সরকারের নানামুখী উন্নয়নে বাধা, থানচিতে একই পদে বহাল তবিয়তে রোকন মিয়া

থানচি প্রতিনিধি (ফলোআপ):

থানচিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে  (এলজিইডি) কার্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী  মোহাম্মদ রোকন মিয়া একই পদে বহাল তবিয়তে রয়েছে। ২৪ বছর ধরে একই পদে থেকে নানা অনিয়ম দুর্নিতি, জালিয়তিসহ অপকর্মের সাথে জড়িত থেকে গডফাদারের পরিনত হয়েছে সে।

তার অপকর্ম ঢাকা দিতে যোগ হয়েছে উপজেলা  বিভিন্ন স্তরের  জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনে লোকজন ও প্রভাবশালীরাও।

তার অপকর্মের বিষয়ে জাতীয় পত্রিকাসহ পার্বত্য অঞ্চলে জনপ্রিয় অনলাইন পার্বত্য নিউজ.কমে প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করছে না । স্থানীয় জনসাধারনের প্রশ্ন, একজন সরকারি কর্মচারী এইসব অপকর্ম কিভাবে করতে পারে! দেশেকি আইন বলে কিছু আছে! তার অপকর্মের কারণে সরকারের নানামুখী উন্নয়ন মূলক কাজ বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেচ্ছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহে হোসেনপুর উপজেলা সুরাটি গ্রামে মৃত সিরাজুল হকে বড় ছেলে  মো. রোকন মিয়া, সে ১৯৮১সালে ৩০ শে মার্চ পল্লী পূর্ত কর্মসূচীতে এমএলএসএস পদে যোগদান করে থানচিতে। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে ১ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সদর দপ্তর এলজিইডি/সি/ই-০৬/৮৭(অংশ-১)/৪১৩৫/১(৪)স্বারকের ১০ই জুলাই ১৯৯৩ সালে এমএলএসএস পদ হতে পদোন্নতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্র্র্তৃপক্ষ  ইলেকট্রিকশিয়ান পদে চলতি দায়িত্বে প্রদান করে।

সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধির ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে সরকারি কর্য ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবসায়ে জড়িত হতে অথবা অন্য কোনো চাকরি বা কর্য গ্রহণ করতে পারবেন না। সূত্র জানায়, এসব বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (আপিল ও শৃঙ্খলা) বিধিমালা ১৯৮৫- এর অধীনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরকারী চাকরীর সূত্রে পরিচয় বান্দরবানের থানচি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)’র রোকন মিয়া। কিন্তু স্থানীয় ঠিকাদার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে তার পরিচয় কোটিপতি ঠিকাদার। থানচি উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল (এডিপি) ও পিআইসি প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ন্ত্রন, ঠিকাদার নিয়োগের লবিং, দপ্তরিক গোপনীয় ফাইল চিঠি পত্র সই- স্বাক্ষর ও জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্যান্য প্রশাসনিক কর্তাদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র ঠিকানা ও ভরসাস্থল যেন  রোকন মিয়া।

জানা গেছে, এলাকায় স্থানীয়দের মাঝে তিনি পরিচিত এলজিইডি’র প্রধান কর্তা, অন্যদিকে নিজেই ঠিকাদার কাজ করার কারনে কোটিপতি ঠিকাদার নামে বেশ সুপরিচিত লাভ তিনি। থানচি উপজেলার অধিকাংশ কাজ তিনি নামে-বেনামে বাঘিয়ে নিয়ে কাজ করেন নিজেই। অন্যদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যবসায়িক অংশিদার। এরই সুবাদে তার নামে- বেনামে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাবর-অস্থাবর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি তার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৭ সালে মোহাম্মদ রোকন মিয়া থানচি উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে ৪র্থ শ্রেণীর ইলেক্ট্রিশিয়ান পদে যোগদান করে। স্বাধীনতার পর থেকে বিদ্যুৎ পৌছেনি থানচিতে । ফলে সরকারি  ভাবে উপজেলা ইকেক্ট্রিশিয়ান পদ থাকলেও এই পদের কোন কাজ তার নেই।

থানচির তিন্দু ইউনিয়নের মেম্বার ক্রানিংঅং মারমা  বলেন, রোকন মিয়া আমাদের এখানে ঠিকাদারি অনেক কাজ করেছে, সে তো ঠিকাদার, সরকারী চাকরীও করে নাকি? ঠিকাদারদের অভিযোগ, বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল (এডিপি) ও পিআইসি প্রকল্পের অধিকাংশ উন্নয়ন কাজ টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি অন্তত ২টি জাতীয় দৈনিক প্রকাশের নির্দেশনা থাকলেও প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই কাজ গুলো হাতিয়ে নেন তিনি।

সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থ সালে ৩য় ধাপের থানচি উপজেলা ক্যচু পাড়া ও তিন্দু গ্রোপিং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২টি কাজে ৬৪ লক্ষ করে ১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা কাজে  হাতিয়ে নিয়ে তিনি নিজেই ঠিকাদারী কাজ করছেন । সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ,তদারকি কর্মকর্তা সহকারী প্রকৌশলী মো. জাকের মিয়া যোগসাজসে কারনে ওই দুইটি বিদ্যালয়ে স্থানীয় ময়লা অবর্জনা বালি, তাকশিলা পাথর, নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করেই আসছে বলে এলাকাবাসীদের অভিযোগ রয়েছে ।

ক্যচু পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসএমসি কমিটি সভাপতি হ্লামংউ মারমা ও সহ সভাপতি প্রেম রজ্ঞন চাকমাকে নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে বাধা দিলে তাদের দুইজনকে রাতে আধারে উপর্যুপরি মার ধর করেছে ।

২০০৩-০৪ সালে বলিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ, ২০০৯-১০ সালে প্রথমবারের ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন উপায়ে রেমাক্রী,তিন্দু ও থানচি সদর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ কাজ বিভিন্ন উপায়ে হাতিয়ে নেন।

২০১৪ সালে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী এসব এলাকা পরির্দশণ করলে ভবনগুলো নিম্মমানের হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এই ব্যাপারে থানচি এলজিইডি’র কর্মচারী রোকন মিয়া বলেন, আমি টানা  ৩৪ বছর যাবৎ এভাবে ঠিকাদারী কাজ করে আসছি। তা ছাড়া আমার অফিসের কোন কাজ নেই, আমার  চাকরীর ৩ বছর আছে মাত্র । নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করছি, তবে নিউজ হলেই ও আমার কোন অসুবিধা আল্লাহ রহমতে করতে পারবেনা কেউ। আমি থানচির সকল প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের অফিসগুলিতে ম্যানেজ করে রেখেছি ।

জানা গেছে, নিম্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চ  প্রর্যায়ে ৮ বছরে ৮বার তদন্ত করেছেন। রোকন মিয়া বা পরিবারের নামে ঠিকাদারী লাইসেন্স না থাকলেও অন্যজনের নামে কাজ নিয়ন্ত্রন করে ঠিকাদারী কাজ করেন তিনি। ফলে স্থানীয় ঠিকাদাররা কোন প্রকল্পে কাজ না পাওয়ার অসন্তোষ বিরাজ করছে ঠিকাদারদের মধ্যে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানায়, থানচির কর্মস্থলে টানা ৩০ বছর কর্মরত থাকার কারনে তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ করেন। তিনটি ইউপি ভবন ছাড়াও থানচি বাজার থেকে জিনিংঅং পাড়া রাস্তায় শাহজাহান ঝিঁড়িতে সেতু নির্মাণ, অফিসার ক্লাব নির্মাণ, বর্তমানে অস্তিত্বহীন, কর্মচারীদের কোয়াটার নির্মাণ, ডরমেটরি ভবন সংস্কার, জনসেবা কেন্দ্র  (গোলঘর) নির্মাণ, রেমাক্রী বাজার সরকারি প্রথামিক বিদ্যালয় ভবন, জ্ঞানলাল পাড়া ঝুলন্ত ব্রীজ নির্মাণ, সেগুম ঝিঁড়িতে ঝুলন্ত ব্রীজ নির্মাণ, বর্তমানে বিলুপ্ত, দলিয়ান পাড়া স্কুল ভবন নির্মাণ, কর্মচারী ক্লাব ঘর নির্মাণ, রেমাক্রী বাজার সিঁড়ি নির্মাণ, বলিপাড়া হাই স্কুল ভবন সংস্কার, রেমাক্রী ইউপি ভবন নির্মাণ, ৪টা পিআইও ব্রীজসহ ৪ শতাধিক প্রকল্পের অধিকাংশই নির্মাণ কাজে নিম্মমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করেন ঠিকাদার তথা এলজিডি’র কর্মচারী রোকন মিয়া।

এই ব্যাপারে সরকারি ইঞ্জিনিয়ার ( ভারপ্রাপ্ত ) মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন ভূঁঞা বলেন, অনেকে সরকারি চাকুরী ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাবসা করে রোকন মিয়া ও করতেছে, আমার অসুবিধা হয়না । তবে আমি নিরুপায়,  পুরোনো কর্মচারী বলে তাকে একটু বেশি কাজে ব্যবহার করি।

এদিকে স্থানীয়রা মনে করছে, এই ব্যাপারে তদন্ত পূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সরকারী অন্য কর্মচারীরাও নিজের কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন না করে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন