সন্ত্রাসী রোমেলের মৃত্যুতে বিবেক ব্যথিত হলেও নিরাপরাধ ছাদিকুলের জন্য কেউ নেই

রোমেল চাকমাছাদিকুল

আবু উবায়দা:

সারা দেশের বিবেকবান মানুষের হৃদয় কম্পিত হয়, মানবতাপ্রেম বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়ায় কখন বলতে পারেন? উত্তর: খুব সোজা। যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন উপজাতীয় সন্ত্রাসী নিহত হয় তখন আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ভদ্র সমাজের ব্যথিত হৃদয়ের আহাজারি শোনা যায়। ভদ্র সমাজের ভাব দেখে মনে হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানবতা বিরোধী অপরাধ হলো উপজাতীয় সন্ত্রাসীর মৃত্যু। যা কিনা ’৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধকেও হার মানায়।

সদ্য দুধর্ষ সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ রোমেল চাকমার মৃত্যু তাই প্রমাণ করে। আমাদের দেশের ভদ্র সমাজ কেমন যেন অতিরিক্ত মেধাশক্তির জোরে নিজের বিবেককে অন্ধ করে রেখেছে। তারা চেষ্টা করেনা সত্য, মিথ্যার পার্থক্য খুঁজে প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে।

পার্বত্য বাঙ্গালীদের প্রতি দেশের বিবেকবান মানুষের মনোভাব দেখে মাঝে মাঝে নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি পার্বত্য বাঙ্গালীরা বাংলাদেশের নাগরিক? যদি বাংলাদেশের নাগরিকই হবে তবে কেন এতো বৈষম্য?

আমাদের ভদ্র সমাজ বয়স্ক পার্বত্য বাঙ্গালীদের সম্বোধন করে সেটেলার পরিচয়ে এবং পার্বত্য বাঙ্গালী নতুন প্রজন্মকে সম্বোধন করে সেটেলারের বাচ্চা পরিচয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের পার্বত্য বাঙ্গালী ছাড়া দেশীয় কোন জনগোষ্ঠীকে সেটেলার সম্বোধন করা হয় না।

আমার বাবা কিংবা দাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অথবা চাকরির সুবাধে পাহাড়ে এসেছে। সেই সূত্রে আমি পাহাড়ে জন্মেছি। তাই বলে আমি বিশুদ্ধ বাঙ্গালী হতে পারিনি। আমার পরিচয় হয়েছে সেটেলারের সন্তান। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কাছে এর চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে? এই ক্ষেত্রে একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়টাও কিন্তু সেটেলার!! অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই একদশমাংশ।

মুক্তমত

উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাড় বেপরোয়া সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত পার্বত্য জনপদ। রাষ্ট্রের বিবেকবান ব্যক্তিদের উচিত পার্বত্য অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে অত্যাচার, নিপীড়ন হতে তাদের মুক্ত করতে কাজ করা। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃত মানবতার জন্য কাজ।

কিন্তু, কি করছে আমাদের সভ্য সমাজ? বরাবরই বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা তাদের মানবতার গানের প্রকৃত সুর ভূলে সুর তুলছে পার্বত্য সন্ত্রাসীদের জয় গানের। এতে করে পার্বত্য উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা পাচ্ছে অপকর্ম পরিচালনায় সফল সাপোর্ট। যা পার্বত্য অসহায় মানুষগুলোকে নিষ্পেষিত করতে সহায়ক।

পাহাড়ে কোন সন্ত্রাসীর মৃত্যুতে তাদের হৃদয় কম্পিত হলেও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে কোন নিরীহ মানুষ নিহত হলে তারা নীরব। ভাড়ায় মটর সাইকেল চালক ছাদিকুলরা আসলেই কি মানুষ? – এক ছাদিকুলের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু, কি অপরাধ ছিলো বরকলের আজগর আলীর?

গত ১৯ অক্টোবর, ২০১২ সালের ঘটনা। সেদিন বরকল উপজেলার ভূষণছড়া দোকানঘাট হতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা গরু বিক্রির ছলনা দিয়ে বাজার হতে অপহরণ করে নিয়ে যায় গরু ব্যবসায়ী আজগর আলীকে। উদ্দেশ্য ছিলো পাহাড়ে ডেকে নিয়ে আজগর আলীর ব্যবসার সমস্ত টাকা ছিনতাই করা। অথচ আজগর আলীর উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠন কর্তৃক প্রদত্ত ব্যবসার লাইসেন্স অর্থাৎ টোকেন ছিলো। টোকেন থাকা সত্বেও সেদিন তারা আজগর আলীকে মাফ করেনি। সন্ত্রাসীরা তাকে মেরে লাশ মাটিতে পুতে রেখেছিলো। যেই লাশ পাওয়া না গেলেও পাওয়া গিয়েছিলো আজগর আলীর মাথার চুল এবং রক্তমাখা জামা। সেদিন মৃত আজগর আলীর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হারানোর আহাজারিতে রাঙ্গামাটি শহর কাঁদলেও কাঁদেনি আপনাদের বিবেকবান হৃদয়।

শহীদুল

আচ্ছা, কি অপরাধ ছিলো শিশু শহিদুলের? গত ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ ইং তারিখে খাগড়াছড়ির কমলছড়ি ইউনিয়ন থেকে মো: শহর আলীর ছেলে শহিদুল ইসলামকে (১২) অপহরণ করে নিয়ে যায় উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। যেই শহিদুলের খবর আজও মেলেনি। এই শহিদুল কি ভদ্র, সুশীল সমাজের মানবতা পেতে পারেনা? শহিদুলের মায়ের আর্তনাদ না হয় নাই শুনলেন!! এতো শুনলেন আপনাদের ঘোষিত সেটেলার ছাদিকুলদের কাহিনী।

কিন্তু, বলুনতো কি অপরাধ ছিলো বিশাখা চাকমার? কেন সে উপজাতীয় সন্ত্রাসী সঞ্জয় চাকমার লালসায় এভাবে অকালে প্রাণ হারালো? রাঙামাটি শহরের পর্যটন কমপ্লেক্সের পাশে দেওয়ান পাড়া এলাকার মেয়ে বিশাখা চাকমা। যার লাশ পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো। একজন খুনি নারী লোভে ও নিজের কুকৃর্তি ধামাচাপা দিতে কতটুকু নিষ্ঠুর হতে পারে তার প্রমাণ এই বিশাখা হত্যা।

গত ১৪ আগষ্ট, ২০১৪ ইং তারিখ রাতের বেলা নিখোঁজ হয়েছিলো বিশাখা চাকমা। অপহরণকারী সঞ্জয় তাকে ধর্ষণের পরে বস্তায় ভরে মাটিসহ পানিতে ফেলে দেয়েছিলো। সেদিন বিশাখার পরিবারের কান্না আপনারা শুনতে পাননি। এদিকে ক্ষমতাধর সন্ত্রাসী সংগঠন জেএসএস এর সদস্য হওয়ায় বিচার হয়নি সঞ্জয় চাকমার?

বিশাখা চাকমা

এক কল্পনা চাকমার গান আপনারা শুনালেও কোন দিন গাননি বিশাখা চাকমার জন্য গান। এভাবেই আপনারা মানবতার পক্ষ নয়, সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সংঘাত উসকে দিচ্ছেন। – পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সমতলের সুশিল চিন্তাবিদরা সন্ত্রাসীদের পক্ষে না থেকে অসহায় পার্বত্যবাসীর পক্ষে থাকলে এতোদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। নিরাপদে বসবাস করতে পারতো ছাদিকুল, বিশাখা। ধ্বংস হতো রোমেল নামক সন্ত্রাসীরা। আশাকরি রাষ্ট্রের বড় ক্ষতি হওয়ার পূর্বে আমাদের সুশীল সমাজ সত্যের পথে ফিরে আসবেন।

আবু উবায়দা- অনলাইন এক্টিভিস্ট, ব্লগার।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন