২০১৬ সালে খাগড়াছড়ি ছিল অস্থিরতায়
এইচ এম প্রফুল্ল:
২০১৬ সাল খাগড়াছড়ি পার করেছে নানা অস্থিরতায়। বছর জুড়ে আওয়ামীলীগের দুই গ্রুপের পাল্টা-পাল্টি হামলা-মামলা, ভাংচুর, সংশোধিত ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন নিয়ে বাঙালী সংগঠনগুলো হরতাল অবরোধ, পাহাড়িদের প্রতিবাদের মুখে প্রায় সাড়ে ৭ শত কোটি টাকার বিশেষ পর্যটন জোন’ গঠনের প্রস্তাব বাতিল, নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ইউপিডিএফ’র সন্ত্রাসীদের বন্দুক যুদ্ধ,অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ শীর্ষ নেতা উজ্জল স্মৃতি চাকমা ছয় সহযোগিসহ আটক, পৌরসভার মেয়রের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন, জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ৩৫ সাংবাদিকের সাধারন ডায়েরী, সড়ক দুর্ঘটনা প্রাণ হানি ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে হতাশার মাঝেও পুলিশের মাদক বিরোধী অভিযান সচেতন মহলে সাড়া জাগিয়েছে।
২০১৬ সাল প্রায় পুরোটায় খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের দুই গ্রুপ পার করেছে পাল্টা-পাল্টি হামলা-মামলা ও ভাংচুরের মধ্য দিয়ে।আগের বছর অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি ও সাধারণ সম্পাদক মো: জাহেদুল আলমের মধ্যে নেতৃত্বে কোন্দলের জম্ম। দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে টানা প্রায় আট মাস প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকা দলীয় কার্যালয় চাবি ৩১ অক্টোবর হস্তান্তর করা হয়েছে বটে, কিন্তু দ্বন্দ্ব মিটেনি। বরং সভাপতি ও সম্পাদকের এই নেতৃত্বে কোন্দল সহযোগি সংগঠন ও তৃণমূলে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সর্ব শেষ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসও দুই নেতার নেতৃত্বে পৃথকভাবে পালিত হয়েছে। সংশোধিত পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন পাশ নিয়ে বাঙালি সংগঠনগুলোর হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচীতে খাগড়াছড়ি ছিল উত্তাল।
২০১৬ সালের ১ লা আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ভেটিং সাপেক্ষে ‘পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬’ এর খসড়ার নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয় এবং ৯ আগষ্ট তা অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন(সংশোধিত) বিলটি ২০১৬ পাশ হয়।
এর মধ্যে ৮ আগষ্ট ৪৫ দিনের সময় অভিযোগ দাখিল করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন। কমিশনের আহবানে সাড়া দিয়ে প্রায় ১৬ হাজার আবেদনও জমা পড়েছে।
২০১৬ সালে খাগড়াছড়িতে প্রায় সাড়ে সাতশত কোটি টাকা ব্যায়ে বিশেষ পর্যটন জোন’ গঠনের উদ্যোগ আন্দোলনের মুখে বাতিল হয়ে যায়। বাংলাদেশ ইকোনমিক অথরীতি জোনের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রশাসন আলুটিলায় পর্যটন উন্নয়নে বেপজাকে সাড়ে ৭শ একর ভূমি বন্দোবস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে ইউপিডিএফ’র পৃষ্ঠপোষকতায় আন্দোলনে নামে কয়েকটি পাহাড়ি সংগঠন। ফলে সরকার এক পর্যায়ে প্রকল্পটি বাতিল করে। এতে হতাশা নেমে আসে সর্বমহলে।
২০১৬ সালে খাগড়াছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র(ইউপিডিএফ) মধে বন্দুক যুদ্ধে একজন নিহত, বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র উদ্বার ও অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ শীর্ষ নেতা উজ্জল স্মৃতি চাকমা ছয় সহযোগিসহ আটক ছিল আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম।
গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার দিকে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার একটি দল দাতকুপিয়া এবং ভুয়াছড়ি এলাকার মধ্যবর্তী স্থান কুতুকছড়িতে ইউপিডিএফ’র ১৫-২০ সদস্যের একটি গ্রুপ গোপন বৈঠক করছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে যৌথ বাহিনী ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে।যৌথবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে যৌথ বাহিনীও গুলি ছুড়ে পাল্টা জবাব দেয়।এক পর্যায়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলটি অন্ধকার পাহাড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ইউপিডিএফের এক সন্ত্রাসী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে ৩৮ রাউন্ড গুলিসহ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি এম-১৬ রাইফেল, ১৯ রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশী জি-৩ রাইফেল, একটি জি-৩ রাইফেলের ম্যাগজিন, ৪৯ রাউন্ড গুলিসহ একটি চাইনিজ সাব মেশিনগান, একটি চাইনিজ সাব মেশিনগানের ম্যাগজিন, ৩৮ রাউন্ড গুলিসহ একটি এম-১৬ রাইফেল, এম-১৬ রাইফেলের একটি ম্যাগজিন,একটি ওয়াকিটকি সেট, একটি মোবাইল, একটি ব্যাগ উদ্ধার করে।
২০১৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের পেরাছড়ার হেডম্যান পাড়া এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে অভিযানে একটি টুটু বোরের রাইফেল ও বিপুল পরিমান সামরিক সরঞ্জামসহ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র(ইউপিপিএফ) সামরিক শাখার প্রধান উজ্জল স্মৃতি চাকমাকে ৬ সহযোগিসহ আটক করে।
উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ছিল,একটি টুটু বোরের রাইফেল,একটি পিস্তল,একটি বন্দুক ও একটি পাইপগানসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক পোশাক,ধারালো অস্ত্র, লিফলেট উদ্ধার হয়।
২০১৬ সালে জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক প্রানহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে ২২ সেপ্টেম্বর আলুটিলায় সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাটি ছিল ভয়াবহ। জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন সাপমারা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ১‘শ ৫০ ফুট খাদে পড়ে গেলে দুই শিশু ও এক নারীসহ ৫জন নিহত ও আহত ৩৫ হয়।
২০১৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ(জেএমবি’র) চট্টগ্রাম অঞ্চলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা আব্দুর রহিম ওরফে জাহিদসহ পাচজনকে সাত বছর করে কারাদন্ড দেন খাগড়াছড়ি জেলা ও দায়রা জজ এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারক মো: ইনামুল হক ভূঁঞা।
উল্লেখ,২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে র্যাবের একটি বিশেষ দল খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার শান্তিপুর এলাকায় অভিযান চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেএমবির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আব্দুর রহিম ওরফে জাহিদ হোসেন,মোঃ দেলোয়ার হোসেন ওরফে সজিব,মোঃ ইউনুছ আলী ওরফে ইউনুছ, সামছু মিয়াকে আটক করে। এ ঘটনায় বিস্ফোরক ও সন্ত্রাস দমন আইনে পৃথক দু’টি মামলা হয়।পরবর্তীতে পাচজনকে আসামী করে চার্জশীট দেওয়া হয়।
২০ ১৬ সালের শেষ দিকে খাগড়াছড়িতে পৌরসভার মেয়রের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে সাংবাদিকদের মানববন্ধন চলাকালে মেয়র রফিকুল আলমের সন্ত্রাসীব বাহিনীর প্রাণ নাশের হুমকি ও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ৩৫ সাংবাদিকের থানায় জিডি করা ছিল আলোচিত ঘটনা।
১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলোর খাগড়াছড়ির ফটো সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে মেয়র রফিকুল আলমের ক্যাডার বাহিনীর প্রধান কসাই দিদার নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা পৌরসভায় ধরে নিয়ে যায় এবং পরে এময়র তাকে শারীরিক নির্যাতন করে। পরে সহকর্মী সাংবাদিকরা নিরব চৌধুরী বিটনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে ২০ ডিসেম্বর ১০টায় সাংবাদিকরা পৌর শাপলা চত্বরে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সময় খাগড়াছড়ি পৌর মেয়র মো: রফিকুল আলমের অনুসারী দিদারুল আলমের নেতৃত্বে ৪০-৪৫ জন সন্ত্রাসী শাপলা চত্বরে এসে সাংবাদিকদের মানববন্ধনের ব্যবহারের জন্য মাইক কেড়ে নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করে।
তারা ‘একটি-দুটি সাংবাদিক ধর, ধরে ধরে জবাই কর, সাংবাদিকদের আস্তানা-জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি শ্লোগান দেয়। ওই সময় সন্ত্রাসীদের হাতে কিরিচ ও লাঠিসোঁটা ছিল। এ সন্ত্রাসীরা একে একে ৩৫ জন সাংবাদিকের ছবি মুঠোফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে।
এ ঘটনায় সাংবাদিকরা স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান ও পুলিশ সুপার মো: মজিদ আলীর সাথে স্বাক্ষাত করে অবহিত করেন এবং সন্ত্রাসীদের প্রাণ নাশের হুমকির প্রেক্ষিতে খাগড়াছড়িতে কর্মরত ৩৫ জন সাংবাদিক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন।
২০১৬ সালের শেষ দিকে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পুলিশের মাদক বিরোধী অভিযান প্রশংসার দাবী রাখে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রায় দেড় শতাধিক মাদক মামলা, দুই শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী-মাদকাসক্ত গ্রেফতার হয়েছে। সব শেষ ৩০ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে প্রায় ৩০লক্ষাধিক টাকা মূল্যে ৩০০ গ্রাম হেরোইন ও ৪৩০ পিস ইয়াবাসহ তালিকাভুক্ত ৩ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতরা হলো, তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী মো: সাজু(৩৮), তার স্ত্রী রিনা বেগম(৩২) ও মাদক ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন(২৬)। এটি খাগড়াছড়ি জেলায় সর্ববৃহৎ মাদক উদ্ধারের ঘটনা বলে জানিয়েছে পুলিশ।