছিলেন। হুড়োহুড়ি কাঁড়াকাঁড়ি করে কোন ত্রাণ নেযা সম্ভব হয়নি তার। তাই খালি হাতে মাকে পিঠে চড়িয়ে ফিরে এসেছেন প্রায় ২শ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ঝুঁপড়ি ঘরের আশ্রয়স্থলে। রামগড় থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে যাওয়া প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে পাঁচশত টাকা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান নেছার আলী।

তিনি বলেন, প্রধান রাস্তা থেকে অনেক দূরে এবং দুর্গম হওয়ায় এখানে কেউ ত্রাণ নিয়ে আসেন না। তাই তারা বঞ্চিত হচ্ছেন সাহায্য থেকে। একই কথা জানালেন, ঐ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া অন্যরাও। কয়েকশ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন ওখানে। অনেকে ঝূঁপড়ি ঘর বানাচ্ছিলেন তখনও। দুর্গম ঐ এলাকায় বেশ কয়েকটি পাহাড়জুড়ে আশ্রয়স্থল করে নিয়েছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। পাহাড়ি ঝিরি-ছড়া পথে পায়ে হেঁটে যেতে হয় ওখানে। রামগড়ের প্রতিনিধিদলের সাথে যাওয়া একটি চিকিৎসা সহায়তাকারীদল ঐ পাহাড়ে আশ্রিতদের চিকিৎসা ও ওষুধপত্র দেন।

রামগড় কেন্দ্রিয় জামে মসজিদ ও কোর্ট জামে মসজিদের আওতাধীন ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবি, ধনার্ঢ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে সংগৃহিত প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা বিতরণ করা হয় বালুখালীর দুর্গম ঐ পাহাড়ি এলাকার আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে। রামগড় কেন্দ্রিয় জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. আব্দুল হক, মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মোঃ আকতার হোসাইন ও রামগড় বাজার ব্যবসায়ি সমিতির সভাপতি আবুল হাশেম খাঁ ঝুঁপড়ি ঘরে আশ্রিতদের হাতে হাতে নগদ অর্থ সাহায্য বিতরণ করেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন